যখনি তাকে প্রশ্ন করা হতো ‘কত দিন বেঁচে থাকতে চান?’ দ্বিতীয় ভাবনা যোজন যোজন দূরে ঠেলে দিয়ে স্মিত হেসে তিনি উত্তর দিতেন, ‘পাঁচ হাজার বছর’। সত্যিই তো, কবিরা পাঁচ হাজার বছর বাঁচলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই আয়ু পেলে, অথবা শামসুর রাহমান যদি পেতেন; তাহলে পৃথিবী কবিতার লালিত্যে কিছুটা হলেও কোমল হতো।
১৭ আগস্ট , ২০০৬ সালের এ দিনে কবি শামসুর রাহমান চলে গেছেন তার ‘স্মৃতির শহর’ ছেড়ে। এখন তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন তা অন্তত আমরা জানি না। তবে তার কবিতা, তার কিছু গান, তার গদ্য জ¦লজ¦লে এক একটি পোস্টার হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে পাঠক হৃদয়ে। এক্ষণে এই প্রশ্নটা উঠতেই পারে; সত্যিই তার কবিতা উচ্চারিত হচ্ছে আজ, প্রতিদিন? অন্তত আজ, তিনি কি কোথাও বাজছেন?
শামসুর রাহমানের অনেক গুণ। সবেচেয়ে বড় গুণ, তিনি কবি। তার পরিচয় তিনি কবি শামসুর রাহমান। তিনি অনেক অনেক অনালোচিত কবিতার নান্দনিকতায়-উজ্জ্বল কবিতা লিখেছেন; কবিতার সঙ্গে কটিয়েছেন পুরো একটা জীবন। তবে তাকে এক ধরনের আলোচিত করেছে- ‘আসাদের শার্ট’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাগুলো।
রবীন্দ্রঅধ্যায় আলগোছে একটু পাশে সরিয়ে রেখে এটা বলতে প্রয়াস করা যেতে পারে যে, কবিতা লেখাও যে অনেক উজ্জ্বল একটা কাজ, কবিজীবনও যে এমনতর মহিমান্বিত হতে পারে, বাংলাদেশে, বাঙালি মুসলমানের সামনে তার মহীরুহসম উদাহরণ দাঁড় করিয়ে গেছেন শামসুর রাহমান। তিনি সুদর্শন, মিষ্টভাষী, স্বভাবে শিশির-আঘাতী, আমৃত্যু প্রেমপিপাসু।
আমার এখনো এক ধরনের অহংকার হয় এই ভেবে যে, এই কবিকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। তার সঙ্গে অনেক পথ হাঁটার দাগ আছে আমার সময়ে। একথাটা আবারও বলতে লোভ হচ্ছে আমার; কোনো এক ২৩ অক্টোবরের সকালে, কবির জন্মদিনে কবির শ্যামলীর দোতলা বাড়ির দক্ষিণের ঘর। নরম রোদ এসে গালভরে হেসে জন্মদিনের আলোকমালা পরিয়ে দিচ্ছে কবির গলায়। তিনি ঝলমলে এক কিশোর তখন। লেখার টেবিল ডাকছে। কলম অপেক্ষা করছে তার জন্য। রুলটানা ডায়েরির পাতা শঙ্খযোনি মেলে দাঁড়িয়ে আছে তার স্পর্শ পেতে। তিনি মেতেছেন রোদের সঙ্গে খেলায়। ঠিক তখন টেলিফোনে ঝংকার তোলে ধ্বনি। তিনি ক্রেডেল থেকে রিসিভার তুলে নিয়ে বলেন, ‘হ্যালো’। খানিক পরই কবির চেহারা রঙ বদলায়। মনে হয় সহস্র গোলাপ পাপড়ি এসে ঢেকে ফেলে তার মুখমণ্ডল। পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি টেবিলের কোণায় অপেক্ষমান চায়ের কাপ তুলে নেন অন্য হাতে। শব্দহীন চুমুক বসান। তারপর বলেন, ‘চায়ের পেয়ালায় ওষ্ঠ ছুঁইয়ে জীবন পান করছি’।
কবি শামসুর রাহমান জীবন পান করতে শিখেছিলেন। এই খুনের শহরে, এই হিংসার শহরে, এই হানাহানি-ধর্ষক, দখলের শহরে, অনেক শত্রুর সঙ্গে লড়তে লড়তে তিনি স্নিগ্ধ-নাগিরক কবিতা লিখতে পারতেন এবং চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি তা অব্যাহত রেখেছিলেন। ডায়েরির একটি পাতা- নামে কবিতায় তিনি লিখেছেন:
