সোমবার (২১ অক্টোবর) চলচ্চিত্রকর্মীদের উপস্থিতিতে জমজমাট ছিল ‘চলচ্চিত্রকার মানজারেহাসীন মুরাদের সাথে সারাদিন’ শীর্ষক আয়োজনটি।
সারা দিনব্যাপী অনুষ্ঠান ‘চলচ্চিত্রকার মানজারে হাসীন মুরাদের সাথে সারাদিন’ শুরু হয় চলচ্চিত্র কর্মীদের একে একে ই. এম. কে সেন্টারে উপস্থিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা মানজারেহাসীন মুরাদ-কে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর মধ্য দিয়ে এক আনন্দমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ২১শে অক্টোবর, এ দিন ছিল নির্মাতা মানজারেহাসীন মুরাদ-এর জন্মদিনও। তাই শুভাকাঙ্খীরা অনেকেই তাঁকে উষ্ণ ও ফুলেল শুভেচ্ছা জানান দিনের অধিকাংশ সময়।
চলচ্চিত্র নির্মাতা মানজারেহাসীন মুরাদ-এর আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘ডকুমেন্টিং মি’ এর উদ্বোধন করেন সিনেমাটোগ্রাফার মাকসুদুল বারী। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি স্মৃতিচারণ করেন দু’জনের যৌথভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ অভিজ্ঞতার। তাঁর বক্তব্যে গ্রে স্কেলে আলোকচিত্র ধারণের মধ্য দিয়ে মানজারেহাসীন মুরাদ-এর তোলা আলোকচিত্রে যে দার্শনিক অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে সে কথাও উঠে আসে। এরপর উপস্থিত বিশেষ ব্যক্তিবর্গ নির্মাতা মানজারেহাসীন মুরাদ-এর সাথে ঘুরে দেখেন তাঁর আলোকচিত্র।
‘ঝলমলিয়া’ খ্যাত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকার সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন এ অনুষ্ঠানে। কানাডা প্রবাসী এ নির্মাতা বলেন- ‘দেশে ফেরার পর ফৌজিয়া খান-এর সাথে কথা বলছিলাম মুরাদ ভাইয়ের তোলা ছবিগুলো নিয়ে। বলছিলাম, দেখছেন কী দারুণ ছবি তুলছেন মুরাদ ভাই! সেই থেকেই এই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা।’
এরপর সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী সুতপা সাহা।
আত্মকথন-পর্বে উঠে আসে নানান বিষয়। চলে প্রশ্ন-উত্তর পর্বও। এ পর্ব সঞ্চালনা করেন চলচ্চিত্র গবেষক, সংগঠক ও লেখক মাহমুদুল হোসেন। চলে প্রশ্ন-উত্তর পর্বও। মানজারেহাসীন মুরাদ বলেন, প্রকৃতিকে অনুভব করার জন্য মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা খুব জরুরী। বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্র যে জনপ্রিয়তা পায়নি তার একমাত্র কারণ প্রামাণ্যচিত্র রিপ্রোডাকশন অব রিয়েলিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবতার রিপ্রোডাকশনের বাইরে এমন কিছু আমরা দেখিনি এখনো প্রামাণ্যচিত্রে যা আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে বাস্তবে অথচ প্রামাণ্যচিত্রে তা খুঁজে পেয়েছি। দর্শককে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
এই নির্মাতার ভাষ্য, কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। ধারাবাহিকভাবে সে কাজ এখনো হয়নি। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতাকে আমি শিল্পীই বলি। প্রশ্নটা যদি হয় সত্য অন্বেষণের তাহলে প্রতিটা শিল্পীরই একটা লক্ষ্য থাকে। আমি ক্যামেরা নিয়ে গেলেও সেই বাস্তবতা থাকবে, না নিয়ে গেলেও সেই বাস্তবতা থাকবে। বাস্তবতার ছবি তুলে যদি প্রামাণ্যচিত্রকার ভাবেন কাউকে ধন্য করছেন তাহলে তা ভুল। এই মনোভাব ভাঙতে হবে। এমনকি আমি মনে করি গাছের ছবি তুলতে গেলেও এক ধরণের প্রকাশভঙ্গি থাকা দরকার। আমার কিছু স্টিল ছবিতে আমি গাছের মধ্যে মানুষের অবয়ব খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছি। কারণ মানুষকেই আমরা সবচে বেশি জানি। বাকি যত প্রাণী বা পদার্থ তাদের আমরা পুরোটা জানি না, জানার অবকাশও নেই তেমন।
