১৬ কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি, শত শত বছর আগে শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই নন, ব্রিটিশরাও বুঝতে পেরেছিল আমাদের চরিত্র। বাঙালির চারিত্রিকভাবে ভঙ্গুর, অশক্ত মেরুদণ্ড, নেই দৃঢ়তা, নেই কাঠিন্য। আছে লোভ, প্রতিহিংসা পরায়নতা, জিজ্ঞাংসা। নিজ ছাড়া বাঙালি অন্য কিছু ভাবে না। সব কিছুতে তামাশা খোঁজা বাঙ্গালির প্রধান কাজ। দেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, গত জানুয়ারির ১ তারিখে পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৩৬ লাখ ৫০। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এর মধ্যে আমরা ১৬ কোটিই অসভ্য, বিনোদন-তামাশা প্রিয় অলস, পরাধীন মনস্ক জাতি। আর এ কারণেই মাত্র ৩ হাজার সৈন্য নিয়ে প্রায় ৪০ হাজার সুসজ্জিত সৈন্য বহর নিয়ে পলাশীর ময়দানে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করতে পেরেছিল ব্রিটিশ বাহিনী।
বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের ৩২ নম্বর হোল্ডিংয়ে ২২ তলা বাণিজ্যিক ভবন এফআর টাওয়ারে আগুন লাগে আর এতে প্রাণ হারায় ১৯ জন। বিল্ডিং কোড, নিয়মনীতি না মানা, অগ্নিনির্বাপক সুবিধা না থাকা, ফায়ার একক্সিট না থাকা, এসব নিয়ে নাইবা এবার লিখলাম, কারণ অনিয়মই যখন নিয়ম এই দেশে। অসাধুরাই সাধু যে দেশে। দুর্নীতিবাজরাই হর্তাকর্তা যে দেশে। সেখানে আর এই গুলি নিয়ে বারবার কথা বলা আর পাথরে মাথা বারি দেয়া একই কথা। ১৯টা পরিবার শেষ হয়ে গেল এতে কারো কিছু যাবে আসবে না। শুধু ১৯টা পরিবার নিঃশেষ হয়ে গেল।
আগুন লেগেছে বিল্ডিংএ, ফায়ার ব্রিগ্রেডের গাড়ী আসবে। কিন্তু জলদি জলদি কিভাবে আসবে? পথের জ্যাম ঠেলে কি করে আসবে তারা? দেশে নেই জরুরি সেবাদানকারী যানবাহনের জন্য পথ ছেড়ে দেয়ার সুব্যবস্থা ও মানসিকতা। জ্যাম ঠেলে যাওবা আসলো ফায়ার ব্রিগেড কিন্তু এফ টাওয়ারে সামনে পৌঁছুবে কি করে? হাজার হাজার মানুষ পথ বন্ধ করে ভিড় করে দালানের আগুন দেখছে। যাদের বেশীর ভাগ সেলফি ও ভিডিও করছে। এই ভিড় করে রাখা হাজার হাজার উৎসুক জনতাকে সরাতে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়েছে। আশেপাশের বেসরকারি ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা এই জনতাকে সরাতে পথে নেমেছিল। এক দল মানুষ পানির পাইপ ধরে সাহায্য করছিল। এফ আর টাওয়ারের বিভিন্ন অফিসে কর্মরত মানুষের আত্মীয় স্বজন ছুটে এসেছে, তাদের আপনজনের খোঁজে, বন্ধুর খোঁজে। কিন্তু বিনোদন প্রিয়জাতির ভিডিও করার হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। তাদের কান্না, উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক ও আর্তি সেখানে ভিড় করে থাকা অধিকাংশ মানুষের কাছে তামাশার বিষয় বস্তু। মোবাইলে ছবি তোলা ভিডিও করার খোরাক পেয়েছে যেন। হামলে পরেছিল তারা পঙ্গপালের মত।
২৬২ বছর আগে লর্ড ক্লাইভ তাই এতো সহজে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করতে পেরেছিল। নবাবকে যখন গ্রেফতার করে টেনে হিচঁড়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন অসংখ্য মানুষ হা করে নিরব দর্শকের মতো সেই দৃশ্য উপভোগ করেছিলো। এই নবাব তার প্রজাদের জন্য কিনা করেছিলেন।
পিঠে ছুরি মারার আগে কাটাওয়ালা সিংহাসন বসানোসহ ছেঁড়া জুতার মালা দিয়ে অপমান করা হচ্ছিলো, তখনও শত শত মানুষ সেই নির্যাতনকে কৌতুক মেনে দারুণভাবে বিনোদিত হয়েছিল বিনোদিত।
ক্লাইভ তার ডায়েরীতে লিখেছিল নবাবকে যখন অপমান করতে করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল যত মানুষ তারা প্রত্যেকে যদি একটি করেও ঢিল মারত তাহলে আমরা করুণভাবে পরাজিত হতাম। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, প্রায় ১০ হাজার অশ্বারোহী, ৩০ হাজার পদাতিক এবং অসংখ্য কামান-গোলাবারুদসহ বিশাল সুসজ্জিত সৈন্য-বাহিনী নিয়েই পলাশীর ময়দানে এসেছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা।
বিপরীতে রবার্ট ক্লাইভের সৈন্যসংখ্যা ছিলো মাত্র ৩ হাজার, সেখানে ৯শ জনই ছিল অনুরোধ করে ধরে নিয়ে আসা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শৌখিন অফিসিয়াল সদস্য, এদের অধিকাংশেরই তলোয়ার ধরার মতো প্রশিক্ষণ ছিলো না, তারা আগে কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি।
.
