মিরপুরের সাইক পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী আফসানা ফেরদৌস। তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগ নেতা রবিনের সঙ্গে আফসানার বন্ধুত্ব ছিল। কিছুদিন আগে এ বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। এর জেরে রবিনসহ আরও কয়েকজন মিলে আফসানাকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করে। আফসানার ঘনিষ্ঠজনদের অভিযোগ, তাকে হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ যেন কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনুর ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। শুধু স্থান-কাল-পাত্র আলাদা!
ঘটনার পর আফসানার মা সৈয়দা ইয়াসমিনকে অনেকেই শক্ত হওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। সান্ত্বনা দিচ্ছেন। শোকগ্রস্ত এই মা বলেছেন, আমি কেন শক্ত হব? তাইতো, তিনি কেন শক্ত হবেন? কেন আমরা প্রতিবাদমুখর হব না? কেন রাষ্ট্র ও প্রশাসন আফসানার হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করবে না? আফসানা তো কোনো অন্যায় করেনি। কাউকে ভালো লাগার অধিকার যেমন প্রত্যেকের আছে। ঠিক তেমনি কাউকে পছন্দ না করার স্বাধীনতাও রয়েছে। পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে জোর জবরদস্তি চলে না। হত্যা-খুন তো নয়ই। নিজের আকাঙ্ক্ষা-লোভ চরিতার্থ করার জন্য অতর্কিতে, নিরীহ কাউকে হত্যা করা যায় না। অথচ আফসানার ক্ষেত্রে তাই করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে শক্ত হওয়া কাউকেই মানায় না। এমনকি আফসানার মায়েরও না। কেন শক্ত হবেন তিনি? কীসের দায় তাঁর শক্ত হওয়ার? এখনই তীব্র বিক্ষোভের সময়। চূড়ান্ত ক্রোধের সময়। হাজার হাজার প্রশ্ন করার সময়। ডুকরে, বুক ফাটিয়ে কাঁদার সময়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে ঢাকায় যাওয়া অষ্টাদশী আত্মজার টগবগে জীবন যদি বেমক্কা অন্যের পিশাচখেয়ালে নষ্ট হয়ে যায়, তবে কেন সন্তানহারা মা তাঁর সন্তানের মৃত্যুতে ক্রুদ্ধ হবেন না, ক্ষোভ প্রকাশ করবেন না, চিৎকার করে কাঁদবেন না, ভাগ্যকে দোষারোপ করবেন না? আমরাই বা তাঁর সঙ্গে কেন কাঁদব না? আফসানাতো আমারও সন্তান হতে পারত। হতে পারত আমার বোন! তাহলে আমি, আমরা কেন নীরব থাকব?
কিন্তু আমরা এমন মুহূর্তেও এই নরপিশাচের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে উত্তাল না হয়ে নিজেকে সংযত, সংহত, নিয়ন্ত্রিত রাখার চেষ্টা করছি। আমরা সমাজ থেকে তো এই শিক্ষাই পেয়েছি ! সেটাই যে বাঁধা গত! অনেকে বলবেন, প্রতিবাদ করে কী লাভ? তনুর ঘটনায় প্রতিবাদ তো আর কম হয়নি। তাতে ফল কী ফলেছে? আফসানার হত্যাকারীরাও তো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের পরিচয়ে পরিচিত। তাদের ঘাঁটাতে কী পুলিশ সাহস পাবে? ক্ষমতার উচ্চমহল কী তা হতে দেবে? তারপরও বলি, মানি না। মানব না। বেশ করব ক্ষমতাসীনদের দোষারোপ করব, বেশ করব হেরে যাব। অমন মর্মান্তিক বেদনাদায়ক ঘটনার পরও কেন চুপ থাকব? কেন নিজের বিবেক-অনুভূতিকে ঠকিয়ে মিথ্যাচার করব যে, ঠিকই তো আছি? ঠিক তো নেই! ঠিক থাকার কথাও তো নয়!
আফসানার মাকে কেন আমরা শক্ত হওয়ার পরামর্শ দেব? ‘বাস্তব’কে মেনে নিতে বলব? এ কোন বাস্তব? কারা এই বাস্তব সৃষ্টি করেছে? কাদের প্রশ্রয়ে? কেন তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে আমরা চিৎকার করে গলা ফাটাব না? তিনিই বা কেন এই যন্ত্রণা নিয়ে চুপ থাকবেন? স্বাভাবিক থাকবেন? স্বাভাবিক থাকার দায় কীসের? না, তিনি খাবেন না, চুল বাঁধবেন না, সকাল-সন্ধে চোখের জল ফেলে কাটাবেন। তার পর যদি কোনো দিন মনে হয়, সে দিন উঠে ডাইনিং টেবিলে বসে খাবেন, আয়নার সামনে চুল বাঁধবেন। যে কষ্ট, যে শূন্যতা নিয়ে জীবনকে মুটের মতো বহন করতে হবে, সেই যন্ত্রণার জীবনটাকে দমবন্ধ করেই কাটাবেন, না কি ফুলের সুঘ্রাণ নিয়ে, সেটা কী অন্যে বলে দিতে পারে?
