মুক্তধারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মু. সিদ্দিকুর রহমান পারভেজ। ২০০৬ সাল থেকে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। আবৃত্তি অঙ্গনে তার সময় কাটল ১৯ বছর। নিজের আবৃত্তি ভাবনা এবং সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চা নিয়ে কথা বলেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে।
আবৃত্তি শিল্পের সঙ্গে সতের বছর অতিক্রান্ত করে ফেললেন, আপনাকে শুভেচ্ছা। শুরুর গল্পটা জানতে চাই।
পারভেজ: আমার এক মামা কবিতা লেখেন, আবৃত্তি করেন। তিনি একদিন কণ্ঠশীলনের এক আবৃত্তি কর্মশালায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটা ১৯৯৮ সালের কথা। সেটাই শুরু বলতে পারেন। তখন মুক্তধারার সদস্য সংগ্রহ চলছিল। আমি মুক্তধারার সদস্য হয়ে যাই। তারপর থেকে মুক্তধারার সঙ্গেই আছি। (আসছে ১২ জানুয়ারি ২০১৮-তে মুক্তধারা আটাশ বছর পূর্তি উদযাপন করবে।)
তাহলে কবিতার প্রতি প্রেম থেকেই আবৃত্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া?
পারভেজ: না। শুধুই কবিতার প্রতি প্রেম বলা যাবে না। আমার ইচ্ছা ছিল অভিনেতা হওয়ার। এজন্য অভিনয় কোর্স করা থেকে শুরু করে নানা কর্মশালা করেছি। ২০০৩ সাল থেকে আমি বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী। কিন্তু বিভিন্ন কারণে শেষ পর্যন্ত অভিনেতা হওয়া হয়নি। তাই বলে আবৃত্তি ছাড়িনি আমি। আবৃত্তি শিল্প নিয়ে অনেক স্বপ্ন আমার।
কী ধরনের স্বপ্ন? একটু বিস্তারিত বলবেন?
পারভেজ: আবৃত্তি সম্পর্কে আমাদের একটা কমন ধারনা তৈরি হয়েছে। যেমন: আবৃত্তি মানেই শুধু কবিতার পাঠ এবং সেটা কতিপয় প্রেমের কবিতা, দেশাত্মবোধের কবিতা এবং বিদ্রোহের কবিতা। এর বাইরে যেন আবৃত্তিযোগ্য আর কিছু নেই। আমি এই ধারনা ভেঙে দিতে চাই। সাহিত্যপদবাচ্য যেকোনো কিছুর আবৃত্তি হতে পারে। যেমন গল্প, প্রবন্ধ, ফিচার, ছড়া, কথিকা, নাটক ইত্যাদি। আমি এই সবকিছু আবৃত্তির মধ্যে নিয়ে আসতে চাই। আপনারা জানেন, পুথিপাঠ একসময় তুমুল জনপ্রিয় ছিল। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় চরমপত্র অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। সুতরাং কবিতার বাইরেও আবৃত্তি হতে পারে। সেটা আমি করে দেখাতে চাই।
দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে আপনি আবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে আবৃত্তির সাংগঠনিক চর্চা সম্পর্কে আপনার দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা কী বলে?
পারভেজ: অম্লমধূর অভিজ্ঞতা বলতে পারেন। দেশে আবৃত্তির সংগঠন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এখন তো ঢাকাতেই তিনশ’র বেশি আবৃত্তি সংগঠন আছে। এসব সংগঠনে আবৃত্তিচর্চা হচ্ছে, কবিতাচর্চা হচ্ছে। আবৃত্তি শিল্প এগিয়ে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে। তবে আবৃত্তি শিল্প এখনো শক্তিশালী কোনো ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়নি। এই সেক্টরে যে বৈচিত্র্য আসা প্রয়োজন ছিল, সেটাও আসেনি। রাজধানীর বাইরে আবৃত্তির আয়োজন নেই বললেই চলে। আঞ্চলিক কবিতার আবৃত্তি হয় না। শুধু গানের কথারও আবৃত্তি হতে পারে। রম্য গদ্য নিয়ে আবৃত্তি হতে পারে। সুকুমার রায়ের ছড়া নিয়ে আবৃত্তি হতে পারে। কিন্তু এসব বৈচিত্র্য নিয়ে কোনো সংগঠন ভাবে না।
এর পেছনে কারণ কী বলে মনে হয়?
পারভেজ: কারণ অনেক কিছুই। তবে সবচেয়ে বড় কারণ নিজেদের উদ্যোগ ও উদোমের অভাব। সময়ের অভাব। আবৃত্তি শিল্পীরা নানা কাজে ব্যস্ত। সংগঠনে দেয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় তাদের থাকে না। এরপর দ্বিতীয় কারণ যেটা বলব সেটা হচ্ছে গণমাধ্যমের অসহযোগিতা। নিজেদের নানা ব্যস্ততা সত্ত্বেও আবৃত্তি শিল্পীরা নানা আয়োজন করছেন, তারা কিন্তু থেমে নেই; কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে সেসবের খবর আসে না গণমাধ্যমে। আপনারা জানেন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় আবৃত্তিশিল্পীরা একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল গণমাধ্যমের আনুকূল্যের কারণে।
আপনি বলছিলেন, দেশে আবৃত্তির সংগঠন বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় আবৃত্তি শিল্পী উঠে আসছে কি?
