আশুলিয়ার স্পেকট্রাম ভবন থেকে নিমতলী, তাজরীন, রানা প্লাজা ও চকবাজারের চুড়িহাট্টার ঘটনার পর এবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটলো বনানীর এফ আর টাওয়ারে৷বহুতল ভবনগুলো কেন এমন মৃত্যুকূপে পরিণত হলো? মানুষ বহুতল ভবন হতে জীবন বাঁচাতে লাফিয়ে পড়ে জীবন হারাচ্ছে৷
মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হলো তার ঘর৷ আজ সে ঘরেও কোন নিরাপত্তা নেই৷ তাই ঘর হতে লাফিয়ে পথে নেমে জীবন বাঁচাতে চাইছে তারা৷ কিন্তু পথেও কি আর নিরাপত্তা থাকে? চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে মানুষকে পথেও পুড়ে মরতে দেখেছি৷ জীবনের নিরাপত্তা নেই ঘরে, সড়কে, আকাশ পথে, নৌ পথে৷ গোটা দেশটাই যেন এক নিরাপত্তাহীনতার দূর্গ হয়ে উঠছে৷ কী কারণে আগুন লেগেছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেনা কেউ। এজন্য দায়ী কি অপরিকল্পিত নগরায়ন নয়? দেয়ালের সাথে দেয়াল লাগিয়ে এতগুলো বহুতল ভবন কিভাবে নির্মিত হলো? ভবন তৈরির সময় ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড কেন মানলো না কেউ? তখন কোথায় ছিল সিটি কর্পোরেশন, কোথায় ছিল গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউক?
এফ আর টাওয়ারের আগুনের ধোঁয়া থাকতে থাকতেই ঠিক তার কাছেই আরো একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল৷ বনানীর ২৩ নম্বর রোডের ৪৩ নম্বর বাসার ছয় তলা আবাসিক ভবনের চার তলায় আগুন লাগল৷ এগুলো কি শুরু হলো? এর শেষ কোথায়?
কিছুদিন পরপর এমন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটবে আর নতুন নতুন তদন্ত কমিটি হবে এতেই কি দায় শেষ? বাড়ছে তদন্ত কমিটি বাড়ছে অগ্নিকাণ্ড, বাড়ছে মানুষের মৃত্যু৷ নিমতলী ও চকবাজার ট্র্যাজেডির যথাযথ কারণ অনুসন্ধান করে যদি তদন্ত কমিটি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতো তাহলে হয়তো এই বনানী ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটতোনা৷ তাই নয় কি? মানুষ বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে মৃত্যুবরণ করছে৷ জনতা চেঁচিয়ে বলছে নেট কোথায়? কর্তৃপক্ষ কেন মানুষদের বাঁচাতে কোনো নেটের ব্যবস্থা করলো না? কেন আগুন নেভাতে পানির অভাব দেখা দিল? এসব অগ্নিকাণ্ডের বেশির ভাগই বিদ্যুতের ত্রুটিজনিত কারণেই হয়ে থাকে৷ ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুত সংযোগ কেন দেয়া হলো?
নয়তলার ওপর ভবন করতে গেলে রাজউকসহ কমপক্ষে দশটি সরকারি সংস্থার ছাড়পত্র লাগে৷ এই ছাড়পত্রের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্রও আছে। বনানীর এফ আর টাওয়ারের মতো ভবনগুলো কিসের ভিত্তিতে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্রসহ অন্যান্য ছাড়পত্র পেল?
ঢাকা শহরের অধিকাংশ বহুতল ভবন নিয়ম মেনে নির্মাণ করা হয়নি৷ এজন্য কি রাজউকের কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কখনো কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
নিয়মবহির্ভূত ভবন নির্মাণ করলে ইউটিলিটিজ অর্থাৎ পানি, বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশনের সংযোগ পাওয়ার কথা নয়, আবার নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে কি না তা যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষেই ইউটিলিটিজ সংযোগগুলো দেওয়ার কথা। প্রশ্ন হলো কিসের বিনিময়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে তৈরি ভবনগুলো এসব সংযোগ পেল? এ ব্যর্থতা কার?
