বাংলাদেশ থেকে ফেরা রোহিঙ্গাদের জন্য আগামী সপ্তাহের ডেডলাইনের মধ্যেই একটি অস্থায়ী শিবির প্রস্তুত করা হবে বলে জানিয়েছেন মিয়ানমারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। রাখাইনে সহিংসতার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার সময় এই শিবিরে রাখা হবে। এজন্য দেশটির সরকার ৩০ হাজার রোহিঙ্গার জন্য এই অস্থায়ী শিবির নির্মাণ করছে। সোমবার দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইটস অব মিয়ানমার এ খবর জানিয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কর্মকর্তারা সোমবার নেপিদোতে ২৩ নভেম্বর স্বাক্ষরিত প্রত্যাবাসন চুক্তি নিয়ে আলোচনায় বসেছেন। চুক্তি স্বাক্ষরের পর এটাই জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) প্রথম বৈঠক।
গত ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার একটি চুক্তিতে পৌঁছায়। পরে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধানের জন্য দেশ দুটি ৩০ সদস্যের জেডব্লিউজি গঠন করে।
রোহিঙ্গাদের জন্য হ্লা পো খাউং এলাকায় এই অস্থায়ী শিবির গড়ে তোলা হচ্ছে। এটি উত্তর রাখাইনে অবস্থিত। প্রত্যাবাসনের জন্য কাঠামোগতভাবে যাদের গ্রহণ করা হবে তাদের জন্য অস্থায়ী ট্রানজিট শিবির হিসেবে এটি কাজ করবে। ১২৪ একরে ৬২৫টি ভবন নিয়ে নির্মিতব্য এই অস্থায়ী শিবিরে ৩০ হাজার মানুষকে রাখা যাবে। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে প্রায় ১০০টি ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ‘জাতিগত নিধনের’ মুখে গত আগস্ট থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে সাড়ে ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে আরসা’র জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে, এমন অভিযোগ তুলে এই অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। স্থানীয় বৌদ্ধরাও এই দমন-পীড়নে সেনাবিহনীকে সহায়তা করে। জাতিসংঘ ওই অভিযানকে জাতিগত নিধনের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
এতোদিন মিয়ানমার ও দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের কথা অস্বীকার করলেও কয়েকদিন আগে সেনাপ্রধান ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যায় চার সেনা সদস্যের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। তবে গত বছরের ডিসেম্বরেই মানবিক সাহায্য সংস্থা মেডিসিনস স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) জানায়, সামরিক অভিযানের প্রথম মাসেই কমপক্ষে ৬ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার শিকারদের মধ্যে রয়েছে কমপক্ষে ৭৩০ জন শিশু, যাদের বয়স ৫ বছরের কম।
মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে বলেন, কতজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নিবে এবং কিভাবে তাদের যাচাই-বাছাই করা হবে, তা নিয়ে সোমবার বৈঠকে বসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কর্মকর্তারা। জানুয়ারির ২৩ তারিখ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবান প্রক্রিয়া শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, আগামী সপ্তাহ থেকেই ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে এবং তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হবে বলে আমরা নিশ্চিত।
মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় মানবিক সহযোগিতা, পুনর্বাসন ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান সমন্বয়কারী অং টুন থেট জানান, হ্লা পো খাউং শিবিরটি হবে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘স্থানান্তরের জায়গা’। তাদেরকে নিজ স্থানে প্রত্যাবাসন বা নিজ স্থানের কাছাকাছি স্থানে পাঠানোর আগে এখানে রাখা হবে। তিনি বলেন, মিয়ানমারে যারা ফিরতে চাইবে তাদের সবাইকে গ্রহণ করা হবে।
এই কর্মকর্তা জানান, যারা ফিরতে চাইবে তাদের মিয়ানমারের বাসিন্দা হিসেবে যাচাই করার পরই গ্রহণ করা হবে। এরপর তাদের পর্যবেক্ষণ শিবিরে পাঠানো হবে। সেখান থেকে অস্থায়ী শিবিরে।
রোহিঙ্গাদের নতুন বাড়ি বানানোর আগ পর্যন্ত অন্তত এক থেকে দুই মাস হ্লা পো খাউং শিবিরে থাকতে হতে পারে।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, নাগরিকত্বের প্রমাণ দিয়ে কতজন রোহিঙ্গা ফিরে আসতে পারবেন তা স্পষ্ট নয়।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রোহিঙ্গা মুসলিমরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন যদি তারা মিয়ানমারে বসবাসের প্রমাণ দিতে পারেন। ১৯৯২ সালের মতো এবারের চুক্তিতেও রোহিঙ্গাদের নাগিরক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
মিয়ানমারের কর্মকর্তারা বলছেন, ১৯৯২-৯৩ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুসারে মিয়ানমার কেবল তাদেরকেই ফিরিয়ে নেবে যাদের কাছে সরকারি কোনও নথি রয়েছে।
বাংলাদেশি কর্মকর্তারা জানান, যৌথভাবে রোহিঙ্গাদের পরিচয় শনাক্ত করার বিষয় নিয়ে কীভাবে কাজ করা হবে তা এখনও নির্ধারিত না হওয়ার কারণে প্রথম ধাপের প্রত্যাবাসন কবে হবে তা নিশ্চিত নয়।
নভেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের স্বাক্ষরিত চুক্তিতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনকে (ইউএনএইচসিআর) অন্তর্ভূক্ত করার আহ্বান ছিলো। কিন্তু ইউএনএইচসিআর এতে জড়িত হবে না বলে জানিয়েছে। কিন্তু দুই দেশের সম্মতিক্রমে তারা একটি ‘গঠনমূলক ভূমিকা’ রাখতে ইচ্ছুক। বিশেষ করে শরণার্থীদের নিবন্ধন এবং রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় কিনা, সেই সিদ্ধান্ত নিতেও তাদের সাহায্য করতে চায় সংস্থাটি।
ইউএনএইচসিআর এর জ্যেষ্ঠ আঞ্চলিক যোগাযোগ কর্মকর্তা ভিভিয়ান তান বলেন, এই প্রক্রিয়ায় আমাদের অংশগ্রহণ এবং রোহিঙ্গাদের ফেরার স্থানগুলোতে আমাদের সম্পূর্ণ প্রবেশাধিকার শরণার্থীসহ, উদ্বিগ্ন অন্যান্যদের আস্থায় আনতে পারে।
নভেম্বরের সেই চুক্তিতে, অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন মিয়ানমার সরকার অঙ্গীকার করে, বাংলাদেশে পলায়নরত রোহিঙ্গাদের স্রোত থামাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবে এবং অঞ্চলটিতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছ অনেকের। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদে ও স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফেরা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের কাছে দাবি জানায় জাতিসংঘ ও মানবাধিকার গ্রুপগুলো।জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত সপ্তাহে মিয়ানমার সফরে গিয়ে সু চি’র সরকারের কাছে নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় শরণার্থীদের ফেরা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।