আমাদের চার বছর পরপর রক্ত খলবলিয়ে ওঠে ফুটবল নিয়ে। কেবল এই বিশ্বকাপ এলেই মাত্র। বাকি সময় আমরা প্রায় ভুলেই থাকি আমাদের জীবনের প্রথম খেলনা ও খেলা ফুটবলের কথা। তবে আমাদের ফুটবলের অতীত এমন নয়। বাঙালী জাতির সবচেয়ে উন্মাদনার নাম ছিলো ফুটবল। ঘুম থেকে উঠেই ফুটবলে লাথি। স্কুল ব্যাগে টিফিন থাক বা না থাক, জালে একটি ফুটবল আবশ্যক। নয়তো টিফিনই যে হবে না। আর তা ছাড়া আন্তস্কুল টুর্নামেন্টেও তো ভালো করতে হতো। অনেকের তো লেখাপড়ার চেয়ে ফুটবলেই গুরুত্ব ছিলো বেশী। আর হবেই বা না কেন ? ভালো ফুটবলারদের যে স্কুলে বিশেষ কোটা দেয়া হতো। বড় হয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের মতো ফুটবলারও হতে চাইতাম আমরা।
যারা মিরপুরের মতো উপ-শহরে বাস করতাম, আমাদের প্রথম শহর দেখা হতো তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে আবাহনী মোহামেডান ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে। যদিও আমার প্রথম খেলা দেখার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিলো না। কেননা পুরোটা সময় জুড়েই ছিলো আবাহনী আর মোহামেডানের সমর্থকদের ঢিল ছোঁড়াছুড়ি। বলতে দ্বিধা নেই বাবার সাথে গিয়েছিলাম ওই ম্যাচ দেখতে। এক পর্যায়ে দেখি যে, বাবা আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি সে খেয়াল না করে একটার পর একটা ঢিল ছুঁড়ছে মোহামেডানের গ্যালারির দিকে। বুঝে গেলাম ওরাই আমাদের চিরশক্র (হা হা হা )। আমিও ঢিল ছুঁড়তে লাগলাম। আমাদের জীবনে তখন শুধু ফুটবলারই একমাত্র হিরো।
পেলে ম্যারাদোনার মতো আন্তর্জাতিক হিরো না হলেও দেশীয় হিরো কম ছিলো না। সালাউদ্দিন, আসলাম, কায়সার হামিদ, মুন্না, সাব্বির, গাউস, রুমি, ভীষণ প্রভাব নিয়ে ছিলেন আমাদের জীবনে। একবার তো বিকেএসপি’র বখতিয়ার, মাসুদ রানারা তাক লাগিয়ে দিলো সারা পৃথিবীকে। স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিলো আকাশ উচ্চতায়। যদিও স্বপ্ন সব সময় স্বপ্নই থাকে। সে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। ঢাকা স্টেডিয়ামের পর এলো মিরপুর স্টেডিয়াম। ঢাকা স্টেডিয়ামে কিছুটা কোণঠাসা আবাহনীর সমর্থকরা প্রাণ ফিরে পেলো। কঠিন জমে উঠতো প্রতিটা ম্যাচ। মাঠের যুদ্ধ ফুটবলে, আর বাইরে যুক্তি, তর্ক, আবেগে। দেয়ালে দেয়ালে চিকা আর ছাদে ছাদে পতাকা। মূলত এই যুদ্ধ চলতো আবাহনী মোহামেডান সমর্থকদের মধ্যে। যুদ্ধ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়তো পাড়া মহল্লা, গ্রামে গ্রামে। শুধু কি আবাহনী মোহামেডান? কতো ধরনের ফুটবল ছিলো আমাদের জীবনে! বড়-ছোট, বিবাহিত-অবিবাহিত, খাটো-লম্বা, ফর্সা-কালো এমন নানা ভাবে বিভক্ত হয়ে চলতো ফুটবল। এমন কি রোজার দিনেও বন্ধ থাকতো না ফুটবল। কি বৃষ্টি কি রোদ! ফুটবল চালু। আস্তে আস্তে সেই ফুটবল জনপ্রিয়তা হারালো বাঙালী জীবনে। তবে মুছে যে যায়নি তা বোঝা যায় এই বিশ্বকাপ এলে।
জাতি বর্তমানে স্পষ্ট দুই ভাগে বিভক্ত ব্রাজিল আর্জেন্টিনার। সেই আবাহনী মোহামেডানের মতোই। ফুটবলে ১৯৭ নাম্বার দেশে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা এতো জনপ্রিয় কেন? বিস্ময় খোদ ওই দুই দেশেও। আসল রহস্য তো আমরা জানি কেবল। মনে অজান্তেই রক্তে খলবল করে ফুটবল। নিজেরাই সাজিয়ে নিয়েছি নিজেদের মতো করে। মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা ফুটবলের প্রতি গোপন প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ব্রাজিল আর্জেন্টিনায়। এ আনন্দ একান্ত আমাদেরই। সারা পৃথিবী ফুটবল নিয়ে মাতবে কয়দিন পরেই। আমরাও এর বাইরে নয়। তবে বৈঠকি জাতি হিসেবে আমাদের যুক্তি তর্ক আড্ডায় লড়াই চলবে আমাদের মতো করে। যার সাথে হয়তো এই ফুটবল এই বিশ্বকাপের কোন হিসেব নিকাশ মিলবে না।
শেষ করবো ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে। সেদিন ছিলো মিরপুর স্টেডিয়ামে আবাহনী মোহামেডানের খেলা। পাড়ায় আমাদের এক খুব স্টাইলিশ বড় ভাই ছিলেন মোহামেডানের ভীষণ ভক্ত। ব্যক্তিগত কাজে মোটরবাইক নিয়ে গিয়েছিলেন সাভারে। খেলা শুরু হয়ে যাবে এই ভয়ে ফিরছিলেন খুব দ্রুত বাইক চালিয়ে। একই সময় তৎকালীন রাষ্ট্র প্রধান ফিরছিলেন ওই পথ দিয়েই। পরে শুনেছি বারবার বলার পরেও তিনি বাইকের গতি কোমাননি। হয়তো স্টেডিয়ামে পৌঁছানোর তাড়া ছিলো । কিন্তু বিষয়টি সহজ ভাবে নেয়নি নিরাপত্তা বাহিনী। সেই বড় ভাইকে পরে প্রায় দেখা যেতো রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছেন আপন মনে। কেন তিনি হটাত এমন হয়ে গেলেন এ রহস্য আজো সবার অজানা। ঠিক যেমন অজানা কেন জনপ্রিয়তা হারালো দেশীয় ফুটবল….. জীবনের প্রথম খেলা…।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)