শক্তিশালী ভূমিকম্প ও পুনঃকম্পনে বিধ্বস্ত নেপালের ভীত-সন্তস্ত্র অধিবাসিদের অনেকের মুখেই হাসি এনে দিতে পারে, সম্প্রতি এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে।
সম্প্রতি নেপালের সরকার ভূমিকম্প-আঘাত হানা দেশটির পুনর্গঠনে একটি আন্তর্জাতিক সভার আয়োজন করেছিলো। দেশটির জন্য সাহায্য সংগ্রহের বিবেচনায় সভাটিকে অত্যন্ত সফল বলা যায়। চলতি বছরে এপ্রিল মাসের ২৫ এবং মে’র ১২ তারিখের আঘাত হানা ভূমিকম্পে দেশটি প্রায় ৯ হাজার মানুষের মৃত্যু এবং ৫ লাখেরও বেশি ঘরবাড়ি এবং কাঠামোর ধ্বংসের মর্মান্তিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। ভূমিকম্পের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ জেলাগুলোর পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ডের অভাবে ধুঁকতে থাকা দেশটির সরকার আন্তর্জাতিক সহায়তার ডাক দিয়েছিলো এবং ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ওন নেপাল রিকন্সট্রাকশন ( আইসিএনআর) নামে একটি সভার আয়োজন করেছিলো, যা ইতিবাচক ফলাফল বয়ে এনেছে। জুনের ২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়া এ সভায় ৫০ টি দেশ এবং সাহায্য ও উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধির অংশগ্রহনের বিবেচনায়ও সভাটিকে সফল হিসেবে গণ্য করা যায়।
মূল্যায়ন অনুযায়ী, পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসনের কার্যক্রমের জন্য দেশটির সরকারের প্রায় ৬.৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থ প্রয়োজন। যা দেশটির গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) এর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। সরকারের প্রত্যাশা ছিলো আইসিএনআর এর মাধ্যমে তারা প্রয়োজনীয় অর্থের অর্ধেক সংগ্রহ করতে পারবে। কিন্তু প্রত্যাশার সীমা অতিক্রম করে আইসিএনআর’এর মাধ্যমে বন্ধুরাষ্ট্র এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে দেশটি ৪.৪ বিলিয়ন ইউএস ডলায় অর্থ সহায়তা প্রাপ্তির অঙ্গীকার অর্জন করতে সক্ষম হয়। যা মূল্যায়নকৃত ফান্ডের দুই-তৃতীয়াংশ।
আসলে দেশটির সাধারন মানুষের সাথে সরকারেরও এতোটা প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছিলো না। সর্বমোট অর্থসহায়তা ৪.৪ বিলিয়ন ইউএস ডলারের মধ্যে প্রায় ২.২ বিলিয়ন ইউএস ডলার অনুদান এবং রেয়াতি ঋণ হিসেবে দেয়া হবে।
মৃত্যু এবং ধ্বংসের ব্যাপকতা দেশটির বন্ধুরাষ্ট্র, প্রতিবেশি এবং উন্নয়ন সহযোগীদের এতোটাই নাড়া দিয়েছে যে তারা সরকারের পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসন প্রকল্পে প্রত্যাশিত ফান্ডেরও বেশি অর্থ সহায়তা অনুদান এবং সফট লোন হিসেবে দেয়ার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে।
বিষয়টি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী যে নেপালের নিকটতম দুই প্রতিবেশী ও বিশ্বের উদীয়মান দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারত এবং চিন ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত নেপালকে সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে অর্থের হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করছে। যেখানে ভারত সর্বোচ্চ ১ বিলিয়ন ইউএস ডলার প্রদানের অঙ্গীকার করেছে। যার মধ্যে ২৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার অনুদান হিসেবে এবং ৭৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার সফট লোট হিসেবে প্রদান করবে ভারত। অনুদানের হিসেবে চীন সর্বোচ্চ ৪৮৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার তার দক্ষিণের প্রতিবেশীকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
অন্যান্য দেশ এবং উন্নয়ন সহযোগীরাও অনুদান এবং সফট লোন প্রদানের ক্ষেত্রে ঔদার্যের পরিচয় দিয়েছে। অন্যান্য প্রধান প্রধান সাহায্য এসেছে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) যারা ৬০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার প্রদানের অঙ্গীকার করেছে, বিশ্বব্যাংক ৫০০ মিলিয়ন, জাপান ২৬০ মিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ১৩০ মিলিয়ন এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ১১২ মিলিয়ন ইউএস ডলার প্রদানের অঙ্গীকার করেছে।
ফান্ড সংগ্রহ সম্পন্ন হলে সহায়তা প্রদানকারী দেশগুলোর সরকার এবং এর প্রতিনিধিরা গৃহীত পুনর্গঠন এবং দেশজুড়ে ভূমিকম্প আক্রান্তদের সহায়তার কার্যক্রমকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। নেপাল সরকারের মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, আমলা, সংস্থাগুলো অর্থ সাহায্যের অঙ্গীকারাবদ্ধ দেশ ও সংস্থাগুলোর নজরে থাকবে। নেপালের সরকার অর্থ সহায়তা প্রাপ্তি শুরু করলে এবং অঙ্গীকৃত প্রকল্পগুলোতে তা খরচের সময় দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতার প্রশ্নটি সামনে চলে আসবে।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী সভায় তার বক্তব্যে নিজেই দায়বদ্ধতার বিষয়টি প্রথম তুলে ধরেছেন এবং সংগৃহিত ফান্ড ন্যায্যভাবে খরচ করার অঙ্গীকার করেছেন। কেউ নিজের দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হলে এবং ফান্ডের অপব্যবহারে লিপ্ত হলে বিচারের সম্মুখিন হতে হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
তবে দুর্নীতির জন্য কুখ্যাত একটি দেশের জন্য অঙ্গীকৃত সহায়তার যথাযথ ব্যবহার একটি বিশাল দায়িত্ব। এরজন্য পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত সকল বিভাগের উপর কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বিশেষত এমন একটি কঠোর সময়ে আইসিএনআর’এ অঙ্গীকৃত সহায়তার একটি পয়সাও যেনো জলে না যায় সে বিষয়ে নেপাল সরকারকে সচেতন থাকতে হবে। কেউ যাতে অর্থ আত্মসাৎ এবং অপব্যবহার করতে না পারে সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। প্রকল্প কাজের পর্যবেক্ষণে দায়িত্বপ্রাপ্ত কমকর্তা এবং সংস্থাগুলোর সকল সহায়তা যাতে পুনর্গঠন এবং পুনবার্সন কাজে যথাযথভাবে ব্যয় হয় সে বিষয়ে তীক্ষ্ণ নজরদারি রাখতে হবে। যদি এই প্রকল্পের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা হয় এটা অবশ্যই বন্ধুরাষ্ট্র এবং সাহায্য সংস্থাগুলোকে নেপালের ভবিষ্যত উন্নয়ন প্রকল্পে এগিয়ে আসার জন্য আরও আস্থাবান করে তুলবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)