ঘুম থেকে ওঠার পরপর মনটা কাদামাটির মতো নরম থাকে। যে কোনো খবর তখন খুব বেশি প্রভাব ফেলে। যে কারণে আমি খবরের কাগজ এড়িয়ে চলি। কিন্তু ফেইসবুকের খবর এড়াবো কি করে? উত্তরাঞ্চলের বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পরিচিত, সাহসী, মানবতাবাদী অনেকেই যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন এর মোকাবেলার। তাঁদের প্রতি আমার অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ভালোবাসা আছে।
এর পাশে কয়েকদিন আগে একটি খবরে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। যেসব দুর্ঘটনা চাইলে এড়ানো যেতো সেগুলোর জন্য মনে হয় কষ্টের পরিমাণ বেশি হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। কার ওপর রাগ অথবা অভিমান করে এই কাজটি সে করেছে, তা জানা নেই। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বাবা, মা আর মেডিক্যাল কলেজে পাঠরত বড় বোনের কথা ভাবছি আমি। সেই বোনের বিয়ে কিছুদিন পরে।
আমার বাবা প্রায়ই বলেন, যে মরে গেছে সে তো মরে বেঁচেছে, আমাদেরকে বেঁচে থেকে মরতে হবে। আত্মহত্যাকে যারা সাহসিকতা বলে ভাবেন, তাদের সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করি। তীব্র আবেগ থেকে হঠকারী কিছু করে ফেলা কখনোই সাহসিকতা হতে পারে না। সাহস থাকলে আপনি প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে দেখান! অত্যাচারিত মানুষের পাশে দাঁড়ান! প্রাকৃতিকবিপর্যয়ে পতিত মানুষের জন্য কিছু করুন!
একজন মানুষকে ঘিরে পিতার যে স্বপ্ন, মাতার যে অপত্যস্নেহ, ভাই বোনের যে ভালোবাসা থাকে, আত্মহত্যা করে আপনি তাদের মানসিক, সামাজিক কোন অবস্থায় ফেলে দিচ্ছেন একটু ভেবে দেখুন তো!
“আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।” এই কথাতেই কি বেঁচে থাকা পরিজনেরা সামাজিক ভাবে বেঁচে যাবেন! সমাজের অদৃশ্য আঙুল কি পরিবারের অন্যান্য সদস্যের দিকে উদ্যত হবে না! লোকের জল্পনাকল্পনা আকাশ ছোঁবে বিভিন্ন কথায়। হয়তো মায়ের বকা, বাবার উদাসীনতা, ভাইয়ের ধমক, বোনের সাথে ঝগড়া, প্রেমিকের সাথে ব্রেকআপ এরকম কোনো কারণ এর পিছে থাকতে পারে। কিন্তু একটি মেয়ে আত্মহত্যা করলে মানুষ প্রথমেই আদিরস খুঁজবে। চরিত্র নিয়ে লাগবে টানাটানি! মানুষ খুঁজবে কার সাথে মেয়েটির শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল! ছেলেটি কি মেয়েটির “সর্বস্ব” নিয়েছিল! এই বোকা মেয়েগুলোকে কে বোঝাবে, কারো সাথে শারীরিক সম্পর্ক হওয়া মানেই সর্বস্ব চলে যাওয়া নয়! শারীরিক সম্পর্ক যদি নিজেদের ইচ্ছায় হয় সেখানে ছেলেটি আর মেয়েটির সমান সমান ভাগ থাকে। আর ধর্ষণ হলে লজ্জা হওয়া উচিত ধর্ষকের, ধর্ষিতার নয়!
আত্মহত্যাকারী হয়তো “আমার জীবন আমি নিজে শেষ করলাম”- এই ধরনের একটা দায়সারা চিন্তা করে থাকেন। হ্যাঁ, জীবনটা অবশ্যই আপনার, আপনি বেঁচে থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের জীবন নিজের মতো করে যাপন করুন। কিন্তু আত্মহত্যা করে আপনি পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে যে সারাজীবনের জন্য অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখে ফেলে যাচ্ছেন, সেটা কি ভেবে দেখেছেন? এটাকে সাহসিকতা নয়, স্বার্থপরতা বলে। আমি আর পারলামনা বলে আপনি কেটে পড়লেন! কিন্তু অন্যদের তো পারতে হবে! আপনি চলে যাওয়ার পর কানাঘুষা কোথায় গিয়ে ঠেকবে আপনি জানেন?
পোস্টমর্টেম তো শুধু আপনার মৃতদেহকে কাটাছেঁড়া করবে। সমাজের মানুষ আপনার চরিত্রের পোস্টমর্টেম করবে জঘন্যভাবে! অভিমানী ভালো মেয়ে হলেও আপনাকে বাজারের মেয়ে বানিয়ে ছাড়বে, আপনি সেক্সুয়ালি অ্যাক্টিভ না থাকলেও আপনাকে গর্ভবতী বানিয়ে বিকৃত উল্লাসে মাতবে।
হ্যাঁ, জানি, আপনি বলতেই পারেন, কে কী বললো তাতে আমার কী আসে যায়! অবশ্যই আপনার কিছু যাবে আসবে না। আপনি তো চলেই গেছেন! কিন্তু আপনার প্রিয়জনেরা যে আপনাকে হারানোর বেদনার সাথে সামাজিক এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন, তাদের কথা ভেবে হলেও আত্মহত্যা থেকে বিরত থাকুন। জীবন অনেক সুন্দর, কিছু উত্থান পতন দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। লড়াই করতে শিখুন, আত্মবিশ্বাসী হোন। এক রাস্তা বন্ধ হলে অন্য রাস্তা খুঁজে বের করুন। আত্মহত্যা একটি সমস্যা, সমস্যা কখনোই কোনো সমাধান হতে পারে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)