তিনি বলেন: মানুষ, যাকে আমি আমার ছবির মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছি তার একটা বাস্তবতা, ব্যক্তিত্ব, ইতিহাস, অতীত, বর্তমান আছে। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সময়ও সেই নির্মাতারও এক ধরণের যাত্রা এটা, এই নির্মাণ প্রক্রিয়া সেই জনগোষ্ঠী সেই মানুষকে জানা যাদের নিয়ে তিনি কাজ করছেন। আর দর্শকের ব্যাপারটা হচ্ছে, আমরা আসলে কোন দর্শককে বিবেচনা করি? আমরা একটা কথা ব্যবহার করি – ‘টার্গেট অডিয়েন্স’। আমরা কি আদৌ জানি কোন দর্শক আমার ছবিটি দেখবেন? এখন প্রশ্ন হচ্ছে সৎ থাকার। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি চলচ্চিত্র দেখার পরে স্পষ্ট বোঝা যায় কতোটা আন্তরিক একজন নির্মাতা ছিলেন। কেননা চলচ্চিত্র প্রত্যক্ষ ইমেজ নিয়ে উপস্থিত।
চলচ্চিত্র শিক্ষক, সম্পাদক সাজ্জাদ জহির-এর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন: আমরা চলচ্চিত্রকাররা বেশিরভাগ সময় ফরম্যাট এবং টেকনোলজির ফাঁদে পড়ে যাই। এখনো তাই। সুফিয়া কামালের বসার ঘর বড় ছিল না কিন্তু উনাকে নিয়ে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে আমি ৩৫ মি.মি.-এর জন্য লাইট, ট্রলি বসালাম নাহলে তো ফিল্মমেকার হওয়া যাচ্ছিল না। এই ভাবটাই অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক। আজকে বলতে বাধা নেই সুফিয়া কামালের ভিজ্যুয়াল ডকুমেন্টেশন আছে, কিন্তু চলচ্চিত্র হিসেবে সে ছবি উতরাতে পারেনি বলেই আমি মনে করি। এ জিনিস আজও আছে ছাত্রদের মধ্যে। যখন পড়াই দেখি, কোন ক্যামেরা এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তাদের মধ্যেও। সিনেমা তো টেকনোলজির মিডিয়াম, টেকনোলজি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কেন সেই টেকনোলজি নিচ্ছেন এটাও ভাবতে হবে।
‘আত্মকথন’ পর্বের পর শুরু হয় প্রামাণ্যচিত্রে সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ- শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। এতে মানজারেহাসীন মুরাদ-এর সভাপতিত্বে অংশগ্রহণ করেন- সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল, ফৌজিয়া খান, ব্রাত্য আমিন, পলাশ রসুল, শবনব ফেরদৌসী, মেসেঞ্জারে প্রবাসী নির্মাতা মকবুল চৌধুরীসহ উপস্থিত চলচ্চিত্রকর্মীবৃন্দ। সেখানে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে অর্থ লগ্নিকারকের অভাব, আমাদের নিজস্ব স্টোরি টেলিং বা নির্মাণ কৌশল সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনা এরকম নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
‘ডকুমেন্টিং মি’ বিষয়ক মাস্টার ক্লাসে নির্মাতা মানজারেহাসীন মুরাদ স্থিরচিত্র বিষয়ে তাঁর ভাবনা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমি ছবিগুলো হঠাৎ-ই তুলতে শুরু করি। আসলে ডাক্তার আমাকে হাঁটতে বলেছিলেন। আমার কাছে এটা খুবই বিরক্তিকর ছিল। হঠাৎ একদিন মনে হল হাঁটতে হাঁটতে যদি ছবি তুলি সেটা ভাল হয়। ফেসবুকে ছবিগুলো পোস্ট করলাম খেয়ালের বশে, ফেসবুকের লাইক-ও একটা উৎসাহ হিসেবে কাজ করলো। যারা লাইকগুলো দিতেন কেউ তেমন ফটোগ্রাফিতে পারদর্শী নন। একটা জিনিস হচ্ছে বলে আমার মনে হতো। ডকুমেন্টেশন অব লাইফ। প্রাত্যহিক জীবনের, মুহূর্তের ডকুমেন্টেশন হয়ে যাচ্ছে।