ইসলাম ধর্মের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুসঙ্গ আধ্যাত্মিকতা। শরীয়তের পরেই এর অবস্থান। এ জন্য ওলামায়ে কিরাম এটিকে সবসময় তাগাদার দৃষ্টিতে দেখেছেন। এর অপর নাম তাসাউফ কিংবা সুফিবাদ এবং কোথাও কোথাও যুহুদও বলা হয়ে থাকে। যুগের আবর্তনে বিভিন্ন নামে এটি পরিচিত হলেও নববী যুগে তা ‘তাযকিয়া’ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল।
তাযকিয়া শব্দের অর্থ আত্মার পরিশুদ্ধি। নফসে আম্মারা বা পাপ প্রবণ আত্মাকে পরিশোধন করে নফসে মুতমায়িন্না তথা প্রশান্ত হৃদয়ে পরিণত করতেই এই প্রচেষ্টা। এটিই সৃষ্টি জগতের কাছে নবী প্রেরণেরও অন্যতম উদ্দেশ্য। যেসকল নফস বা আত্মার খোদার আনুগত্য থেকে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেগুলোকে ইবাদতে আকৃষ্ট ও প্রশান্ত হৃদয়ে পরিণত করাই আত্মার পরিশুদ্ধি। আর পরিশুদ্ধ সেই আত্মা নিয়ে স্রষ্টার আনুগত্যে নিজেকে উৎসর্গ করাকে আমরা আধ্যাত্মিকতা বলে চিহ্নিত করে থাকি। সকল ইবাদতেই আধ্যাত্মিকতা চর্চার সুযোগ রয়েছে। তবে অনন্য একটি উপায় হলো সিয়াম সাধনা। এতে রয়েছে স্রষ্টাপ্রেমে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে পরকালের মহান পুরস্কার লাভের হাতছানি। সিয়াম বা রোজার প্রতিদান সীমাহীন। সিয়াম পালনে অমূল্য পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি, স্বয়ং অসীম স্রষ্টাই দিয়েছেন। এ সম্পর্কে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তায়ালা বলেন, বনী আদমের প্রত্যেক আমলের (নির্ধারিত সওয়াব) রয়েছে, কেবল রোজা ছাড়া। এটা আমার জন্য; আর আমিই এর প্রতিদান দেব” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)।
সিয়াম সাধনায় যে কষ্ট বান্দাকে পোহাতে হয়, তাও কিন্তু আধ্যাত্মিকতারই অপরিহার্য অংশ। আধ্যাত্মিকতার প্রাচীন পরিভাষা যুহুদ, অর্থাৎ ত্যাগ করা। পৃথিবীর মোহ-মায়া ত্যাগ করেই নবী-ওলীগণ হৃদয়ের প্রশান্তি লাভ করেছেন। দুনিয়া থেকে বিমুখ হয়ে তাদের সবাই অনন্য হয়েছেন। খাবারের সামর্থ্য ও পর্যাপ্ততা থাকা সত্ত্বেও কখনো সেই খাবার নিজে না খেয়ে অন্যের মুখে তুলে দিয়েছেন; হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ (রহ:) ও আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত সকল বান্দাই ছিলেন এই আদর্শের লালনকারী। বাকশক্তি থাকা সত্ত্বেও মুখে তালা দিয়ে রাখতেন তারা নিয়মিত। সুন্নতে রাসুলই ছিল তাদের সার্বক্ষণিক ভূষণ। এ ধরণের ব্যক্তির সহচর্য লাভ করাও অত্যন্ত ভাগ্যের ও বরকতের, তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এই দুটি বৈশিষ্ট্য ধারণে উৎসাহ প্রদান করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, “দুনিয়া থেকে বিমুখতা ও কম বলার অভ্যাস যাকে দেওয়া হয়েছে, তোমরা এমন ব্যক্তির নৈকট্য অর্জন কর। কেননা তার প্রতি প্রজ্ঞা নাযিল হয়” (সুনানে ইবনে মাজাহ ও বায়হাকী)।
অধিক কথা-বার্তায় নিরুৎসাহিত করার মূল কারণ হলো এতে অনেকসময় কথার ছলে মুখ দিয়ে নানান প্রকারের মন্দ কথা বেরিয়ে আসে। অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও তা আমাদের গুনাহের অন্যতম কারণ এবং আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনের প্রধান অন্তরায়। এ থেকে বিরত থাকা ব্যতীত আধ্যাত্মিকতা চর্চার অন্য কোন উপায় খোলা নেই। এটি প্রমাণিত সত্য যে, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। আর সেদিকেই গুরুত্বারূপ করে সিয়াম সাধনা। নিরর্থক কথা-বার্তা থেকে বিরত রাখতে শেখায় রোজা। তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি মন্দ কথা ও কাজ পরিহার করবে না, আল্লাহর জন্য খানা-পিনা ছেড়ে দেওয়া তার প্রয়োজন নেই” (সহীহ বুখারী)।
