আমরা আমাদের সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, প্রভাষক বা অন্য পেশাজীবী না বানিয়ে খুনি বানাচ্ছি। আমাদের আচরণ, আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের জীবনযাপন, আমাদের কর্মকাণ্ড সন্তানের মনোভাব তৈরিতে সহায়তা করে। আমাদের রোজকার জীবনযাপন তাদের ভবিষ্যৎ তৈরিতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।
আমরাই বাচ্চাদের ছোট থেকেই প্রতিযোগী করে গড়ে তুলি। সব সময় তাদের মাথায় ঢোকায় তোমাকে টপ হতে হবে। সবার থেকে বেশি নাম্বার আনতে হবে। তাদের সব কিছুতে প্রথম হতে হবে। জীবনে সফল হতে হবে। সফল হওয়া মানে মোটা টাকার বেতনের চাকরি। গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স। যখন তখন হুটহাট বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গতি। গায়ে ব্র্যান্ডের জামা-জুতা। কথা বলতে হবে ইংরেজিতে। যেকোনো মূল্যে উপরে উঠতে হবে, ঘুষ খেয়ে হোক আর দিয়ে হোক। বৈধ হোক আর অবৈধ হোক যেকোনো উপায়ে সমাজের উঁচুতলার মানুষ হতে হবে। এতে কারো ক্ষতি হলো কি জীবন গেলো দেখার কিছু নেই। বিপুল অর্থ আর ক্ষমতা হল জীবনের সারকথা।
আমরা বাচ্চাদের সফল করতে অক্লান্ত খেটে চলেছি, কি করছি বাচ্চাকে ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র কিনে এনে দিচ্ছি। আমরা টাকা দিয়ে জিপিএ ফাইভ কিনে আনছি। আমরা ভালো স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য ঘুষ দিচ্ছি।
বাচ্চারা এসব চোখের সামনে দেখছে। তারা কিভাবে জীবনের ধাপে ধাপে অন্যায় করতে হয় নিজের স্বার্থে। এই বাচ্চা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কি ন্যায় করবে বলে আপনি আমি মনে করি? ভেবেছেন কি আজ চারদিকে যা হচ্ছে তার উৎপত্তি পরিবার থেকে।
আমরা ধর্ষণ নিয়ে আন্দোলন করছি। এই ধর্ষক কে? আপনার আমার, ভাই, বাবা, কাকা, চাচা, মামা ছেলে ও বন্ধু। এরা কি জন্ম থেকেই ধর্ষক? এদের পারিবারিক বাতাবরণ কি খোঁজ নিয়েছেন। খুব ছোট থেকে তারা দেখে আসছে, পরিবারে নারীকে যখন তখন নিপীড়ন করা যায়। মা, খালা, চাচী, মামীদের উপর তাদের স্বামীদের যখন তখন যেকোনো সময় জোর চলছে যৌন সম্পর্কের, রাজী না হলে জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। নারীর মতের বাইরে তার শরীরে হাত দেয়া হয়, দেয়া যায়। নারী অসহায় অবস্থায় থাকলে তা নিয়ে তাদের নিপীড়ন করা জায়েজ। নারীর অসম্মান নিয়ে কথা বলা বড় লজ্জার, নারী নিপীড়নের স্বীকার হলে তা নিয়ে কথা বলা লজ্জার। আমাদের স্বজন পুরুষরা অন্য নারীকে নিপীড়ন করলে আমরা সেই নিপীড়িত নারীকে দায়ী করে আপন পুরুষের পক্ষ নিয়ে থাকি। অন্যের সন্তানকে সমালোচনা করি কিন্তু নিজের সন্তানকে ফেরেশতা জ্ঞান করি। পুরুষ মানুষ বা ছেলেরা এমন একটু আধটু করবে বলে চুপ করে যাই। ফলে ঘরে বাইরে ধীরে ধীরে বেড়ে গেছে ধর্ষণের মত অপরাধ, এই জন্য সবার আগে দায়ী আমরা, আপনারা, আমাদের পরিবার।
আমরা রাস্তায় কাউকে বিপদে পরতে দেখলে দাঁড়াই না। কারণ, ভাবি- আমার তো কিছু হয়নি। কিংবা কী দরকার অন্যর ঝামেলায় নিজে জড়ানো। বাসায় এসে বাচ্চাদের সামনে সে গল্প বলি এবং এটাও বলি খামোখা অন্যের ঝামেলায় জড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ না। ঝামেলা দেখলে সরে আসা বাঞ্ছনীয়।
