ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উপ-কমিটি নিয়ে ক্ষোভের মুখে রয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এনিয়ে একাধিক দিন তিনি পদবঞ্চিত সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছেন। সংবাদমাধ্যমে খবরও বেরিয়েছে, যদিও তিনি এই বিক্ষোভকে ‘আনন্দ মিছিল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। সাধারণ সম্পাদকের আখ্যা দেওয়া ‘আনন্দ মিছিলে’ দ্বিতীয়বার মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি কথিত আনন্দ প্রকাশকারীদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের বিভিন্ন উপকমিটির সহসম্পাদক পদ দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে প্রথমবারের মতো দলের গঠনতন্ত্রে এ পদ সৃষ্টি করা হয়। প্রথমবার ১৯ উপ-কমিটির বিপরীতে ৯৫ সহ-সম্পাদক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ২০০৯-এর কাউন্সিলের পর সহসম্পাদক পদে কাউকে দেওয়া নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ২০১২ সালেরে কাউন্সিলের পর প্রথমে ৬৬ জনকে সহসম্পাদক করা হয়। পরে আরও নিযুক্ত হন ৮৩ জন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সাবেক ছাত্রনেতাদের মধ্য থেকে প্রথম দফায় ২৫০ জন ও পরে আরও ৩১৮ জনকে মনোনীত করা হয়, গঠনতন্ত্রে ৫ জন সহ-সম্পাদক থাকার বিধান লঙ্ঘন করেই।
২০১৬ সালে সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর এক বছরের বেশি পার হলেও দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও সহ-সম্পাদকদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে সম্প্রতি ফেসবুকে উপকমিটির সহ-সম্পাদকদের একটি তালিকা ঘুরছে, যা নিয়ে বিক্ষুব্ধ সেখানে নাম না থাকা সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা। ফেসবুকে উপ-কমিটির তালিকা প্রকাশ হলে মূলত সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফেসবুকে প্রচার হওয়া ওই তালিকায় সাক্ষর ছিল আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপের।
আব্দুস সোবহান গোলাপ অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ নন, গঠনতন্ত্রের ২৫(১)(ক) অনুযায়ি কমিটির অনুমোদন দেবেন দলীয় প্রধান বা সভাপতি। প্রকাশ হওয়া উপকমিটির দুইটি বাদে সকল কমিটির সদস্যদের নিচে রয়েছে দপ্তর সম্পাদকের সাক্ষর, বাকি দুটোতে রয়েছে সাধারণ সম্পাদকের সাক্ষর। ফেসবুকে ওই তালিকা প্রকাশ হলে পদবঞ্চিতরা ক্ষুব্ধ হন, ক্ষোভের প্রকাশ ঘটান সাধারণ সম্পাদকের উদ্দেশে। অভিযোগ ওঠেছে সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা পদবঞ্চিত হয়েছেন এবং পদ পেয়েছেন বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের অনেকেই।
২০০২ সালের আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে প্রথমবারের মতো দলের গঠনতন্ত্রে এ পদ সৃষ্টি করা হয়। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ২৫(১)(চ) ‘বিভাগীয় উপ-কমিটি গঠন’ অংশে বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রত্যেক সম্পাদকীয় বিভাগের কার্যক্রম অধিকতর গতিশীল ও সমন্বিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি সম্পাদকীয় বিভাগে একটি করিয়া উপকমিটি গঠন করিবে। উক্ত উপকমিটি একজন চেয়ারম্যান, একজন সম্পাদক, অনুর্ধ পাঁচজন সহসম্পাদক, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ সদস্য, সংশ্লিষ্ট সহযোগি সংগঠন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হইবে। জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সদস্যবৃন্দ, যাহারা বিভিন্ন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, তাহারা পদাধিকার বলে সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত উপ-কমিটির সদস্য হইবেন। সংগঠনের সভাপতি কর্তৃক উপ-কমিটির সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হইবে, এবং তিনি উপকমিটিসমূহ গঠন করিয়া দিবেন। সভাপতি সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলী, উপদেষ্টা পরিষদ এবং কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যদের মধ্য হইতে উপকমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত করিবেন। সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সম্পাদক সংশ্লিষ্ট উপ-কমিটির সদস্য সচিব হবেন। উপ-কমিটিসমূহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কার্যক্রম জোরদার করার কাজে সহায়তা করিবে। প্রত্যেক বিভাগ উহার কর্মকাণ্ড সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ, সরবরাহ ও সংরক্ষণ করিবে এবং সময়ে সময়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করিবে। প্রতি তিন মাসে অন্তত একবার উপ-কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হইবে। সভায় স্ব-স্ব উপ-কমিটি তাহাদের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন ও করণীয় নির্ধারণ করিবে।’ [তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র, পৃষ্ঠা ১১১-১১২]
