সরবরাহে ঘাটতির সুযোগে আমদানির মূল্যের চেয়ে ৬ থেকে ৭ গুণ বেশি দামে বিক্রি হয়েছে বিদেশ থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক বিভাগে পেঁয়াজ আমদানিকারকদের ঘোষিত দাম বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরবরাহের ঘাটতির কারণেই দাম আকাশচুম্বি হয়েছে। এতে ভোক্তারা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সুযোগে যারা মজুদ করে দাম বাড়িয়েছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। তবে ভারত রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করার সাথে সাথেই আমদানিতে উৎসাহ দিলে ও বাজারে সচেতনতা তৈরি করলে দাম এত বেশি হতো না বলে মনে করেন তারা।
এনবিআরের শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে মোট পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৮২৬ টন। বিভিন্ন বন্দর দিয়ে আসা এই পেঁয়াজ আমদানিতে খরচ হয়েছে মোট ৭৫৯ কোটি টাকা। তবে এসব পেঁয়াজের মধ্যে ভারত থেকেই আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজার টন। ভারত রপ্তানি বন্ধ করেছিল ২৯ সেপ্টেম্বর। আর এই ২ লাখ ৩২ হাজার টন পেঁয়াজের পুরোটাই আনা হয়েছে ভারতের রপ্তানি বন্ধের আগে। এগুলোর এলসিও খোলা হয়েছে রপ্তানি বন্ধের আগে। তখন এসব পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল ৩০ টাকা কেজি দরে। ওই সময় শুল্ক বিভাগের কাছে আমদানিকারকরা এই দামই ঘোষণা করেছিলেন।
এর বাইরে আমদানি হওয়া ১৯ হাজার ৮২৬ টন পেঁয়াজ আনা হয়েছে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মিশর থেকে। আবার এর মধ্যে সিংহ ভাগই এসেছে মিয়ানমার থেকে; ১৭ হাজার ৩৪৫ টন। শুল্ক বিভাগে এসব পেঁয়াজের দাম ঘোষণা করা হয়েছে ৪৩ টাকা কেজি।
এছাড়াও অক্টোবরে ভারত থেকে এসেছে আরো ৯ হাজার ৫শ টন পেঁয়াজ। শুল্ক বিভাগে দেয়া দাম অনুযায়ী এগুলোর খরচ পড়েছে কেজিতে ৭৪ টাকা।
১ জুলাই থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার টন। যার কেজিপ্রতি আমাদানি ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪৩ টাকা। এই একই সময়ে থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়েছে ২৩ হাজার ২৫৬ টন পেঁয়াজ। থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা এসব পেঁয়াজের দাম পড়েছে ১৩৩ টাকা কেজি।
তবে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভারত থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে আমদানি করা বড় অংকের ২ লাখ ৩২ হাজার টন ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা ৪৩ টাকা দরে ১ লাখ ৭৩ হাজার টন পেঁয়াজের গড় মূল্য পড়েছে প্রায় ৩৬ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজারে এসব পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২শ থেকে ২২০ টাকায়। অর্থাৎ ক্রয়মূল্যের চেয়ে ৬ গুণ বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, দামের এই উচ্চ মূল্যের একমাত্র কারণ সরবরাহে ঘাটতি থাকা। এই সরবরাহ আগেই নিশ্চিত করা দরকার ছিল।
তিনি বলেন, সরবরাহ সংকটের সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী অতি মুনাফা করেছে। ভোক্তাদের পকেট কাটা হয়েছে। তবে যারা অবৈধ উপায়ে মজুদ রেখে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়েছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। এটা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও মনে করেন, সরবরাহ ঘাটতির কারণেই দাম বেড়েছে।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ভারত রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার আগে যেগুলোর এলসি খোলা হয়েছে তার সবগুলো তখনই এসেছে কি না জানি না। তবে ভারতের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দামে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে দামে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে।
“বর্তমান সময়ের সরবরাহ দিয়ে কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় না (পেঁয়াজ একটি কৃষি পণ্য)। আগামী দিনগুলোতে সরবরাহ কি পরিমাণে হবে তার উপর ভিত্তি করেই দাম নির্ধারিত হয়। আর এক্ষেত্রে রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার মানে আর আমদানি হচ্ছে না। এই সুযোগেই দাম বেড়ে গেছে।”
তবে রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার সাথে সাথেই সরকার আমদানিতে উৎসাহ দিলে তখনি আমদানি বাড়তো। পাশাপাশি বাজারেও সচেতনতা তৈরি করা দরকার ছিল। এতে দামে এত উল্লম্ফন হতো না বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
“কিন্তু ব্যবসায়ীরা মজুদ করে যে দাম বাড়ায়নি, তা নয়। এক্ষেত্রে তাদেরও কৌশল ছিল। সেজন্য আগেই সতর্ক থাকলে বাজারে এত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো না”
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন: যারা আগেই আমদানি করে রেখেছেন সংকটের সময় তারা অধিক লাভ করতে পেরেছেন। তারা ভাগ্যবান। আবার দাম কমে গেলে তাদের লোকসানও গুণতে হবে। এটা ব্যবসার রীতি।
“তবে মূল কথা হলো যারা মুনাফা করেছেন তারা যেন আয়করটা ঠিকভাবে পরিশোধ করেন। এটা এনবিআরকে দেখতে হবে।”
তিনি বলেন, মুনাফা যা করার তা ব্যবসায়ীরা করে নিয়েছে। দাম আর বাড়বে না। কারণ দেশি পেঁয়াজ বাজারে এসে গেছে, পাতাসহ ৮০ টাকায় কেজি বিক্রি হচ্ছে। অতএব শঙ্কা নেই।
শ্যামবাজার পেঁয়াজ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ মাজেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বেশি দাম ছিল ৩ দিন। এখন তো কমে গেছে। তবে হ্যাঁ, এটা সত্য যে, কিছু ব্যবসায়ী প্রচুর মুনাফা করেছেন। এরা হাতেগোনা ৪/৫ জন। আমরা এতো বেশি আমদানিও করিনি। লাভও করতে পারিনি।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বোর্ডের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৭ থেকে ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। যা দেশের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি। বাকি প্রায় ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ৭ থেকে ১১ লাখ টন আমদানি করা হয়। তবে এর ৯৫ শতাংশই আমদানি করা হয় ভারত থেকে। বাকি ৫ শতাংশ আসে মিয়ানমার, তুরস্ক ও মিশর থেকে।
শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে ৫ লাখ ৭ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিলো। আর এই অর্থবছরজুড়ে আমদানি হয়েছিলো প্রায় ১১ লাখ টন। আর তার আগের অর্থবছরে আমদানি হয়েছিলো ৯ লাখ টন পেঁয়াজ।