রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আকতার জাহান জলির মরদেহ উদ্ধারের পর যেমন শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঠিক তেমনই তার জন্য শোকলিপি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জুড়েও।
শোকগাঁথায় নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করছেন আকতার জাহানের পরিচিত ও প্রিয়জনেরা। ফেসবুকে অনেকেই প্রকাশ করেছেন নানা অভিব্যক্তি।
ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক লিখেছেন, ‘জলি আপা নেই, ভাবতেই পারছি না। মা আর ছেলের এই ছবিটা আমার বাসাতেই তোলা। শিক্ষার্থীজীবনে বিভাগে আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র ছিলেন। আমরা একই সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে জয়েন করেছিলাম। ঢাকায় চলে আসার পরেও ভালো যোগাযোগ ছিল। আমার স্ত্রীর খুব বন্ধু ছিলেন। শেষ কবছর যে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট আপনি পেয়েছেন, তার অনেকখানি জানতাম। এখন আপনি নিশ্চয়ই ভালো থাকবেন।’
সদ্যপ্রয়াত এই শিক্ষকের সাবেক শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক আবু সালেহ রনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আকতার জাহান জলি আপা আমাদের রিপোর্টিং পড়িয়েছেন। হত্যা-আত্মহত্যা যাই ঘটুক সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি। অনেক কিছুই শোনা যায়, সত্যটা পুলিশ বের করে আনবে, এটাই প্রত্যাশা। গত কয়েক বছর দুই ঈদে ম্যাসেজের রিপ্লাই পেতাম, নয়তো দুই-একদিনের মধ্যে ফোন দিয়ে খোঁজ নিতেন। এবার থেকে আর সেটি হবে না……’
একই বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক মাহমুদ সোহেল তার পোস্টে লিখেছেন, ‘প্রিয় আকতার জাহান (জলি) ম্যামের মৃতদেহ নিথর হয়ে তার বিছানায় পরে ছিল। হঠাৎ এমন সংবাদ শুনবো ভাবি নি। যেখানেই থাকবেন ভালো থাকবেন।’
গ্রিন ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতার শিক্ষক প্রিতু শরমিন লিখেছেন, ‘অনেকদিন পর হঠাৎই আপনার ফোন- প্রীতু আমি ঢাকায় এসেছি। জানো বর্ষার কাছ থেকে খবরটা শোনার পর থেকেই তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
আপ্লুত আমি বললাম- ম্যাডাম আমরা শেষ মেষ বেশ গুছিয়ে নিতে পেরেছি, খুব ভাল আছি আমরা।
আপনি বললেন- তাই? আমি জানতাম তোমরা অনেক ভালো করবে।
আমি বললাম- ম্যাডাম আপনাকে নিয়ে আসি। আমার সংসারটা দেখে যান একবার।
আপনি বললেন- ট্রেইনিং ছেড়ে কোথাও যেতে পারছি না রে। তারপর ব্যাকপেইনটা বেড়েছে খুব। তুমি কিন্তু ঠিকমত খাবে। নিজের যত্ন নেবে। আগামীবার ঢাকায় এসে তোমাকে দেখে যাবো। তোমাদের বাসায় থাকব একদিন…
আমি আমার কথা রেখেছি ম্যাডাম, খেয়েছি, নিজের যত্ন নিচ্ছি নিয়মিত। আপনি কিন্তু আপনার কথা রাখেননি। আবার ঢাকায় আসবেন বলেছিলেন, কই আসলেন না তো। আমি তো এখনও অপেক্ষায় আছি। আমাদের রিপোর্টিং পড়িয়ে নিজেই রিপোর্ট হয়ে চলে গেলেন অন্য দেশে… একদম ঠিক করেননি ম্যাডাম… ইটস নট ফেয়ার…’