বিভাগীয় উপ-কমিটি নিয়ে সংক্ষুব্ধ সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এনিয়েও সমালোচনা চলছে। পদবঞ্চিতদের ক্ষোভের মুখে পড়েছেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি জানিয়েছেন, সমস্যার মূল কারণ যাদের উপ-কমিটিগুলো চূড়ান্ত হয়নি, সেই সম্পাদকদের কাছে অফিস সেক্রেটারির স্বাক্ষরে খসড়া কমিটি পাঠানো হয়েছিল। সেটি ফেসবুকে প্রচার হওয়ার কারণে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলছেন, কমিটি চূড়ান্ত হলে সভাপতি তাতে সায় দিলে তারপর সেখানে তার (কাদের) সই নেওয়া হবে। সেই কমিটির আদেশ তখন সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হবে। … এটা আমাদের নিয়ম। এ নিয়ম নিয়ে ভুল বোঝাবোঝি আছে। আমি এক মাস আগে বলেছি, সব উপ কমিটিতে সবাই সদস্য থাকবে।
পদবঞ্চিত সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ বিএনপি ও জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে আসা অনেকেই স্থান পেয়েছে প্রচার হওয়া উপ-কমিটিগুলোতে। এনিয়ে ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে তিনি তিন মাস সময় নিয়েছেন। এই সময়ের জন্যেও কমিটি বাতিল বলেও বলেন নি তিনি, বলেছেন স্থগিতের কথা।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ি বিভাগীয় উপ-কমিটিগুলো প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তত একবার সভায় মিলিত হবে, কিন্তু আগেকার কোন কমিটিই এমন কিছু করেনি। ফলে কার্যত এ কমিটিগুলো প্যাড কিংবা ব্যানার সর্বস্ব। তবু এনিয়ে লঙ্কাকাণ্ড বাধার অপেক্ষায়।
দলের অভ্যন্তরীণ কোন কমিটি নিয়ে এরআগে আওয়ামী লীগের মধ্যে এমন প্রতিবাদ চোখে পড়েনি, কিংবা এটা নিয়ে কোন সাধারণ সম্পাদককেই আলাদা করে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। এবার পড়ল; এবং সেটা বিক্ষোভকে ‘আনন্দ মিছিল’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ারও নজির সৃষ্টি হলো। এঘটনা যখন ঘটল আওয়ামী লীগে তখন কিন্তু নির্বাচনের বছর শুরু হয়ে গেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এবছরের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সহ সকল দলই ভেতরে ভেতরে সে প্রস্তুতিও নিচ্ছে। মন্ত্রীসভার সদস্য সহ সরকার দলীয় সকল এমপিদের মুখেও নির্বাচনি আমেজ। নির্বাচন কমিশনও নিচ্ছে প্রস্তুতি। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি জানালেও তারাও নিচ্ছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে এমন হযবরল অবস্থা নিঃসন্দেহে দলটির জন্যে উদ্বেগের।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলছেন দপ্তর সম্পাদকের স্বাক্ষরিত কমিটিগুলো প্রস্তাবিত, চূড়ান্ত নয়। প্রস্তাবিত কমিটি কিংবা যেকোনো প্রস্তাব দলের গোপনীয় বিষয়। এক্ষেত্রে এমন গোপনীয় বিষয়গুলো কীভাবে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে গেল এনিয়ে ভাবছে না দলটি। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের গোপনীয় প্রস্তাবনা যদি যাচাইবাছাই ও অনুমোদনের আগে এভাবে পাবলিক হয়ে যায় তাহলে দলের মধ্যকার গোপনীয়তার অংশটুকু থাকলইবা কোথায়? দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের এমন অবস্থা দায়িত্বশীলদের সাংগঠনিক দুর্বলতার প্রকাশ কি নয়?
আশঙ্কা করি, এনিয়ে ভাবান্তর নেই দলটির। অথচ সেটার দরকার ছিল। নির্বাচনের বছরে দলের কেন্দ্রে থাকা দায়িত্বশীলরা যদি দায়িত্ব ভুলে যান তবে এর প্রভাব তৃণমূলে পড়তে বাধ্য। প্রভাব পড়তে বাধ্য নির্বাচনি কৌশলেও।
পদবঞ্চিতরা ক্ষুব্ধ পদ না পেয়ে। সাধারণ সম্পাদক ব্যস্ত মিডিয়া সামলাতে, তা যে করেই হোক। বিক্ষোভকে আনন্দ হিসেবে দেখাতে মরিয়া তিনি। পদবঞ্চিতদের অবস্থা ও সাধারণ সম্পাদকের এমন অবস্থার বিপরিতে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা অগণন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিব্রত। এই বিব্রত ভাব যতদিন থাকবে দলটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও সে প্রভাব পড়বে।
নয় বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনেও জয়ের আশা করছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন দলটি সাংগঠনিকভাবে যতখানি শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল ততখানি হয়নি। দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড অধিকাংশ জায়গায়ই দলের কিছু নেতা ও মন্ত্রী-এমপিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। যে আওয়ামী লীগের শক্তি ছিল তৃণমূল সে আওয়ামী লীগই তৃণমূলে বিভক্ত; এবার যোগ হয়েছে কেন্দ্রের দুর্বলতা, এবং সেটা পদবঞ্চিতদের পদ-হাহাকার সৃষ্ট। দলীয় সাধারণ সম্পাদকও পারেন নি সহসা এর সমাধান দিতে।
বিএনপি-জামায়াতের লোকজন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে বড় আওয়ামী লীগার হয়ে গেছে বলে অনেক জায়গায় অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগগুলো এবার কেন্দ্র পর্যন্ত পৌছাল কেন্দ্রিয় নেতার প্রস্তাবিত কমিটিতে বিএনপি-জামায়াত অন্তর্ভুক্তির অভিযোগের কারণে।
আওয়ামী লীগ কীভাবে এর মোকাবেলা করে সেটাই দেখার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)