চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আওয়ামী লীগ বনাম ক্ষমতালীগ!

দুর্দিনে যারা দলকে ও দলের রাজনীতিকে রক্ষা করেছে সুদিনে তারা কেন হারিয়ে যাচ্ছে? সম্প্রতি ছাত্রলীগ নেতা মোতাহার হোসেন রানার অসহায় ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসিম উদ্দিন হল শাখার সভাপতি ও মিরেরসরাই থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন এই মোতাহার হোসেন রানা। ৯০-এ স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের প্রথম কাতারের নেতা ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক সভায় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রানার ৫ মিনিট বক্তব্য শুনে মুগ্ধ হয়ে সভামঞ্চে বসেই তার নাম, ঠিকানা ডায়রিতে টুকে নিয়েছিলেন। ১৬ নভেম্বর ২০১৯ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মিরেরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। উপস্থিত দর্শকের সারিতে চেয়ারে চরম উপেক্ষিত ও অসহায়ভাবে বসেছিলেন এক সময়ের মাঠ কাঁপানো এই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোতাহার হোসেন রানা। কিন্ত সভামঞ্চে তারই হাতে গড়া কর্মী, সহযোদ্ধা অনেকে থাকলেও কেউ তার খবর নেয়নি৷ খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনাহূতভাবে বসে থেকেছিলেন তিনি।

রাজনীতিতে অর্থ-বিত্ত ও টাকা-পয়সা না থাকলে যে কোন মূল্যায়ন নেই এটা তার প্রমাণ নয় কি? খালেদ মাহমুদ ও জিকে শামীমের মত অনুপ্রবেশকারীরা মূল্যায়ন পেলেও মোতাহার হোসেন রানার মত ত্যাগীরা পায়না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কক্সবাজার মহেশখালী সম্মেলনে ঘটেছে বিস্ময়কর ঘটনা। সকালে আওয়ামী লীগে নাম লিখিয়ে বিকালেই হয়ে গেল ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি।

ফেরদৌস ওয়াহিদ শামীম নামের জামায়াত-শিবির পরিবারের এই কীর্তিমান সন্তানকে নিয়ে চলছে সরস আলোচনা। মহেশখালী দ্বীপের হোয়ানক ইউনিয়নে ৭ নম্বর ওয়ার্ডে রোববার এ কমিটি গঠন করা হয়।

দুধর্ষ শিবির ক্যাডার আকতার হামিদ ছিলেন জামায়াতের প্রয়াত আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের দেহরক্ষী। আকতার হামিদ ৩৫ টি মামলার পলাতক আসামি। ৩০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হামিদের চাচাতো ভাই নব্য আওয়ামী লীগ নেতা ফেরদৌস ওয়াহিদ শামীম। নির্বাচিত সভাপতি শামীমসহ পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় মিলে রোববার সকালে ৬৪ জন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। আলোচিত ওয়ার্ডটিতে কাউন্সিলরের সংখ্যা ১৫১ জন হলেও পরে তা বাড়িয়ে ২১৫ জন করা হয়। এদিন কাউন্সিলর হওয়া বেশিরভাগই আগে দলের সাথে যুক্ত ছিলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। পারিবারিক প্রভাব বজায় রাখতে তারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন৷ এভাবে কেন দুর্দিনের সাথীরা উপেক্ষিত ও অনুপ্রবেশকারীরা মূল্যায়িত হচ্ছে সর্বত্র?

হাইব্রিড, কাউয়া, মৌসুমী পাখি ও ফার্মের মুরগী ইত্যাদি যত বেশি বলা হয়েছে ততো বেশি তাদের সংখ্যা বেড়েছে। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের চেয়ারে বসে গেছে এইসব বিশেষণধারীর দল। আর মোতাহার হোসেন রানার মত ত্যাগীরা পড়ে যাচ্ছে পেছনে। ব্যবসায়ী ও আমলারা চলে যাচ্ছে নেতৃত্বের সামনের সারিতে। এখন টাকা পয়সা ও পেশি শক্তির মালিক না হলে রাজনৈতিক মেধা যোগ্যতায় আর কেউ নেতা হতে পারছে না। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ করে আওয়ামী লীগ নেতা হতে পারছে না কিন্তু জামায়াত শিবির, বিএনপি ও ফ্রিডম পার্টি হতে এসে টাকার জোরে নেতা হয়ে যাচ্ছে অনেকেই। ধানের শীষে মনোনয়ন দিয়ে যে ব্যক্তি নৌকার বিরোধিতা করেছে সেই ব্যক্তিকেই পরবর্তীকালে দেখা যায় নৌকার মাঝি হয়ে যেতে। আর এতে বিব্রত ও বিভ্রান্ত হয় দুর্দিনে দলীয় ঝান্ডা উঁচিয়ে রাখার ত্যাগী নেতা-কর্মীরা। কিন্তু মোতাহার হোসেন রানার মত লোকেরা দুর্দিনে ছিল বলেই কি সুদিন এলো না? মাঠ পর্যায়ের বাস্তব চিত্রে বেরিয়ে এসেছে যে ২০০৯ হতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিপুল পরিমাণ অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে এবং এদের একটি বড় অংশ বিএনপি-জামায়াত হতে এসেছে। এরা অর্থ, ক্ষমতা এবং নানা কুটকৌশলের মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের কমিটিগুলোও দখল করে ফেলেছে।

উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোর মধ্যে অধিকাংশ পদই দখল করে আছে এই সমস্ত অনুপ্রবেশকারীরা। জানা গেছে এমন প্রেক্ষাপটেই আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগের উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় বা মহানগর পর্যায়ে কোনো কমিটিতে থাকতে গেলে তাকে অবশ্যই ২০০৯ সালের আগে থেকে আওয়ামী লীগে থাকতে হবে। কিন্তু আদৌ কি তা বাস্তবায়ন হবে? তাহলে ২০১৯ সালের এক সকালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে বিকালে সভাপতি হয়ে যাচ্ছে কিভাবে? ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় অনুপ্রবেশকারীদেরকে দেখা যায়না। যারা এসেছে তারা কি আওয়ামী লীগ করতে এসেছে না ক্ষমতালীগ করতে? ১৯৭৫ সাল হতে ১৯৯৫ সালে কি এমন অনুপ্রবেশকারী ছিল? ১৯৯৩ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন মোতাহার হোসেন রানা। দুর্ঘটনার সময়ও তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। মিরেরসরাইয়ে দুর্ঘটনার পর তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তখনকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি করা হয়। তার চিকিৎসক ছিলেন দেশসেরা নিউরো সার্জন রশিদউদ্দিন আহমেদ। তার সহকারী ছিলেন বিএসএমএমইউর বর্তমান ভিসি কনক কান্তি বড়ুয়া। রানার আঘাত খুবই গুরুতর ছিল। সবাই তাঁর বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। একাধিকবার তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯ দিন অচেতন থাকার পর জ্ঞান ফেরে তার। কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেলেও মস্তিস্কে গুরুতর আঘাতের কারণে আর কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। তারপর থেকেই চলছে তার জীবনযুদ্ধ। ৩ ছেলে, ৩ মেয়ে নিয়ে তার পরিবারটিকে মানবেতর জীবন পাড় করতে হচ্ছিল।

কেন মোতাহার হোসেন রানারা দলে উপেক্ষিত হচ্ছে? কেন ক্ষমতার ঝাড়বাতিতে হারিয়ে যাচ্ছে তারা? এই রানারাই কি দলের কোষ নয়? তবে কেন এই কোষগুলো এমন অপুষ্ট হচ্ছে পুষ্টির অভাবে। মোতাহার হোসেন রানারা আজ নেতৃত্বের কারণে নয় অসহায়ত্বের কারনে সংবাদ পত্রের শিরোনাম হয়। দুর্দিনের ত্যাগীরা নয় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের সম্মুখ সারিতে চলে আসছে ক্ষমতালীগের ভোগীরা। রানারা ত্যাগ করবে ও দলকে রক্ষা করবে আর ভোগীরা ভোগ করবে তবে কি এটাই রীতি হয়ে গেল? এই রীতিটা কী ভয়ংকর অশুভ রীতি নয়? আজ নেতৃত্বে চলে যাচ্ছে দুর্দিনে দলের শত্রু শিবিরে থাকা অনুপ্রবেশকারী, ব্যবসায়ী, আমলা ও দুর্বৃত্তরা। আজ দল ঠিক করতে শুদ্ধিকরণ অভিযান পরিচালনা করতে হয়। সরকার ঠিক করতে প্রয়োজন হয় দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের। কেন দলের সদস্যপদ দেয়ার সময় তার অতীত রাজনীতির বিবরণ নেয়া হচ্ছে না? এসব সদস্যপদ কোন যুক্তিতে দেয়া হল? কেন দিল ও কারা দিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবে কে? কেন সমস্যা সৃষ্টি করে সমাধানের চেষ্টা করা। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের একটি উক্তি এ উপলক্ষ্যে প্রণিধান যোগ্য- পার্টি যখন আক্রান্ত তখন দরজাটা খুলে রেখো। কারণ যারা আসবেন কিছু পেতে নয়, নির্যাতন ও জেল, গুলি সহ্য করতে আসবেন। পার্টি যখন শাসনে আসে, কিছু দেয়ার ক্ষমতা রাখে, তখন দরজাতে পাহাড়া বসাও।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)