চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আবরার হত্যাকাণ্ড এবং কিছু প্রাসঙ্গিকতা

সাম্প্রতিক সময়ের সবচাইতে আলোচিত ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড। দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষ এই ঘৃন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছে। দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে থেকে সরকারদলীয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীদের দেখা গেছে এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে এবং হত্যাকারীদের শাস্তি চাইতে। প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকেও দেখা গেছে দক্ষতার সাথে তদন্তকার্য এগিয়ে নিতে ও দোষীদের প্রেপ্তারে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে।

এ ঘটনায় ইতোমধ্যে ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অভিযুক্ত হত্যাকারীরা অধিকাংশই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত বলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ অতি সল্প সময়ের মধ্যেই তদন্ত কমিটি গঠন করে জড়িতদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে এবং তাদের অবস্থান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। আবরার হত্যাকাণ্ডের পর এই সমস্ত ঘটনাগুলো আমাদের আশাবাদী করে এই কারণে যে সঠিক বিচারের ফলে নিশ্চয় এই ধরনের অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পাবে।

আবরার ফাহাদ হত্যা পরবর্তী আন্দোলন, প্রতিবাদ এবং প্রতিকার আমাদেরকে আরও আশাবাদী করে তোলে বিগত দিনের নারকীয় হত্যাকাণ্ডসমূহের বিচার প্রাপ্তির ব্যাপারে। এই প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেন না এই বুয়েটেই ২০০২ সালে ছাত্রদলের দুই পক্ষের সন্ত্রাসীদের গোলাগুলিতে প্রাণ হারান ২য় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী সাবিকুন নাহার সনি। গোলাগুলির কারণ ছিলো বড় অংকের টেন্ডার নিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। তৎকালীন বুয়েট ছাত্রদলের সভাপতি মুকিত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের ছাত্রদল নেতা টগর বাহিনীর মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সনি হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন তৎকালীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকার খুব ভালোভাবে নেয়নি। আন্দোনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ এবং মামলা রেকর্ড করতে টালবাহানা তাই প্রমান করে। উপরন্তু ছাত্রদল নেতা আসামি মুকিত, শুটার নুরু গংদের তৎকালীন বিএনপি সরকারের মন্ত্রী এমপিরা আশ্রয়-প্রশয় দিয়েছিলেন এবং পালিয়ে যেতেও সাহায্য করেছিলেন।

এই বুয়েটেই ২০১৩ সালে জামায়াত-শিবিরের জঙ্গিরা কুপিয়ে মারাত্বকভাবে আহত করে মেধাবী ছাত্র ছাত্রলীগ এর যুগ্ন আহবায়ক আরিফ রায়হান দ্বীপ কে। বেশ কিছুদিন আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে দ্বীপ মারা যায়। ২০১৩ সালের আগষ্ট মাসে তৎকালীন বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক তন্ময় আহমেদকে ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসীরা একই কায়দায় কুপিয়ে আহত করে। ঘাড়ে, মাথায়, পিঠে এবং শারীরের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক জখম নিয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালের বেডে পড়ে থাকতে হয় তন্ময়কে। প্রানে বেঁচে যায় তন্ময়, তবে শরীরের সেই ক্ষত আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে।চট্টগ্রামে শিবিরের সন্ত্রাসীদের এইট মার্ডার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের তাণ্ডব, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতা ফারুক হোসেন হত্যা, জামায়াত-বিএনপির তথা উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর এমন অসংখ্য নির্মমতার খতিয়ান আছে এদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী মাসুদকে দেখতে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে কুপিয়ে এক পায়ের পাতাসহ গোড়ালি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলো শিবিরের সন্ত্রাসীরা। কী ভয়াবহ দৃশ্য, ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। এই ঘটনাগুলো উল্লেখ করার কারণ হলো, কোনো ধরনের সন্ত্রাসী আচরণই কাম্য নয়, আক্রমণকারী কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তি সে যে দলের বা মতেরই হোক।

আবরার হত্যাকাণ্ডের পরে বুয়েট অ্যালামনাইয়ের অনেক সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছেন। অভিনেতা আবুল হায়াত তীব্রভাবে এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছেন, প্রমিত বাংলা ভাষায় মর্মস্পর্শী ভাষণে উপস্থিত শ্রোতা এবং দেশবাসীকে আবেগে আপ্লুত করেছে। এই প্রতিবাদ প্রশ্নাতীতভাবে ইতিবাচক। বিশিষ্ট ব্যক্তি ও গুণীজনদের কাছ থেকে এমনটাই আশা করে দেশের সচেতন নাগরিকগণ। তাই এই কাজটি যদি তিনি বুয়েটে সনি হত্যাকাণ্ড কিংবা দ্বীপ হত্যাকাণ্ডের সময় করতেন তাহলে নিশ্চয় এইসময়ের মতো তখনও তার বিবৃতির একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তো। তখন কেনো তিনি কোনো প্রতিবাদ করলেন না এটা আসলেই আমাদের অজানা !