সব জেনেই ক্লাইভ যুদ্ধ করতে এসেছিল কারণ সে খুব ভাল করেই জানত, একটি হীনমন্য ব্যক্তিস্বার্থলোভী দ্বিধাগ্রস্ত জাতিকে পরাস্ত করতে খুব বেশি কিছুর দরকার নেই। যে জাতি সামান্য সম্পদের জন্য বিদেশীদের সাথে হাত মিলিয়ে দেশের ক্ষতি করে, তাদেরকে সামান্য দাবার চালের মাত দেয়া মত মাত দেয়া যায়। এদের জন্য হাজার হাজার সৈন্যের জীবনের ঝুঁকি নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। মীরজাফরকে যখন নবাবীর টোপ গেলানো হয়, রবার্ট ক্লাইভ জানতো, সিরাজই প্রধান বাধা। তাকে পরাজিত করার পর বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর, উমিচাঁদ, রায়বল্লভ, ঘষেটি বেগমসহ সব লোভীগুলিকে শেষ করা মশা মারার মত সহজ। ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনী মীর জাফরদেরই উত্তরসূরি।
.
ক্লাইভ বাঙ্গালীর নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গ করার মানসিকতা টের পেয়েছিলেন বলেই মীরজাফরকে টোপ দিয়েছিলেন। জানতো সে মীরজাফর টোপ গিলবে। কাজ শেষ হলে এই লোভীটির কোন মূল্য নেই কারণ যে নিজের দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, সে সারাজীবন বিশ্বাসঘাতকই থাকবে। কাজ শেষে তাকে নিকেশ করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি ক্লাইভ। যুদ্ধশেষে জনসম্মুখে নবাবকে অপমান করতে করতে নিয়ে যাওয়ার সাহস করেছিল ব্রিটিশবাহিনী, কারণ জানত পশ্চাতদেশে লাথি দিতে দিতে নিলেও এ জাতি বিনোদনে দাঁত বের করে হাসবে অথবা হা করে তাকিয়ে থাকবে।
২৬২ বছর পরেও বাঙালি মানুষ হয়নি, একাবিংশ শতকে এসেও দেখি একদল মানুষ হাঁ করে মানুষের নিদারুণ কষ্ট উপভোগ করছে। আর আক্রান্তদের সাহায্যের জন্য সেবাদানকারী সংস্থার কর্মীরা বাধাগ্রস্ত হয়ে হিমশিম খাচ্ছে। আর সুবিধাভোগীরা সুবিধামত রাতকে দিন আর দিনকে রাত করছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, আমি নির্দেশ দিয়েছি, আমি উত্তরের মেয়র হিসেবে বলছি সবাইকে বিল্ডিং কোড মেনে চলতে হবে। আপনারা দেখেছেন রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা কিন্তু বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পত্রিকায় দেব, ভবন মালিকদের নকশা দাখিল করতে হবে। যারা দাখিল করতে ব্যর্থ হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি নগরের মেয়র হিসেবে জিরো টলারেন্সের ব্যবস্থা নেব। নিচে দেখা যাচ্ছে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমি অনুরোধ করব নিজ নিজ দায়িত্বে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করবেন।
প্রত্যেকটা বিল্ডিংয়ে ফায়ার সেফটি কোড অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা অতিসত্বর করতে হবে, কারণ আমরা আর কত শিক্ষা নেব? আর শিক্ষা নিতে চাই না। আমরা এটা বাস্তবায়ন করতে চাই। উল্লেখ্য যে, বিজেএমই সভাপতি থাকাকালীন অবৈধ বিজেএমই ভবন রক্ষার সম্ভব সব চেষ্টা করেছেন, উত্তরের বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলাম।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)