রাজনৈতিক দল কিংবা জোটগুলো যারাই যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন তারা দেশের টেকসই উন্নয়নের চেয়ে সহজে, অতি অল্পসময়ে দৃশ্যমান উন্নয়নের প্রতিই দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশি গুরুত্বারোপ করে থাকেন। দেশের আপামর সাধারণের কথা ভেবে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের পথে না হেঁটে ভোটের রাজনীতি কিংবা সভা, সমাবেশে প্রচার-প্রচারণায় সুবিধার জন্য যতটুকু উন্নয়ন প্রয়োজন ততটুকুতেই তারা সীমাবদ্ধ থাকতে ভালোবাসেন এবং এতেই তাদের চেহারা ও মননে রাজ্যের সকল প্রশান্তি, আত্মতুষ্টি আর অহংবোধ ফুটে উঠতে দেখা যায়।
অল্প সময়ে দৃশ্যত উন্নয়ন খারাপ একেবারে খারাপ নয়। তবে টেকসই উন্নয়নে নজর না দিলে ভারত আচানক পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে কীভাবে ৩০ টাকার পেঁয়াজ রাতারাতি ৩০০ টাকায় ঠেকে, আর এর ফলে সৃষ্ট আপামর জনসাধারণের চরম মাত্রার ভোগান্তির কথা, দুর্দশার কথা, অসাধু ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে এর সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তাব্যক্তিদের অসহায়ত্বের কথা বলতে চাই।
দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন আমাদের উন্নতি আর এগিয়ে চলার সাক্ষ্য যেমন বহন করে, তেমনই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়ে দেশে রাতারাতি পেঁয়াজের দাম অবিশ্বাস্য অকল্পনীয় উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়াটাও আমাদের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নে ব্যর্থতা কিংবা অবহেলার চিত্রও বহন করে।
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও কেন আমাদের ভারত বা অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ এনে দেশের চাহিদা মেটাতে হয়? কী নেই এদেশে? মাটি নেই? পানি নেই? চাষবাসের অনুপযোগী বৈরী আবহাওয়া? এদেশে সবই আছে। দরকার শুধু আপামর জনসাধারণের কথা ভেবে সত্যিকারের টেকসই উন্নয়নের আন্তরিক প্রচেষ্টা, দূরদর্শী পদক্ষেপ।
আমাদের যেমন অল্পসময়ে দৃশ্যমান উন্নয়ন দরকার, তেমনই রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি খেটে-খাওয়া মানুষ কিংবা প্রতিটি পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন তথা নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্যের ব্যয় কমিয়ে স্বল্প ও সুলভ মূল্যে তাদের হাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে আরও বেশি গতিশীল করার টেকসই বন্দোবস্ত করাও দরকার। অথচ আমাদের জীবনযাত্রার ব্যয় প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে, যার ভুক্তভোগী স্বল্প আয়ের খেটে-খাওয়া মানুষগুলো।
আর এ নিয়ে যাদের ভাববার কথা দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুশ্চিন্তার কোনো ভাঁজ তাদের কপালে দেখা যায় না।
একবিংশ শতাব্দীর শিল্পায়নের এই যুগে কৃষি প্রধান দেশে কৃষির প্রতি মানুষের আগ্রহ কিংবা কৃষির বিস্তারে ব্যক্তি উদ্যোগের সাফল্যের কথা আমরা যেমন জানি, তেমনি অপরিকল্পিত আবাসন, শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষের কৃষিবিমুখ হয়ে অনেক আবাদি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে থাকার কথাও আমাদের অজানা নয়।
চলমান দুরাবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের উচিত অতিসত্বর কৃষির প্রতি আরও বেশি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেয়া। দেশের অধিকাংশ মানুষের আয়ের প্রধান উৎস সম্ভাবনাময় কৃষি খাতকে আরো বেশি প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষকদের পাশাপাশি দেশের বেকার জনসংখ্যাকে কৃষির প্রতি উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে মুষ্টিমেয় অঞ্চলকে কৃষিতে সীমাবদ্ধ না রেখে দেশের প্রতিটি জেলাকে স্বতন্ত্রভাবে নিজেদের খাদ্য নিজেদের জোগান দেয়ার সক্ষমতায় উন্নীত করা। যেটি ব্যক্তি উদ্যোগে করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।
বর্তমানে অনেকাংশেই দেখা যায়, নির্দিষ্ট অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই দেশের এক জেলাকে আরেক জেলার ওপর নির্ভর থাকতে হয়। যার ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের পাশাপাশি দূরপাল্লার অধিক পরিবহন ব্যয়ের কারণে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের দাম আর ভোক্তাদের হাতে পৌঁছানো পণ্যের দামের মাঝে বিস্তর ফারাক দেখা দেয়। এতে কৃষক আর ভোক্তাগণ উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, লাভবান শুধু মধ্যস্বত্ত্বভোগী অসাধু চক্র।
কাজেই প্রতিটি জেলায় উপজেলা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রণোদনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণ করে বেকার জনসংখ্যাকে এর আওতায় এনে একটি কৃষি কাঠামো তৈরির মাধ্যমে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড এবং কেন্দ্রীয়ভাবে স্বচ্ছতার সাথে মনিটরিং করে প্রতিটি জেলাকে নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিজেদের উৎপাদনে সক্ষম করা গেলে, দেশের বেকার সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি আপামর জনসাধারণের জীবনযাত্রার ব্যয় বহুলাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। এতে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবার ফলে কৃষকরাও লাভবান হবে, পাবে তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য। পাশাপাশি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে উদ্বৃত্ত পণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে দেশ অর্জন করবে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা।
যতটুকু আমাদের পক্ষে সম্ভব ততটুকুতে আমরা অন্য কোনো দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাই না। চাষাবাদের উপযোগী আবহাওয়া, উর্বর মাটি আর আমাদের বৃহৎ জনশক্তিকে সঠিক ও পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে আমরা নিজেরা সাবলম্বী হয়ে দুধেভাতে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে চাই। এটাই আমাদের চাওয়া, বেশি কিছু নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)