ভয়াল রূপ নিয়ে এসেছিলো একাত্তরে আগস্ট মাসের শেষ তিনদিন। কারো একজনের দুর্বলতা বা বিশ্বাসঘাতকতায় ২৯-৩০-৩১ আগস্ট পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুনের বেশ ক’জন সদস্য। তাঁদের সাতজন আর কখনোই ফিরে আসেননি।
তথ্য আদায়ে বকর, হাফিজ, আলতাফ, আজাদ, বদি, জুয়েল এবং রুমিকে হত্যার আগে চরম নির্যাতনও চালানো হয়েছিলো টর্চার সেলে। তাদের নখ উপড়ে নেওয়া হয়, মটমট করে হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়া হয়, প্লায়ার্স দিয়ে তুলে নেওয়া হয় দাঁত। নির্যাতনের এমন কোনো উপায় নেই যা তাদের উপর প্রয়োগ করা হয়নি। কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও গেরিলা যোদ্ধারা কোনো তথ্য দেননি। দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
মোহাম্মদ আবু বকর
ঢাকা ইন্টারকনে তাঁর দুঃসাহসিক অ্যাকশনের খবর বিশ্ব গণমাধ্যমকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো। ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলো পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর দাম্ভিকতার। ঢাকাকে তারা সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত করে রাখার দাবি করতো। কিন্তু আঠারো বয়সী আবু বকর সেই দাম্ভিকতা মাড়িয়ে পাকিস্তানীদের সবচেয়ে নিরাপত্তাবেষ্টিত জায়গায় হামলা চালিয়ে স্বগৌরবে বের হয়ে এসেছিলেন।
ওই অভিযানের পর পাকিস্তানী মিলিটারি পাগল হয়ে গিয়েছিলো। দুঃসাহসী যুবক আবু বকরকে ৩০ আগস্ট ভোরে গুলশান-২ এর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানী আর্মি। নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের বদ্ধ কামরায় অমানুষিক নির্যাতন চলে এই গেরিলা যোদ্ধার উপর। সেদিনের পর আর ফিরে আসেননি মোহাম্মদ আবু বকর।
হাফিজ
শহীদ হাফিজ বেহালা বাজাতেন, সেই সূত্রে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে সখ্যতা ছিল অনেক বছরের। হাফিজকে আলতাফ মাহমুদের ছায়াসঙ্গীও বলা হতো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গান রচনার সূত্র ধরে গেরিলা অপারেশনেও দেখা গেছে এই দুজনকে একসাথে। তিনিও ৩০ আগস্ট পাকিস্তানী সেনাদের হাতে একসাথে ধরা পড়েন।
অত্যাচারের মাত্রা এতোই বেশি ছিল যে হাফিজ টর্চার সেলেই ৩১ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
আলতাফ মাহমুদ
৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় থাকতেন আলতাফ মাহমুদ। একাত্তরের গেরিলাদের জন্য এক দুর্গ বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল তাঁর বাড়িটি। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ঢাকা শহরে কিছু গেরিলা অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেন।
সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি অপারেশন হয় আলতাফ মাহমুদের অংশগ্রহণে। তাঁদের কাছে প্রচুর বিস্ফোরক থাকায় সেগুলো নিরাপদে রাখার স্থান পাওয়া নিয়ে দেখা দেয় সমস্যা। আলতাফ মাহমুদ নিজ দায়িত্বে সব গোলাবারুদ তাঁর বাসায় কাঁঠাল গাছের নিচে পুঁতে রাখেন।
আগস্টের শেষ সপ্তাহে ক্র্যাক প্ল্যাটুনের একজন গেরিলা ধরা পড়েন। পাঞ্জাবি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে মার খেয়ে তিনি আলতাফ মাহমুদের বাসার কাঁঠাল গাছের নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদের কথা বলে দেন। ৩০ আগস্ট ভোরবেলা আর্মিরা আলতাফ মাহমুদকে ওই ট্রাঙ্ক ভর্তি অস্রসহ ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আজাদ
৩০ আগস্ট রাতে আজাদকে ধরে নিয়ে প্রথমে রাখা হয় রমনা থানায়। আজাদের মা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যান। ছেলেকে বলেন: শক্ত হয়ে থেকো বাবা। কোন কিছু স্বীকার করবে না।
