বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগে আদর্শিকতার কর্তৃত্ব এখন প্রশ্নবিদ্ধ। দলটিতে কেউ নেতা আর কেউ কেউ অভিনেতা। কে নেতা আর কে অভিনেতা সেটা চেনাই আজ কঠিন হয়ে উঠছে।
এসব অভিনেতাদের নিয়ে সংবাদপত্র ও সোশাল মিডিয়া সূত্রে চমকপ্রদ সব খবর বেরোচ্ছে। আওয়ামী লীগের সভায় নেতাদের কেউ কেউ এখন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন! আবার কেউ নারায়ে তকবির ও আল্লাহু আকবর বলে স্লোগান দিচ্ছে। আবার কেউ বাহাত্তরের সংবিধানের বিপরীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পক্ষে কথা বলছে। তবে যারা চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নির্যাতিত হয়েছিল, ক্ষমতাকেন্দ্রিক সুবিধাবাদীদের দাপটে তারা আজ চরমভাবে উপেক্ষিত।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় অনেক বিচিত্র অভিনেতার উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। বিএনপি ও জামাতের নেতা ঠাঁই পেয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের কমিটিতে। নির্বাচনেও পেয়ে যাচ্ছে নৌকা প্রতীক। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যে ছিল ডাকসাইটে আমলা এখন এসে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মূলধারায়। তারাও এখন আওয়ামী লীগের নেতার অভিনয় করে চলছে। অভিনেতারা বঙ্গবন্ধুর স্তুতি করে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শিকতার দিক থেকে থাকে নীরব ভূমিকায়। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর নামে বই লেখে কেবলই নেত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নয়।
এসব অভিনেতারা বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কোন প্রকার উচ্চবাচ্যই করে না একটি বিশেষ মহলের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে। হেফাজতে ইসলামের ব্যাপারেও তারা থাকে নীরব ভূমিকায়। আর এদের জন্যই হয়তো আওয়ামী লীগ এতদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার পরও রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বাতিলের দাবি সোচ্চার হতে পারছে না। সংসদে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের পক্ষে তাই আওয়ামী লীগের কেউ ছিল না। কয়েকজন ১৪ দলীয় বাম সাংসদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পক্ষে মত না দিয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সংখ্যালঘু সাংসদরা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের পক্ষে কথা বলতে সাহস পেলেন না। এতেও কি প্রমাণ হয় না অভিনেতারাই নেতৃত্বের কর্তৃত্বে? আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল তখন ১৪ দলের নেতারাই রাজপথে ছিল, অভিনেতারা ছিল না। আর ক্ষমতায় যাওয়ার পর ১৪ দলও পিছে পড়ে যায়, সামনে চলে যায় অভিনেতাদের সুবিধাবাদী দল। অথচ বিরোধী দলে থাকার সময় এসব অভিনেতারা ছিল চারদলীয় জোট সরকারের পক্ষে।
রাজপথে একসাথে আন্দোলন করে ১৪ দল। সেসময় এ জোটটির ছিল বিশাল গুরুত্ব। ক্ষমতায় গেলে ১৪ দলের নেতারাও গুরুত্ব হারায়। অভিনেতারা গুরুত্ব পেতে থাকে। এক কথায় দুঃসময় ও দূর্দিনে পাশে থাকে নেতারা আর সুদিনে অভিনেতারা। সম্প্রতি র্যাব, সেনাবাহিনী প্রধান ও পুলিশ প্রধান সহ কতিপয়ের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে খুবই বিব্রতবোধ করছে সরকার। বিগত দিনের নির্বাচনগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে ধরে নিচ্ছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা। তারা আগ্রহী হয়ে উঠছে আগামী নির্বাচন পর্যবেক্ষণের প্রতি।
এছাড়াও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নে চরম বিব্রতবোধ করে চলছে সরকার। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বাম গণতান্ত্রিক জোট হরতাল ডেকেছে। এ হরতাল ঢিলেঢালা পালন হলেও মানুষ একে যৌক্তিক দাবী হিসাবেই দেখছে। আগামী নির্বাচনও এসে যাচ্ছে। এক কথায় বিপদ দেখলেই যেন নড়েচড়ে উঠে আওয়ামী লীগ। বিগত নির্বাচনের সময় নিরংকুশ ক্ষমতার সম্ভাবনা দেখে যে ১৪ দলকে বিরোধী দল হতে বলছিল এখন আবার তাদেরকে ডেকেই জোটকে সক্রিয় হতে বলল। আওয়ামী লীগের এই দ্বিমুখী নীতির পেছনে কী যৌক্তিকতা তাও তারাই জানে। রাজনৈতিক দলগুলোর জোটবদ্ধতার পূর্ব শর্ত হল সমমনা আদর্শিক ভিত। কিন্তু এই আদর্শিকতা থাকবে নিশ্চয়ই নেতাদের অভিনেতাদের নয়। অভিনেতারা কখনও কালো সানগ্লাস পড়বে আবার কখনও গায়ে মুজিব কোট জড়াবে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ অভিনেতাদের স্বভাবই রঙ বদলানো। নেতা ও অভিনেতাদের সংমিশ্রণ খুবই ভয়ের নয় কি?