আমরা প্রতিনিয়ত বাচ্চাদের সামনে আমাদের তিক্ত সম্পর্কের বিষ উগরাই। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়নে সৃষ্ট সন্তানের মনের অবস্থা আমরা জানতে চাই না। বাবা-মা নামক দুটি মানুষ হিংস্র হয়ে একে অন্যকে গালিগালাজ করে চলে, মনের ক্লেদ-কালিমা উজাড় করে একে অন্যের বদনাম করে, সন্তানকে দলে রাখতে তার সমস্ত অন্যায় আবদার মেনে ধীরে ধীরে তাকে একজন সুবিধাবাদী মানুষ তৈরি করে চলি। এই সন্তানের কাছে ভবিষ্যতে কি ব্যবহার আশা করেন। যে সন্তান সম্পর্কের মানে নোংরামি, ঝগড়া, মারামারি, অধিকার আদায়ের লড়াই পিছে কথা বলা দেখে বড় হয়, তার কাছে কি ব্যবহার আশা করি।
আমরা সন্তানের সুন্দর শৈশব না দিয়ে তাকে ঘরে বন্দী করে রাখছি। তাকে সময় না দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজা-উজির মারছি। বাচ্চাকে সময় দেয়ার বদলে আইপ্যাড, ল্যাপটপ ও কম্পিউটার কিনে দিচ্ছি, তারা যদি এখন এই সব গ্যাজেটে আসক্ত হয়ে যায় তার দোষ কি তাদের না আপনার আমার। আমাদের অর্থ অঢেল আছে বলে ১২/১৩ বছরের ছেলের জন্য বিএমডাবলিউ গাড়ী কিনে দিচ্ছি, মার্সিডিজ বেনজ গাড়ী, অডি, পোরশে, ফারাবি, হ্যামার গাড়ি কিনে দিচ্ছি।দুই/তিন লাখ টাকা দামের ঘড়ি, ৫০ হাজারের জুতা, ১০/১২ হাজার টাকার টি-শার্ট। সাথে খরচের জন্য অফুরন্ত টাকা দিচ্ছি। কিন্তু তাকে দিচ্ছি না বাবা-মা’র সাথে কাটানো আনন্দময় শৈশব, পার্কে বন্ধুদের সাথে খেলা, বাবার সাথে সাইকেল চালানো, নেই মায়ের সাথে মধুর সময় কাটানো। ছুটি কাটানো মানে বিদেশে মা-বাবার বিজনেস ট্যুরে ঘোরাঘুরি। নেই লাইব্রেরীতে যাওয়া, মিউজিয়ামে বা বনে বাদাড়ে তাদের সাথে ঘোরাঘুরি, গাছ-ফুল প্রকৃতি চেনা। সে সব ছাড়াও আমরা খেয়াল করি না আমাদের বাচ্চারা টিভিতে কি দেখে, কম্পিউটারে বসে কি করে, কাদের সাথে ফোনে কথা বলে, তাদের সাথে বসে আমরা টিভিতে তাদের অনুষ্ঠানও দেখি না। বাইরে নেয়ার সময় না পেলেও যে ঘরে অনেক কোয়ালিটি টাইম কাটানো যায় বাচ্চাদের সাথে। আমরা বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা বলে ছুটছি টাকা ও ক্যারিয়ারের পিছনে। সম্পদ সঞ্চয় করছি বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা বলে কিন্তু সেই সম্পদ আহরণের সময়েই শেষ করে চলেছি সন্তানের ভবিষ্যৎ, তার খবর কে রাখছি! আমরা খবর রাখছি কত টাকা জমালাম। কতটা কামালে সাত পুরুষ বসে খেতে পারবো। এদিকে আমাদের একদলের সন্তান রাস্তায় তাদের দামী গাড়ির নীচে চাপা দিয়ে মানুষ মারছে, আমরা লাখ লাখ খরচ করে সেই লাশ ও তার স্বজনদের কিনে নিচ্ছি।
আমাদের অসীম ক্ষমতার কাছে একদল মানুষ শুধুই পতঙ্গ যাদের পিষে মারা যায়। যাদের জন্য কেউ নেই, আইনের চোখে বাঁধা কালো পট্টি আরও কালো হয়ে যায়। তখন কোন আদালত সপ্রণোদিত হয়ে কোন মামলা দেয় না। টাকা আর ক্ষমতায় সব হালাল হয়ে যায়। সমাজের এই অনিয়মগুলির ঘটায় আমরা, ঘটতে দি আমরা। আমরা তখনি নড়ে চড়ে বসি যখন কিছু আমাদের ক্ষতির কারণ হয়।
আমাদের আইন প্রণেতারা নিজেদের সন্তানের জন্য সর্বসমক্ষে অন্যায় করছে। কারণ অন্যায় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, কেউ কাউকে তোয়াক্কা করে না। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্ষমতা আর অর্থের দাপট চলে, আইনের দেবী কালো ফেটিতে চোখ বেঁধে অসহায় হয়ে ন্যায় পাল্লা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্ষমতাবানের সন্তানেরা খুনি হবার পথে এগিয়ে চলে। আমরা অর্থ ও ক্ষমতা পেতে ছুটি চলি সব ন্যায় পায়ে দলে অন্যায় পথে, কে রুধিবে? অন্যায় যে গ্রাস করেছে সমগ্রদেশকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)