আগুন লাগার খবর শুনেই বনানীতে ছুটে এল ডাব বিক্রেতা রুহুল আমিনের ছেলে নাঈম৷ ভিড় ঠেলে আগুন লাগা এফ আর টাওয়ারের সামনে চলে যায় সে৷ নাঈম যখন দেখে একটি পানির পাইপ ফেটে পানি বের হচ্ছে তখন পাশ থেকেই একটি পলিথিন কুড়িয়ে তা দিয়ে পাইপের ফাটা অংশটি চেপে ধরে পানি আটকাতে চেষ্টা করে সে। কেন এমনটি ঘটল? তবে কি ফায়ার সার্ভিস ত্রুটিপূর্ণ সরঞ্জাম নিয়ে এসেছিল? আর যদি এমনটি হয় যে এই পাইপটি বহুতল ভবনের ধ্বংসাবশেষ পড়ে ফেটে গেছে৷ তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কেন দ্রুত তা সারিয়ে তুললো না? কেন বালকটিকে পলিথিন দিয়ে পাইপটি মুড়িয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করতে হলো?
অগ্নিকাণ্ড ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ সিলেট নগরীর উপশহরে একটি দোকানে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগল ২৯ মার্চ, শুক্রবার রাত দশটার দিকে৷ সামাদ ম্যানশনের পার্শ্ববর্তী হাসেম এন্টারপ্রাইজ নামক একটি পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পণ্যের (ভাঙ্গারি) দোকানে এই আগুন লাগে। পরের দিন ৩০ মার্চ শনিবার আগুন লাগে রাজধানীর গুলশান-১ এ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মার্কেটে ।
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন-২০০৩ অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ বহুতল ভবনের অগ্নি নিরাপত্তার নকশার অনুমোদন দিয়ে থাকে। বহুতল ভবনের নকশা রাজউক থেকে অনুমোদনের আগেই এটি করতে হয়। রাজউক এ সকল ভবনের স্থাপত্য নকশা অনুমোদনের পূর্বে ফায়ার সার্ভিস, ট্রাফিক পুলিশ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন আছে কিনা তা দেখে থাকে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস অনুমোদন দিয়ে পরে নির্মাণ কাজটি নিয়মমতো হচ্ছে কিনা সেদিকে কোনো খেয়াল রাখে না৷ নির্মাণকাজ শেষ হলে ভবনটি ব্যবহারের জন্য রাজউক কর্তৃক অকুপেন্সী সার্টিফিকেট প্রদানের আগেও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হয়৷ এতকিছু লাগা স্বত্ত্বেও এত এত মৃত্যুফাঁদের এমন ভবন কিভাবে গড়ে উঠল? তবে কি কর্তৃত্ব, আধিপত্য ও অর্থের কাছে তারা বিকিয়ে দিলো মানুষের এই নির্মম মৃত্যুগুলো?
এফ আর মানে ফারুক রূপায়ণ। এফ আর টাওয়ার একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিকানাধীন। ২০১৫ সালের এপ্রিলের মৃদু ভূমিকম্পে পার্শ্ববর্তী ভবনগুলো অক্ষত থাকলেও এই এফ আর টাওয়ার তার লাগোয়া ভবনের ওপর হেলে পড়েছিল। নিচতলার দেয়ালে ফাটল দেখা দিলে তাও তখন কৌশলে ঢেকে দেওয়া হয়। মালিক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ও বিলিয়নিয়ার বলে মূলধারার গণমাধ্যমে তখন খবরটি আসেনি এমন কথাও কেউ কেউ বলে থাকেন৷ তখন কোথায় ছিল রাজউক, সিটি কর্পোরেশন? এই ভবনটির ব্যাপারে কোন ব্যবস্থাগ্রহণ কি কারো দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিলো না?
সাধারণ মানুষ আর দায় এড়ানো চায় না৷ চায় না এইসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিল দেখতে৷ লাগাতার এই অগ্নিরহস্যের যথার্থ কারণ উদঘাটিত হোক৷ মানুষ নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে অফিসে ও বাসায় বসবাস করতে পারে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক, এ প্রত্যাশা সকলের৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)