তখন কলেজে পড়ি। ২০০৬ সালের ঘটনা। ময়মনসিংহ শহরে “এসো মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনি” অনুষ্ঠানে স্যারের সাথে প্রথম দেখা হয়। সেই অনুষ্ঠানে স্যারের বক্তব্য এবং একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করে। এরপর থেকে আমি স্যারের কোন লেখা দেখলেই পড়ার চেষ্টা করি, স্যার সংক্রান্ত যেকোন নিউজ মনোযোগ দিয়ে দেখি এবং নিজের মধ্যে অনুপ্রেরণা নেওয়ার তাগিদ অনুভব করে থাকি। ধীরে ধীরে স্যারের প্রতি ভাললাগা এবং ভালবাসা বেড়ে যায়।
ওই দিনের অনুষ্ঠানে গৃহীত সিদ্ধান্তটি ছিল এমন: মঞ্চে কেউই থাকতে পারবেন না, হোক তিনি প্রধান অতিথি কিংবা অনুষ্ঠানের সভাপতি। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা গল্প শোনাবেন সেখানে অন্য কেউ মঞ্চে বসাটা বেমানান। কারণ মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের প্রাণ। কাজেই সে সময়ের বর্ণনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে দামী এই স্বাধীন বাংলাদেশে আর কেউ হতে পারে না। স্যারের সেই সিদ্ধান্তে আমরা কলেজ পড়ুয়ারা পুলকিত হয়েছিলাম এবং উপস্থিত সকল অভিভাবক স্যারের সেই সিদ্ধান্তকে প্রবল করতালি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন। সেই দিনের কথা আজকে ভেবে আবারও পুলকিত হলাম। এমনিভাবে স্যার বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান সমুন্নত রাখা ও মর্যাদা বৃদ্ধি কল্পে নিরলস একজন যোদ্ধা হিসেবে কাজ করে চলেছেন।
একজন প্রকৃত কলম যোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি দুঃসময়ে জাফর স্যারের অবদানকে আমরা নতুন প্রজন্ম অত্যন্ত আবেগ দিয়ে উপলব্ধি করে থাকি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে স্যার যেমন সোচ্চার ছিলেন ঠিক তেমনি মুক্তমনা ব্লগারদের হত্যার প্রতিবাদেও সামনের কাতারে শামিল ছিলেন। সেই মানুষটি আজ ঘাতকের ছুরির আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
জাফর স্যার একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, দেশকে ভালবেসে আমেরিকার উচ্চ বেতনের চাকরি রেখে বিভিন্নভাবে দেশের জন্য যুতসই এবং তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। বিভিন্ন সময়ে মৌলবাদি গোষ্ঠী স্যারকে হত্যার উদ্দেশ্যে হুমকি দিয়ে আসছে এবং এ হামলা যে মৌলবাদিদের দ্বারা সংগঠিত হয়নি তা এখনো স্পষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। কারণ, হামলাকারী পুলিশের কাছে কোন কিছুই স্বীকার করছে না, যতটুকু স্বীকার করছে ততটুকুতে হামলার সুরাহা হচ্ছে না।
জাফর ইকবাল মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিকে নতুন প্রজন্মের তরুণদের ধাবিত করার প্রচেষ্টা চালান। কাজেই জাফর ইকবাল স্যারদের শত্রুর অভাব নেই এবং এটাই স্বাভাবিক। কারণ, যে দেশের একটি অংশ এখনো মুক্তিযুদ্ধকেই বিশ্বাস করতে চায় না, মুক্তিযুদ্ধকে ‘গণ্ডগোল’ বলে চালিয়ে দিতে চায়, সে দেশে জাফর স্যাররা কীভাবে নিরাপদে বসবাস করবেন? জাফর স্যারের মতো প্রতিভাবান দেশপ্রেমিকরা যেখানে অনিরাপদ সেখানে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
জাফর স্যার যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই প্রতিভার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বিদেশ থেকে এসে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে সিএসই বিভাগটিকে শুধু দেশ সেরা নয় সারা বিশ্বে যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিভার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। পাশাপাশি স্যারের কাছে লোভনীয় অফার আসা সত্ত্বেও কেবলমাত্র দেশপ্রেমের টানেই বিভাগে থেকে গেছেন। ছোটদেরকে পড়ার প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধির জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক বই লিখেছেন এবং যেগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পরীক্ষা পদ্ধতিতে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুকরণ ও দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের চিন্তার চিন্তক হিসেবে জাফর স্যার প্রণিধানযোগ্য। এই রকম একটা মেধাবী মানুষকে মৌলবাদচক্র সরিয়ে দিতে চাইবে স্বাভাবিকভাবেই। কারণ, প্রগতিশীল মানুষ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাহক হিসেবে যে ক’জন মানুষ এখনো বাংলাদেশে রয়েছে তাদের মধ্যে জাফর স্যার অন্যতম।