আকতার জাহানের বন্ধু এবং কবি তপন বাগচি লিখেছেন, ‘জলি। আকতার জাহান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আমার সহাধ্যায়ী। তুই পেটের ছেলেটারে রেখে চলে যেতে পারলি? এত অভিমান তোর মনে জমেছিল? গত বছর যখন ড. সাজ্জাদ বকুলের নিমন্ত্রণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম চলচ্চিত্র-সেমিনারে বক্তৃতা করতে, তখন তোর সঙ্গে দেখা হলো। নিজের বাসা থেকে খাবার রেঁধে এনে তুই খাওয়ালি আলোকচিত্রশিল্পী আনোয়ার হোসেনকে। আমাকেও তার ভাগ দিলি। রাজশাহী যতবার গেছি, তোর সাথে দেখা হয়েছে।
আমি সাহিত্যচর্চা করি বলে কত গর্ব করতি! বলতি, ‘তপন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচ নির্ধারণ হয় কোনো ব্যাচে কে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়, তার নাম ধরে। কিন্তু আমাদের ব্যাচের পরিচয় দেয় সবাই ‘নায়ক ফেরদৌসের ব্যাচ কিংবা ‘কবি তপন বাগচীর ব্যাচ বলে।’ খুব হাসতাম শুনে।
তুই তো মানসিক ধকল কাটিয়ে উঠেছিলি বলে ধারণা করেছিলাম। তুই তো অনেক শক্ত মনের মানুষ। সেই তুই একা এই অকালে চলে গেলি। টেলিভিশনে স্ক্রলে তোর নাম দেখে রাজশাহীতে যাকেই ফোন করি, তাকেই ব্যস্ত পাই। পরে তোর ছাত্র মামুনকে ফোনে পাই। ও যখন তোর মরদেহ উদ্ধারের বর্ণনা দিচ্ছিল, আমি চোখের জল রাখতে পারি নি। আমাদের সহাধ্যায়ী বন্ধু মনসুরকে জানালাম। অ্যালামনাইয়ের কর্মী অনুজ সুজন মাহমুদকে জানালাম। আমার চোখের জল বুঝে তারা আমাকে সান্ত্বনা দিল।
তোকে চোখের জলে বিদায় দিচ্ছি, বন্ধু। আমারাও আসছি। কিন্তু তুই একটু বেশি আগে চলে গেলি। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুই নেই। আমার মনে হচ্ছে রাজশাহী গিয়ে ফোন করলেই তুই চলে আসবি। আসবি তো! আসিস।’
সাংবাদিকতার আরেক শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান তমাল তার ফেসবুক পোষ্টে জানতে চেয়েছেন এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা। তিনি লিখেছেন, রাবি সাংবাদিকতা বিভাগের আমাদের শিক্ষক জলি ম্যাডাম আর নেই! শুক্রবার বিকেলে ক্যাম্পাসের বাসা থেকে দরজা ভেঙ্গে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এটা কি আত্মহত্যা, হত্যা নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু? অকালে এভাবে ঝরে যাবার কথা ছিলো না তার। তার এই ঝরে যাওয়ার কারণ কী? সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানতে চাইতেই পারি…
অতীতের অনেক সময়ের কথা স্মৃতিচারণ করে সৌরভ হাবিব লিখেছেন, জলি আপা খুব কষ্ট পেয়েছি। এই তো সেদিনও বিভাগের সামনে দেখা হলো। মিষ্টি হেসে দাঁড়ালেন। তারপর বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন। তখন তো ভাবতে পারিনি- আপনি এভাবে চলে যেতে পারেন? যখন দেখেছি তখনই শান্ত, স্থির মায়া ভরা মুখে সুন্দর করে কথা বলেছেন। খোঁজ খবর নিয়েছেন। হয়তো কিছুটা জানতাম- কিছুটা কষ্টের বোঝা বইছেন, তাই বলে একেবারে চলে যাবার মতো কষ্ট??? জলি আপা, সত্যি বলছি- আপনার চলে যাওয়া কেউ মানতে পারেনি। পারার কথা নয়। আপনার সুইসাইড নোট বলছে আপনি আত্মহত্যা করেছেন, আবার এটাও বলছে, আপনাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে। যদিও আপনি তাদের দায়মুক্তি দিয়ে গেছেন।