জীবনের এই আটপৌড়ে মূল্যবোধগুলো ভেঙ্গে দেওয়ার সময় এসেছে। নামতা মুখস্থ করার মতো শিখে এসেছি আমরা-শক্ত হতে হয়, জীবনের মোকাবিলা করতে হয়, আর হেরে গেলে তো বিলকুল চলে না। হেরে গেলে তো তুমি মানুষ হিসেবে অমনি একটু খাটো হয়ে গেলে, জীবনটায় কোথায় একটা খামতি হয়ে গেল, মানুষ হওয়ার মাপকাঠিটা ছোঁওয়া গেল না। দুর্বল হওয়া, দুর্বল হয়ে থাকা একটা মস্ত দোষ। তাই আমরা দুর্বলকে ছোট করে দেখি। ওহে, তুমি দুর্বল, জীবনের উপযুক্ত নও। তুমি লাইন থেকে সরে দাঁড়াও। উপযুক্ত হওয়ার শর্তগুলো তুমি পালন করতে পারোনি। আফসানাও দুর্বল ছিল। কারণ সে মেয়ে। মেয়েরা তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে দুর্বলই! ‘দুর্বল’ হয়েও আফসানা না বলার সাহস দেখিয়েছিল। আর তাতেই সমাজের তালভঙ্গ ঘটে গেল। গায়ের জোরে এক নপুংসক মন দখল করতে চাইল। শেষ পর্যন্ত জীবনটাকে কেড়ে নিয়ে ‘নিয়মভাঙ্গা সাহসী মেয়ে’কে শিক্ষা দিতে চাইল!
আমরা কারও ভালোমন্দ, ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে মূল্য দিই না। যে যেখানে পারি নিজের আকাঙ্ক্ষা ও পছন্দটাকে চাপিয়ে দিই। আর এখানে ব্যর্থ হলে বাধাপ্রাপ্ত হলে চরম প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে যাই। আরেক দিকে আমরা শোকগ্রস্ত বিষন্ন মানুষকে তার নিজের মত করে থাকার ক্ষেত্রেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করি। আরোপ করি নানা মিথ্যে সান্ত্বনাবাক্য। মনকে আমরা মিথ্যে স্তোক দিই যে, হ্যাঁ, আমিও জীবনের সমস্ত নির্মম সত্যকে গ্রহণ করেছি। সবাই সত্যিই পারি কি? সত্যকে এড়াতে পারিনি তাই বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছি, আর সত্যকে গ্রহণ করেছি— এ দুইয়ের মধ্যে আকাশপাতাল তফাত। যে জোছনা প্রিয়জন থাকার সময় সবচেয়ে ভালো লাগত, প্রিয়জন চলে যাওয়ার পর সেই জোছনাই আমাকে গিলতে আসে। ভয়ঙ্কর খারাপ লাগে তাকে। সেই জোছনায় যদি মাধুর্য খুঁজে নিতে না পারি, তা হলে সেটা আমার দোষ নয়, আমার দুর্বলতা নয়, আমার গঠন। বিষাদ, কান্না, ভালো না লাগা, ভালো না থাকা- আমার চয়েস।
মৃত্যু সতত আকস্মিক। কিন্তু যে মৃত্যুর পিছনে অন্যায় থাকে, তার বেদনায় মিশে যায় অপরিমেয় বিশ্বাসঘাতকতা। সেই যন্ত্রণা ভুলে যাওয়া কঠিন। নিজেদের কামনা-বাসনা-লালসা চরিতার্থ করার জন্য কিছু কুলাঙ্গার মেয়েদের উপর জুলুম-নির্যাতন চালাবে, কিছু করতে না পেরে একটা ছটফটে সম্ভাবনাময় জীবন মুহূর্তে নেই হয়ে যাবে, এটা ভোলা সহজ নয়। কিছু নরাধম একের পর এক অন্যায়-পাপ করেই যাবে আর আমরা ভুলে যাব? চুপ থাকব? ‘অপরাধীরা রাঘববোয়াল’ বলে নীরব থাকব?
সব অপরাধ, অন্যায় চুপচাপ মেনে নেবার মত এমন ‘অতিমানব’ আমরা হতে চাই না। বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মত অমানবিক নির্লজ্জও হতে চাই না। প্রতিবাদ করতে চাই, প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে চাই। যাঁদের প্রতি এই অন্যায় হয়েছে, তাঁরা বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে কষ্টকে পাশ কাটিয়ে দিব্যি জীবন কাটাবেন, এটা হয় না। হতে পারে না।
আর যদি হয়ও, তা হলে এক দিক থেকে সেই অন্যায়গুলোকে প্রশ্রয়ই তো দেওয়া হয়। যে অন্যায়ের জন্য এক জনের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়, তার যন্ত্রণাকে মেনে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে ওই অন্যায়কেই তো মেনে নেওয়া হয়। আফসানা কিংবা তনুর মা যদি চোখের জল মুছে রোজকার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে না যান, ফিরে যেতে না পারেন, তারা যদি তাদের মেয়ের উপর সংঘটিত ভয়ঙ্কর অন্যায়কে না মানেন, সেই মেনে না নেওয়ার মধ্যে একটা তীব্র প্রতিবাদ, একটা নীরব চিৎকার থাকবে। থেকে যাবে।
যা থেকে আমরাও আমাদের ভূমিকা, অবস্থান ও কর্তব্যগুলো চিনে নিতে পারব। বুঝতে শিখব। আর যারা নীরব ভূমিকা পালন করছে, অপরাধীদের রক্ষা করছে, ইচ্ছে করে ধরছে না, তাদেরও চিনতে পারব।
আফসানা-তনুর মায়েরা কাঁদুন, তাঁদের অন্তত কাঁদতে দেওয়া হোক, হাহাকার করতে দেওয়া হোক। এতে যদি আমাদের পাষাণ হৃদয় একটু গলে! আমরা একটু প্রতিবাদী হই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও শাসক দলের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে তাতে যদি একটু ন্যায় ও মানবতাবোধ জাগে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)