সকালের রোদে এই সাতই আশ্বিনে
আরো একটি দিন এলো জানাতে সাদর
সম্ভাষণ। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে চাদরে পা ঘষি,
অন্যমনে আঙুল চালিয়ে দি চুলে,
কোথাও উজ্জ্বল মোটরের হর্ন বেজে ওঠে (শুনি)
চেনা শব্দ হরেক রকম। টিক টিক ঘড়ি বাজে, ঠিক ঠিক
টিকটিকি সাড়া দেয় সহযোগী তন্ময় নিষ্ঠায়।
বাথরুমে গড়ায় কলের পানি, বারান্দায় দেখি
হাওয়ায় টবের ফুলে সে কী গলাগলি।
আলো
লাগা ভালোলাগা বেলা
খেলা করে সত্তার প্রাঙ্গণে
বেঁচে আছি।
আলনায় ঝোলানো আমার
ইজের কামিজ সাদা দেয়ালের ফুল,
টেবিলে পুরানো ছবি, শুকনো ফল, দাড়ি কামাবার
সরঞ্জাম, অসমাপ্ত কবিতার পা-লিপি, বই
সবকিছু ঝলমলিয়ে ওঠে
আশ্বিনের রোদ্দুরে এবং
মনে হয় থাকব এখানে চিরদিন।
যখন পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে
রুটি মাখনের ঘ্রাণ, সোনালি চায়ের
সুগন্ধ, চুড়ির শব্দ, দরজার আড়ালে তোমার
কণ্ঠস্বর ছোঁয় প্রাণ, ভাবি কী সুন্দর
এই বেঁচে থাকা…
এই হলেন শামসুর রাহমান, নাগরিক কবি, বেঁচে থাকার কবি, বাঁচিয়ে রাখার কবি।
আমৃত্যু কবিতার সঙ্গে, কেবল কবিতার সঙ্গেই বসবাস করেছেন তিনি। আরেক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় বলা যায়- কবিতার জন্য অমরত্বকে তাচ্ছিল্য করেছেন শামসুর রাহমান। একবার শামসুর রাহমানের জন্ম দিনের আয়োজনে ঢাকায় এসেছিলেন সুনীল। কবির শ্যামলীর বাড়িতে মুখোমুখি বসেছিলেন দুজন। আমরা কজন ছিলাম তার মুগ্ধ সাক্ষি। সুনীল বলেছিলেন, আর কারো কথা বলতে পারছি না, তবে আমি শামসুর রাহমানের কবিতার মুগ্ধ পাঠক। সেসঙ্গে তার ব্যক্তিত্বও আকর্ষণ করে আমাকে।
কেবল কী কবিতা? মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতামুক্ত আধুনিক এক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে বার বার রাজপথে নেমে এসেছেন শামসুর রাহমান। একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, সেই আন্দোলনে অন্যতম প্রেরণাপুরুষ ছিলেন শামসুর রাহমান। দিনের পর দিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ^বিদ্যাল প্রাঙ্গণ আর রাজপথের মিছিলে অংশ নিয়েছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের পক্ষে লিখেছেন দিনের পর দিন। ছুটে গেছেন বিপন্ন মানুষের কাছে। এসব করতে গিয়ে মৌলবাদী ঘাতকদের কোপানলেও পড়তে হয়েছে তাকে। তখনো বাংলাদেশে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক ঘাতকরা এভাবে থাবা তুলতে সাহস করেনি। তখনো আক্রান্ত হননি দ্যুতিছড়ানো লেখক হুমায়ুন আজাদ। তখনো ঘাতকের চাপাতির কোপে প্রাণ যায়নি কোনো মুক্তমনা লেখকের।
১৯৯৯ সালে, শ্যামলীর বাড়িতে ঢুকে ঘাতকরা আঘাত করেছিলো শামসুর রাহমানকে। সেই থেকে শুরু। আর এখনতো এক বিপণ্ন সময়। দেশজুড়ে হেফাজতে ইসলামে হুকুম চলে। জঙ্গিঘাতকরা মাঝে মাঝেই ছোবল বসায় জনপদে। খুনি-ধর্ষকের হাত থেকে রেহাই পায় না শিশু- প্রতিবন্ধী কিংবা বাউল ভিখেরিও। তো এমন বিপণ্ন সময়ে আজ কোথাও কি উচ্চারিত হবে কবি শামসুর রাহমানের নাম? কোথাও কি বাজবে তার কবিতা?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)