অত্যধিক খাবার গ্রহণে অনেক সময় বান্দার রুহ মারা যায় এবং নফসের শাসন চালু হয় দেহরাজ্যে। শরীরে বাসা বাঁধে অলসতা, একগুঁয়েমি নামের যত্রতত্র বদ-স্বভাব; যার ফলে অনীহা তৈরি হয় ইবাদত পালনে। শরীর ও মন দুটোই মশগুল হয়ে পড়ে নানান পাপাচারে। আর তাতেই বাঁধাগ্রস্ত হয় আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন। এক্ষেত্রে সিয়াম সাধনার ভূমিকা অপরিসীম। খানা-পিনা থেকে বিরতির কারণে একজন রোজাদারের পক্ষে পুরো রমজান মাস শরীর ফিট রেখে ইবাদত, রিয়াজত করা সম্ভব হয়।
আবার অনেকসময় দেখা যায়, আমরা যৌবনের তাড়নায় কুপ্রবৃত্তির শিকার হই। মানুষ হিসেবে আমাদেরও একটা জৈবিক চাহিদা রয়েছে। যার ফলে, বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানো একটা বয়স অতিক্রমণ করেই আবশ্যক হয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব তরুণ বিবাহের নির্দিষ্ট সময়কাল অতিবাহিত করেও বিয়ে করে না, অবৈধ সম্পর্কে তারাই বেশী লিপ্ত হয়। শয়তানী অপশক্তি তাদেরকে প্ররোচনার জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে ফেলে। এমতাবস্থায় আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের টনিক গড়ে দেয় সিয়াম সাধনা। এইজন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যার সামর্থ্য রয়েছে, সে যেন বিবাহ করে। কেননা এটা দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করে। আর সামর্থ্য যার নেই, সে যেন রোজা রাখে। নিশ্চয় তার জন্য সেটিই হবে ঢালস্বরূপ” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। অপর বর্ণনায় এসেছে, রাসুলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “রোজা ঢালস্বরূপ, এর মাধ্যমে বান্দা জাহান্নাম থেকে রক্ষা পায়” (মুসনাদে আহমদ)।
আধ্যাত্মিক স্তর ও ব্যক্তি বিশেষে একেক বান্দার রোজা একেক ধাপের হয়ে থাকে। তাক্বওয়া যার যতটুকু, তার রোজা ঐ পর্যায়ের। ইমাম গাজালী (রহ.) একে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, রোজা তিন প্রকার: (ক) সাধারণ লোকের রোজা। তা হলো উদর ও লজ্জাস্থানকে কুপ্রবৃত্তি হতে বিরত রাখা। (খ) বিশেষ লোকের রোজা। তা হলো সকল প্রকার গুনাহ থেকে শরীরকে মুক্ত রাখা। (গ) সর্বোচ্চ স্তরের লোকের রোজা। তা হলো আল্লাহ ছাড়া সবকিছু হতে নিজেকে মুক্ত রাখা (ইহয়ায়ে উলুমিদ্দীন)।
সুপ্রিয় পাঠক এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক তৈরিই রোজার উদ্দেশ্য। এক ও অভিন্ন লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে আধ্যাত্মিকতা। আধ্যাত্মিকতা চর্চার সহজ উপায় বেশি বেশি রোজা রাখা; হোক তা রমজান, কিংবা রমজানের বাইরে। চেষ্টা করলে প্রবৃত্তি দমনের সেই শক্তি অর্জন করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব নয়। যেহেতু রোজার মধ্যেই তা লুকিয়ে আছে। তাই রমজান মাসের ত্রিশটি রোজা যথাযথ পালন করলেই আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণের মত হয়ত আমরাও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম হব।