আজাদ তখন মার কাছে ভাত খেতে চান। মা ভাত নিয়ে এসে ছেলেকে আর পাননি। আর কোনদিনও মায়ের বুকে ফিরে আসেননি মুক্তিযোদ্ধা আজাদ। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন আজাদের মা। ঠিক ৩০ আগস্টেই মারা যান তিনি। পুরো ১৪বছর ভাত মুখে তুলেন নি এই মা, কেবল একবেলা রুটি খেয়ে থেকেছেন। কারণ তার একমাত্র ছেলে আজাদ ভাত চেয়েও খেতে পারেননি সেদিন। ১৪ বছর মা অপেক্ষা করেছেন ছেলেকে ভাত খাওয়াবেন বলে। এই ১৪ বছর তিনি কোনো বিছানায় শোন নি। মেঝেতে শুয়েছেন, শীত-গ্রীষ্ম কোনো কিছুতেই তিনি পাল্টাননি পাষাণ শয্যা। কারণ তার ছেলে নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে বিছানা পাননি।
আজাদের বাড়িতে পাকিস্তানী বাহিনী যে অপারেশন চালায়, ধারণা করা হয় তার তথ্যদাতা ছিলো মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কামারুজ্জামান।
বদি
বদিউল আলম ঢাকা শহর ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি দুর্ধর্ষ অপারেশনে অংশ নেন। উল্লেখযোগ্য ছিলো: ৮ আগস্ট ফার্মগেটে পাক বাহিনীর চেকপোস্ট অপারেশন, ১১ আগস্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটানো, ১৪ আগস্ট গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে ঢাকা শহরের আকাশে বাংলাদেশের অনেকগুলো পতাকা উড়ানো, ১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে অপারেশন এবং ২৫ আগস্ট ধানমন্ডির ১৮ ও ২০ নম্বর রোডে অপারেশন। এসব অভিযান এখনও তাদের দুর্ধর্ষতা ও দুঃসাহসিকতার উদাহরণ।
মায়ের আদেশ মেনে বদিউল আলম ‘ক্র্যাক প্লাটুনে’র সদস্য হিসেবে ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় একের পর এক দুর্ধর্ষ ও দুঃসাহসিক সফল অপারেশন পরিচালনা করছিলেন। ২৯ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাক-বাহিনীর একটি দল হঠাৎ করেই তাদের ধানমণ্ডির বাড়ি ঘেরাও করে। বদিউল জানালা টপকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। পাকিস্তানী হায়েনারা সেখান থেকে বদিউলকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
জুয়েল
১৯ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার ষ্টেশন অপারেশনের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি আহত হন। এরপর তাকে মগবাজারে প্রখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদের বাসায় চিকিৎসার জন্য আনা হয়। আলবদরের তৎকালীন সেকেন্ড ইন কমান্ড আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এই খবরটা পৌঁছে দেয় স্থানীয় পাকিস্তানি ক্যাম্পে। ২৯ আগস্ট পাকিস্তানী বাহিনী হামলা চালায় জুয়েলের বাড়িতে।
আহত অবস্থায় জুয়েলকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে।
ক্র্যাক প্লাটুনের তথ্য ও সকলের পরিচয় জানার জন্য প্রচণ্ড অত্যাচার চালানো হয় তার উপর। যে হাত দিয়ে একদিন স্বাধীন বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিপক্ষের বোলারদের উপর চড়াও হতে চেয়েছিলেন, সে হাতের দুটো আঙ্গুল কেটে ফেলে নির্মম নিষ্ঠুরতায়। প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখেও একটা কথা বলেননি তিনি। ৩১ আগস্টের পর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, তাকে ৩১ আগস্ট ক্র্যাক প্লাটুনের অন্য যোদ্ধাদের সঙ্গে হত্যা করা হয়।
রুমী
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমী। তিনি সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি ঢাকায় ফেরত আসেন এবং ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেন।
রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে হামলা করা। এ সময় তাকে ঝুঁকিপূর্ণ আরো কিছু আক্রমণ পরিচালনা করতে হয়, যার মধ্যে ধানমণ্ডি রোডের একটি আক্রমণ ছিল উল্লেখযোগ্য। ধানমণ্ডি রোডের অপারেশনের পর রুমী তার সহকর্মীদের মাঝে আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে ছিলেন এবং ওই রাতেই বেশ কয়েকজন গেরিলা যোদ্ধার সাথে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।
হানাদাররা কোনো একটি অজ্ঞাত উৎস তথ্য জেনে টানা তিনদিন অপারেশন চালিয়ে রুমীসহ ঢাকার গেরিলা যোদ্ধাদের একটি অংশকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। রুমী ও তার সহযোদ্ধাদের আর কখনোই দেখেননি কেউ। কিন্তু তাঁদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।