পারভেজ: না, সেই তুলনায় আবৃত্তি শিল্পী উঠে আসছে না। শিমুল মোস্তফা কিংবা মাহিদুল ইসলামের পর চোখে পড়ার মতো আবৃত্তি শিল্পী উঠে আসেনি। এর পেছনে কারণ হচ্ছে, শিমুল মোস্তফাদের সময়ে প্রতিযোগিতা কম ছিল কিন্তু চর্চা ছিল বেশি। এখন হয়েছে উল্টো। এখন প্রতিযোগী বেশি কিন্তু চর্চা কম। এখনকার আবৃত্তিশিল্পীরা সহজেই ফোকাস হতে চায়। এর জন্য যে সাধনার প্রয়োজন সেটা তারা করতে চায় না। এর জন্য যে পড়াশোনার প্রয়োজন সেটা তারা করতে নারাজ। এসব কারণে আবৃত্তি শিল্পী উঠে আসছে না বলে মনে করি।
আবৃত্তিশিল্পীদের পক্ষ থেকে আরেকটা অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় যে বর্তমান সময়ে আবৃত্তিযোগ্য কবিতা লেখা হচ্ছে না। আপনারও কি তাই মনে হয়?
পারভেজ: না, আমি তেমনটা মনে করি না। যারা এই অভিযোগ করেন, আমি মনে করি তারা কবিতা পড়েন না। সাম্প্রতিক কবিতার খোঁজখবর রাখেন না।
অভিযোগ প্রসঙ্গে আর একটা প্রশ্ন করি। আবৃত্তিশিল্পীরা বলেন যে, তাদের কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?
পারভেজ: পুরোপুরি একমত নই। কারণ, সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমিতে আবৃত্তি বিভাগ যোগ হয়েছে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে আবৃত্তি যুক্ত করার চেষ্টা চলছে। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর নিজেও একজন আবৃত্তিশিল্পী। তিনি আবৃত্তিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কাছাকাছি নিয়ে যেতে কাজ করছেন। তবে এটাও স্বীকার্য যে, নাটক, গান অভিনয়সহ শিল্পকলার অন্যান্য শাখার জন্য একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ বিভিন্ন সরকারি স্বীকৃতি রয়েছে; যেটা আবৃত্তি শিল্পীদের জন্য নেই। এদিকটায় সরকারের নজর দেয়া উচিত বলে মনে করি।
সংগঠন হিসেবে আপনাদের কী করা উচিত? যেহেতু আপনি একটি আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত…
পারভেজ: অন্যান্য সংগঠনের কথা বলতে পার না, যেহেতু সব সংগঠনের সঙ্গে আমি জড়িত নই। তবে মুক্তধারা আবৃত্তিকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। নতুন বছর থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্কুলে স্কুলে আবৃত্তি কর্মশালা করবে মুক্তধারা। এছাড়া দেশের প্রতিটি জেলায় মুক্তধারার শাখা প্রতিষ্ঠা করা হবে। স্কুলের শিক্ষার্থীদেরকে শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তিতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করবে মুক্তধারা। এছাড়াও আঞ্চলিক ভাষার কবিতা, গান, গল্প, গাথা, লোককথা, পুথি ইত্যাদি নিয়ে মুক্তধারা কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
মুক্তধারার পরিকল্পনা শোনা হলো। এর বাইরে আপনার নিজের জন্য কোনো পরিকল্পনা?
পারভেজ: নিজের জন্য তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। আবৃত্তি নিয়ে আমার যেসব পরিকল্পনা রয়েছে সেসব মুক্তধারার মাধ্যমেই বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। তবে ভবিষ্যতে আবৃত্তির অ্যালবাম করার ইচ্ছা আছে। যেহেতু আবৃত্তির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আছি, অনেক রেকর্ডও সংগ্রহে আছে, সুতরাং অ্যালবাম বের করা যেতেই পারে।
নতুন প্রজন্মের যারা আবৃত্তিশিল্পে আসতে চায় তাদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
পারভেজ: নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তো আবৃত্তিতে আসতেই চায় না। কারণ এখানে ফোকাস হওয়া যায় না। চেহারা দেখানো যায় না। যারা আসে তারা মূলত সংবাদ উপস্থাপক কিংবা অভিনেতা হতে চায় তাই উচ্চারণ ঠিক করতে আবৃত্তি করতে আসে। তারপর একসময় চলে যায়। আবৃত্তিকে ভালোবেসে এ শিল্পের সঙ্গে কেউ থাকতে চায় না। তারপরও যদি কেউ শুধু আবৃত্তি শিল্পী হওয়ার জন্য আসতে চায়, তাদেরকে বলব, এটা একটা ডিসিপ্লিন মাধ্যম। এ মাধ্যমে সফল হতে হলে সাধনা হরতে হয়। ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হয়। এবং প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়।