আমাদের দেশে টেলিভিশন টকশোতে বুদ্ধিজীবীদের অভাব হয় না। কিন্তু অভাব হয় টকশোতে বাচনকৃত কথামালার প্রয়োগের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে কোন জাতীয় সমস্যা কিংবা সংকটে তাদেরকে কখনোই প্রতিবাদমুখর হতে দেখা যায় না। দু এক কথা বললেই টেলিভিশনের পর্দায় বলেন, কখনো রাস্তায় নেমে আসে না। দীপন কিংবা অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পরে গণজাগরণ মঞ্চের কিংবা অন্য যেকোন প্রতিবাদমুখর ফোরামে জাফর স্যারের মুখটিই ভেসে উঠতো, অন্য কোন বুদ্ধিজীবীদের আমরা সচরাচর দেখতে পেতাম না। সুতরাং জাফর স্যারকে নিয়ে দেশবিরোধী চক্রের বিশেষ পরিকল্পনা থাকবে এটাই মেনে নিয়ে সরকারসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে সচেতন থাকতে হবে। একজন জাফর স্যার মৌলবাদিদের বিষবাষ্প উপেক্ষা করে দেশের মায়ায় এখনো বাংলাদেশে বসবাস করে দায়িত্বের সর্বোচ্চটুকু দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জাফর স্যারকে কেন আক্রমণের শিকার হতে হলো? সারাংশ আকারে বললে বলা যায়, দেশপ্রেমিক, মুক্তবুদ্ধির চর্চায় আসিন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সর্বদা সোচ্চার, মেধাবী শিক্ষক, মৌলবাদিদের বিরুদ্ধে সর্বদা প্রতিবাদমুখর ইত্যাদি কারণেই মূলত জাফর স্যারকে আক্রমণ করা হয়। কে আক্রমণ করলো জাফর স্যারকে? হাসপাতালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার বললেন, আক্রমণকারী বালকের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি এবং এ লেখার সময় পুলিশ ছেলেটি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারেনি।
তবে এর পিছনে যে দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য রয়েছে সেটি সহজেই অনুমেয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রগতিশীল মানুষদের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে জাফর স্যার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তাই জাফর স্যারের কন্ঠ স্তব্ধ করে দেয়াই হচ্ছে মৌলবাদিদের মুখ্য উদ্দেশ্য। ক্যাম্পাসে সবার সামনে প্রকাশ্যে দিবালোকে উদ্ভট যুবকের আক্রমণ সবকিছুকেই কেমন যেন বিষময় করে তুলেছে। জাফর স্যারের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করেছে প্রতিবাদি মানুষেরা।
তালিকা করে পূর্ব ঘোষণা দিয়ে মৌলবাদি গোষ্ঠী প্রগতিশীল মানুষদের একের পর এক হত্যা করে আসছে। কিন্তু রাষ্ট্র এর সুরাহা করতে পারছে না। রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতার কারণেই অনেক প্রগতিশীল মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন ব্লগার, লেখক, প্রকাশক খুন হয়েছেন। রাষ্ট্র কি পেরেছে এইসব খুনের সুরাহা করতে? পেরেছে কি এদের সাথে সম্পৃক্ত গডফাদারদের খুঁজে বের করতে? পারেনি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে একের পর এক হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। রাজীব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার করতে পারলে হয়তো নিলয় হত্যাকাণ্ড ঘটতো না। এমনিভাবে প্রকাশক দীপন, লেখক ব্লগার অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড ঘটতো না হয়তো। বিচারের আস্থায় দেশকে ফিরিয়ে আনতে পারলে জাফর স্যারকে আজকে হামলার মুখোমুখি হতে হতো না।
আক্রমণকারী যেহেতু ধরা পড়েছে সেহেতু তার কাছ থেকে হামলার পিছনে ইন্ধনদাতাদের যেকোন মূল্যে খুঁজে বের করতে হবে। একটা হামলার যোগসূত্র ও এর যথাযথ বিচারই পারে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীদের আশ্বস্ত করতে। তা না হলে রাষ্ট্র ক্রমশই ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে পরিণত হয়ে যাবে। হামলাকারী ছেলেটির পরিচয় পাওয়া গেছে। ছেলেটির নাম ফয়জুর রহমান। সে নিজেকে মাদ্রাসার ছাত্র বলে দাবি করলেও কোন মাদ্রাসায় পড়তো তা কেউ জানতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছেলেটির পরিবার বসবাস করলেও ঘটনার পরপরই ছেলেটির পরিবার বাসায় তালা দিয়ে অন্যত্র চলে যায়। সুতরাং সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে ঘটনার কার্যকারণ বের করে নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে একের পর এক হত্যাকাণ্ডে এবং আক্রমণে এ দেশ মৌলবাদিদের দখলে চলে যাবে এবং ধ্বংস হবে মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা।
জাফর স্যাররা হেরে গেলে বাংলাদেশ হেরে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হবে ভুলুন্ঠিত। মুক্তবুদ্ধির চর্চা কমে আসবে আর প্রগতিশীল মানুষগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে। এ রকম লোমহর্ষক হামলায় সাধারণ মানুষও নিরাপত্তাহীণতায় ভুগবে। স্যারের উপর হামলাকারীদের হোতাসহ পরিকল্পনাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে জনমনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। তাই সরকারের নিকট আবেদন থাকবে, যেকোন মূল্যে দেশের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য তড়িৎ গতিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে জনমনে শান্তি ফিরিয়ে আনুন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)