২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের অব্যাহত আগুন সন্ত্রাসে দেশে তখন এক বিভীষিকাময় অবস্থা বিরাজমান। নারী, পুরুষ থেকে শুরু করে নিরীহ শিশুরাও রক্ষা পাচ্ছিলো না তাদের এই অগ্নি সন্ত্রাসের কবল থেকে। সে সময় দেশের সচেতন নাগরিকগণ যার যার অবস্থান থেকে এর প্রতিবাদ করছিলেন। আমরাও মাঠে নেমেছিলাম প্রতিবাদের নানারকম কর্মসূচি নিয়ে। এর মধ্যে একটি ছিলো দেশের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে মানুষ হত্যার এই নারকীয়তার প্রতিবাদে লিখিত এবং ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে প্রতিবাদী বিবৃতি সংগ্রহ করে প্রচার করা। প্রায় সকল বিশিষ্টজনেরাই সেদিন বিবৃতি দিয়েছিলেন।

শেষ করবো একজন গুনী অভিনেতার প্রসঙ্গ টেনে। আবরার হত্যাকাণ্ডের পরে তিনি এবং বুয়েট অ্যালামনাই এর অনেক সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছেন। একজন অভিনেতা তীব্রভাবে এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছেন, প্রমিত বাংলা ভাষায় মর্মষ্পর্ষী ভাষনে উপস্থিত শ্রোতা এবং দেশবাসীকে আবেগে আপ্লুত করেছে। এই প্রতিবাদ প্রশ্নাতীতভাবে ইতিবাচক। বিশিষ্ট ব্যক্তি ও গুনীজনদের কাছ থেকে এমনটাই আশা করে দেশের সচেতন নাগরিকগন। তাই এই কাজটি যদি তিনি বুয়েটে সনি হত্যাকাণ্ড কিংবা দ্বীপ হত্যাকাণ্ডের সময় করতেন তাহলে নিশ্চয় এইসময়ের মতো তখনও তার বিবৃতির একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তো। তখন কেনো তিনি কোনো প্রতিবাদ করলেন না এটা আসলেই আমাদের অজানা! ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের অব্যাহত আগুন সন্ত্রাসে দেশে তখন এক বীভিষিকাময় অবস্থা বিরাজমান । নারী, পুরুষ থেকে শুরু করে নিরীহ শিশুরাও রক্ষা পাচ্ছিলো না তাদের এই অগ্নি সন্ত্রাসের কবল থেকে । সে সময় দেশের সচেতন নাগরিকগন যার যার অবস্থান থেকে এর প্রতিবাদ করছিলেন । আমরাও মাঠে নেমেছিলাম প্রতিবাদের নানারকম কর্মসূচী নিয়ে । এর মধ্যে একটি ছিলো দেশের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে মানুষ হত্যার এই নারকীয়তার প্রতিবাদে লিখিত এবং ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে প্রতিবাদী বিবৃতি সংগ্রহ করে প্রচার করা । প্রায় সকল বিশিষ্টজনেরাই সেদিন বিবৃতি দিয়েছিলেন। যখন সেই অভিনেতাকে বললাম তখন তিনি আমাকে বিবৃতি দেবেন বলে দুই দফায় চার/পাঁচদিন কালক্ষেপন করলেন। পরে পুনরায় ফোন করলে তিনি খুব নির্বিকারভাবে বললেন, “দেখো, আমি কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে যেতে চাইনা, আমাকে বাদ দাও” । আমি বলেছিলাম, “ভাই, এটা তো কোনো রাজনৈতিক অবস্থান থেকে আপনি বলছেন না, আপনি মানুষ হিসেবে মানবিক অবস্থান থেকে বলবেন”। তিনি সেদিন বিবৃতি দেননি। তিনি সেদিন আগুনে ঝলসে যাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে রাজনীতি খুঁজে পেয়েছিলেন। আজকের আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে তিনি রাজনীতি খুঁজে পাননি বলে আমরা কৃতজ্ঞ তার কাছে। যে দৃষ্টিভঙ্গিতেই প্রতিবাদ করুক, করেছেন তো, তাই বা কম কি !

আমরা সবাই যদি আমাদের দলীয় পছন্দ-অপছন্দ, চিন্তার ভিন্নতা, জাত-ধর্ম-সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ গণ্ডির ঊর্ধ্বে থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারি তবে সত্যিই আমাদের দেশ থেকে একদিন অপরাধ প্রবণতা অনেকাংশে কমে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে রথী মহারথীরাই যেখানে এই সংকীর্ণতা থেকে বের হতে পারছেন না, সাধারণ জনগণের দ্বারা তা কতটুকু সম্ভব !

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)