বাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখি নিজের ঘরকেই চিনতে পারছি না। ঘরের সব কিছু কেমন জানি অন্যরকম লাগছে। খুব কমন চেনা জানা প্রয়োজনীয় নিত্যদিনের অনুসঙ্গগুলো অনুপস্থিত। অথচ কারো কোন সমস্যা নেই। সব চলছে ঠিকঠাক। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে শুধু এক থালা-বাটির চার ধাপ পরিবর্তন দেখলাম। ছোটবেলায় কাঁসার থালায় মা দুধ-ভাত খেতে দিতেন পাটালি গুড় দিয়ে। খাওয়া শেষে কাঁধ ওঠানো থালায় শেষ চুমুক দিয়ে অমৃত স্বাদ নিতাম। একদিন কাঁসা পেরিয়ে এলো স্টিল। চকচক করলেই সোনা হয় না, এই মন্ত্রে বিশ্বাসী মা খালারা কাঁসা ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্টিলের রান্নার সরঞ্জাম কিনতে। খুব বেশীদিন টিকলো না অবশ্য।
টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে আধুনিক হতে আমরা চলে এলাম মেলামাইনের দখলে। এখন অবশ্য কাঁচের যুগ। তবে হাঁ, বিশেষ দিনে মাটির থালা বাসন বেশ অভিজাত করেছে আমাদের। তবে কারো কারো স্টোর রুমে হয়তো কাঁসার দ্রব্যাদি ধুলোয় মুখ লুকিয়ে কাঁদে এখনো। সংসারের আরেক অতি প্রয়োজনীয় শীল-পাটাও নেই, নেই ভরদুপুরে একঘেঁয়ে সুরে হাক-ডাক, শীল-পাটা ধার করাইবেন? শীলপাটা। দুপুরে ভাত ঘুম থেকে মা টেনে তুলতেন ওই শীলপাটা ধার করানোর লোক ডেকে আনতে। তারাও বেশ বৈজ্ঞানিক ভাব নিয়ে পাটা উল্টেপাল্টে দেখে কাজে নেমে পড়তেন। সংসার থেকে উধাও হয়ে গেছে হারিকেন ও কুপি।
কিছুদিন আগ পর্যন্তও বিদ্যুতের দাবিতে নানা হট্টগোল লেগেই থাকতো দেশজুড়ে। এখন সে উপদ্রব নেই। আর যে সব এলাকায় আছে সেখানেও আলো ছড়াতে পৌঁছে গেছে চায়না কোম্পানী। হারিকেন কুপি বা হ্যাচাক বাতি আর আসবে না আমাদের জীবনে প্রয়োজনীয়তা হয়ে। মনে পড়ে বই রাখার সর্বোৎকৃষ্ট জায়গা ছিলো বাঁশের সেলফ? এখন অবশ্য ক’জনের বাসায় বই সংগ্রহ হয় সেটাই আগে ভাবার বিষয়। শীতকালে অতি প্রয়োজনীয় লেপের প্রচলন কমে গেছে অনেক। বুঝতে পারি তখন, যখন ছোটদের কাছে লেপ শব্দটা অপরিচিত শোনায়। কতো মানুষের বাসায় যাই এখন আর সেই লাল সান বাঁধানো মেঝে চোখে পড়ে না। ফ্লোরমেট আর কার্পেট-ই যেখানে টাইলস্ এর চোটে বিলুপ্ত প্রায়, সেখানে লাল সান বাঁধানো ফ্লোর খোঁজা হাস্যকর।
আলনায় কাপড় রাখার একটি বিশেষ নিয়ম ছিলো সেকালে। সারি ভাগ করা থাকতো অনেকের বাসায়। নিচের দিকটায় আশ্রয় পেতো জুতা স্যান্ডেল। এখন জুতা স্যান্ডেলের জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। হারিয়েছে সংসারের অতি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সেলাই মেশিন। ছোটখাট দর্জির কাজটা মা বোনেরাই সেরে দিতেন। এমন কি পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়ে আলাদা পরীক্ষাও হতো। এখন আছে কিনা জানা নেই। তবে বাসা থেকে যে সেলাই মেশিন পালিয়েছে তা পাড়ার মোড়ে মোড়ে টেইলারস এর দোকানে তাকালেই বোঝা যায়। হারিয়েছে রেডিও। যে রেডিও ভোর ৭টার খবর থেকে শুরু হয়ে শেষ রাতের নিশিথে অনুষ্ঠান পর্যন্ত সঙ্গি ছিলো তাও আজ আর নেই। নেই ওয়াকম্যান, টেপ রেকর্ডার, ভিসিআর।
আসলে ভালো ভাবে তাকালে হয়তো দেখতে পাবো আগের কোন কিছুই আর নেই। হয়তো আমিও আমার মতো নেই। আয়নায় তাকিয়ে রোজ যে মুখে বয়সের ভাঁজ লুকোনোর চেষ্টা করি তা হয়তো আর লুকানো যাচ্ছে না। বয়সের সাথে বিদায় নিয়েছে প্রতিদিনের জীবনের কতো শত উপকরন। আমিও যে থাকবো না এটাও নিশ্চিত। তবে খুব ইচ্ছে আমার চলে যাবার পরেও ওই ফেরিওয়ালার ডাকের মতো ভরদুপুরে উদাস সুর হয়ে বেঁচে থাকি কারো তন্দ্রায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)