একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সুযোগ-সন্ধানের রাজনীতি ফের আলোচনায় এসেছে। দীর্ঘদিনের অনুশীলিত রাজনৈতিক আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে নানা নামে জোট গঠন, জোট সম্প্রসারণ ও জোটে যোগদানের পর এবার দলবদলের খেলার পাঠেরও সূচনা কিংবা সম্পন্ন হয়েছে। এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একই সঙ্গে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কার ঠিকানা কোথায় হয় এনিয়েও আগ্রহ জন্মাচ্ছে। রাজনীতিতে এই ধারা বড় পরিসরে ফিরে আসায় সুযোগসন্ধানী নেতাদের মুখগুলোও পরিস্কার হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে শরিক দল হিসেবে বিএনপির যোগদানের পর থেকেই এই বিষয়টি ক্রমে পরিস্কার হয়ে ওঠছে। প্রথমে বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে কোণঠাসা থাকলেও আস্তে আস্তে সমগ্র কর্তৃত্ব নিজেদের অনুকূলে নিয়ে নেয়। এটা মূলত সম্ভব হয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকেই। ছোট দলের বড় নেতা হিসেবে ড. কামাল হোসেন প্রথমদিকে ঐক্যফ্রন্টে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও ক্রমে সে প্রভাব খর্ব হয়ে যায়। বড় দল হিসেবে বিএনপির হাতে ঐক্যফ্রন্টের নাটাই চলে যায়। এর শুরুটা হয় মনোনয়ন পর্ব থেকেই। এখন ঐক্যফ্রন্টের বড় দল হিসেবে বিএনপির দিকেই মুখাপেক্ষী থাকতে হচ্ছে ড. কামাল হোসেন, সুলতান মনসুর, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ স ম রব, কাদের সিদ্দিকীদের।
অথচ সরকারবিরোধী এই জোটের শুরুটা এভাবে ছিল না। ড. কামাল হোসেন, সুলতান মনসুরেরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের কথা বলছিলেন। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে সরে গেছে এমন অভিযোগও করছিলেন তারা। প্রকাশ্য জনসভায় ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন সুলতান মনসুর।
বলছিলেন, ‘মুজিব কোট’ পরে তিনি নির্বাচন করবেন। কামাল-মনসুর-সিদ্দিকীদের এই বুলিগুলো যে ফাঁপা ও লোকদেখানো বুলি ছিল সেটা প্রমাণে বেশিদিন লাগেনি। আস্তে আস্তে তারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় থেকে সরেছেন, ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান আর মনসুরের মুখে আগের মত ওঠে না,এখন জয় বাংলার সঙ্গে ‘জয় ধানের ছড়া’ও (প্রকৃত অর্থে ধানের শীষ হবে) বলছেন সুলতান মনসুর।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কর্তৃত্ব বিএনপির হাতে চলে যাওয়ার পর থেকেই তাদের এমন পরিবর্তন। এখন অপেক্ষা করতে হচ্ছে কখন সামরিক শাসক জিয়াকে ‘শহীদ জিয়া’, ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলে দাবি করেন কামাল-সুলতান-সিদ্দিকীরা।
ড. কামাল হোসেন, সুলতান মনসুর, কাদের সিদ্দিকীদের এই বিচ্যুতিকে ক্ষমতার লোভের কারণেই ঘটেছে। তাদের সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক চরিত্রের প্রকৃত স্বরূপ ফুটে ওঠেছে এসবের মাধ্যমে।
রাজনৈতিক জীবনের বিকাশলাভ যে আদর্শের মাধ্যমে হয়েছিল তাদের, সে আদর্শ কিংবা ঠিকানাছাড়া হয়েছিলেন আগেই, তবে এবার ঠিক বিপরীত মেরুর রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে তারা যে উদাহরণ দৃষ্টি করেছেন তা স্মরণ করবে দেশ। এই স্মরণে একপক্ষ হয়ত তাদের ইতিবাচক ভাবে দেখবে কিন্তু আদর্শভিত্তিক বিশ্লেষকদের এটাকে ভালো চোখে দেখার কথা নয়।
ড. কামাল হোসেন যতদিন আওয়ামী লীগের কামাল ছিলেন ততদিন দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, সুলতান মনসুর কিংবা কাদের সিদ্দিকীর অবস্থাও একই, একই অবস্থা মাহমুদুর রহমান মান্নার।
আ স ম আব্দুর রব বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু দেশের রাজনীতি-ভোটের রাজনীতিতে তার নিজস্ব অবস্থান নাই। ছিয়ানব্বইয়ের আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালে তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন, এরপর আওয়ামী লীগের সুদৃষ্টি হারানোর পর থেকে তিনিও নামসর্বস্ব এক দল ও নেতা হয়ে ছিলেন অনেক দিন। আওয়ামী লীগ থেকে সরে যাওয়ার পর তাদের সকলেই রাজনীতিতে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ায় দলটির প্রতি তাদের ক্ষোভের শেষ নাই। এবং এই ক্ষোভ এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে দেশের ডানপন্থী রাজনীতির প্রধান শক্তি সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির সঙ্গে জোট করতে তাদের বাঁধে না।
দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত বেগম খালেদা জিয়া ও পলাতক তারেক রহমানের নেতৃত্বে আস্থাশীল দলটিকে ক্ষমতায় নিতে তাদের নানামুখী প্রচেষ্টার কমতি নেই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে তারা সম্পর্ক স্থাপনে আপত্তি করছে না।
এটা মূলত ক্ষমতার লোভ, সুযোগসন্ধানীর রাজনৈতিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ, একই সঙ্গে আদর্শিক দীনতার প্রকাশ। যা এতদিন অপ্রকাশ্য ছিল, কিন্তু একাদশ সংসদ নির্বাচন তাদের সেই চরিত্র সকলের সামনে পরিস্কার করে দিয়েছে।
কেবল কামাল-সুলতান-রব-মান্না-সিদ্দিকীই নয়, একই কথা প্রযোজ্য ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ক্ষেত্রেও। ডা. বি. চৌধুরী ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব। ছিলেন বিএনপির মনোনয়নে রাষ্ট্রপতিও। রাষ্ট্রপতি হয়ে যাওয়ায় পর বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করতে গিয়ে দলের বিরাগভাজন হন, এবং এক সময় আক্রান্ত হন, পদত্যাগ করতেও বাধ্য হন। বিএনপি ছাড়লেও এতদিন তিনি বিএনপির আদর্শ ছাড়েননি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক জোট সৃষ্টির উদ্যোগী ছিলেন।
আজকের যে সরকারবিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সেটার বুদ্ধিবৃত্তিক শুরুটা করেছিলেন বি. চৌধুরীই। যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া শেষে তাকে বাদ দিয়ে ফ্রন্ট সম্প্রসারণ হলে এখন তাকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে। এটা আরও এক সুযোগ-সন্ধানের রাজনীতির উদাহরণ।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরাম সহ সকলেই বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে বলে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে। এটা ড. কামাল হোসেন, সুলতান মনসুর, কাদের সিদ্দিকীদের জন্যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরাজয়। ‘ধানের শীষ’ প্রতীক ও দলের বিরুদ্ধে তাদের রাজনীতি ছিল জীবনভর, সংসদ-সংসদের বাইরে তারা দলটির বিরুদ্ধে বলে গেছেন সারাজীবন। কিন্তু শেষবেলায় এসে ক্ষমতার লোভ, আওয়ামী লীগ বিরোধিতা, এবং তারেক রহমানকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তারা মার্কা বদলের সঙ্গে সঙ্গে আদর্শও বদল করেছেন।
কেবল নেতাগোত্রীয়রাই নন, এরই মধ্যে রাজনীতিতে দলবদল-ডিগবাজির খেলা মধ্যগগনে। আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার পুত্র ড. রেজা কিবরিয়া গণফোরামে যোগ দিয়ে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন, ১০ সাবেক সেনাকর্মকর্তাও এদলে যোগ দিয়েছেন, তারাও নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী। গণফোরামে যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ গোলাম মাওলা রনি। ওদিকে আবার ডা. বি চৌধুরীর বিকল্পধারায় বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম, এমএম শাহীনসহ বিএনপি সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যসহ বেশ কজন যোগ দিয়েছেন। নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’ নিয়ে লড়তে চান। পুরো রাজনৈতিক জীবন তারা যে আদর্শে চালিত ছিল নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে সেটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে বিপরীত আদর্শের দিকে এই ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতাকে যে যেভাবেই আখ্যা দিক না কেন, এটা অন্তত শোভন নয়, আদর্শিক নয়ও।
নির্বাচন এসেছে। এই নির্বাচন কাগজেকলমে নৌকা-ধানের শীষ প্রতীকের মধ্যকার লড়াই শেষে বিজয়ী-বিজিত নিরূপণের হয়ত। তবে এর বাইরে এই নির্বাচন প্রতীকধারী এবং প্রতীক পেতে ইচ্ছুক মানুষগুলোর আদর্শ নিরূপণের মহামঞ্চও। সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিবিদদের চরিত্রকে আরও একবার তুলে ধরবে এই নির্বাচন, যার প্রাথমিক লক্ষণ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত; বাকি সময় এর গভীরতা প্রকাশের!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)