আওয়ামী লীগের উপর বিপদ নেমে এলে অভিনেতাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু নেতারা তো অভিনয় বুঝে না। তারা যাবে কোথায়। সম্প্রতি ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এক ভয়াবহ তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি ও তারেক রহমান ক্ষমতায় এলে একদিনে ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারাবে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের লোকদের ঘাড় ধরে বের করে দেবে। তার ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হলে তখনো প্রাণ হারাবে নেতারাই। অভিনেতারা তখন মুজিব কোট বাদ দিয়ে কালো সানগ্লাস পরা শুরু করবে। যেমন ১৫ আগস্টের পরে এসব অভিনেতারা ভোল পাল্টে ফেলে। তবু কেন নেতাদের বাদ দিয়ে অভিনেতাদের গুরুত্ব দেওয়া? আওয়ামী লীগ অনেকটা বেঁচে যাচ্ছে বিএনপি একটি অযোগ্য, বিশৃংখল, ভীতু ও অনাদর্শিক দল বলে। বামদলগুলো হরতাল ডাকার ও বিক্ষোভ করার সাহস পায় কিন্তু তারা পায় না।
মানুষও নিরূপায়। আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হলেও বিকল্প হিসেবে তারা যাবে কোথায়? একক কিংবা বাম জোটগত ভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো সাংগঠনিক ভিত্তি বামপন্থীদের নেই। বিএনপির আদর্শিক দিকও তাদের পছন্দ নয়। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সংবিধান হতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র কেটে দিয়েছেন। তারা ক্ষমতায় গেলে অতীতের মতো আবারও নিশ্চয়ই মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে সাম্প্রদায়িক জঙ্গী গোষ্ঠী। সুতরাং অসাম্প্রদায়িক, শান্তিপ্রিয় ও প্রগতিবাদী মানুষেরা বিএনপিকে কী করে সমর্থন দিতে পারে। তারা ক্ষমতায় গেলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে যুদ্ধাপরাধীর পক্ষের প্রজন্মরা। তারা চ্যালেঞ্জ করবে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায়কে। আর এজন্যই মানুষ আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হলেও এর বিকল্প হিসাবে বিএনপিকে বেছে নিতে পারছে না। এই সুযোগটাকেই নিচ্ছে না কি আওয়ামী লীগ?
বঙ্গবন্ধুর নাম স্তুতি নয় প্রয়োজন তার আদর্শিকতার স্তুতি। অথচ এসব স্তুতিকারদের অনেকেই আওয়ামী লীগের মত কথা না বলে বলে আওয়ামী মুসলিম লীগের মতো। বলে বিএনপি জামাতের মতো। নইলে রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে নারায়ে তাকবির/আল্লাহু আকবর কী করে বলে? দলটি তো আওয়ামী মুসলিম লীগ নয় আওয়ামী লীগ।এখানে হিন্দু আছে, বৌদ্ধ আছে ও খ্রিস্টান আছে। তারা তো নারায়ে তাকবির/আল্লাহু আকবর বলে না। তবে কেন এই সাম্প্রদায়িক স্লোগান? ভারতে জয় শ্রীরামের বিপরীতে মুসকান নামক একটি মেয়ের আল্লাহু আকবর বলার মতো এখানেও যদি জয় শ্রীরাম বলা শুরু হতো কেমন হতো ব্যাপারটা?
অভিনেতাদের কেউ আমলা,কেউ পুঁজিপতি,কেউ বিএনপি, কেউ জামাত। তারা সকলে মিলে কি দলটিকে আওয়ামী লীগ হতে আওয়ামী মুসলিম লীগে ফিরিয়ে নিচ্ছে? কেন এই অভিনেতা তোষণ? অভিনেতারা অভিনয় মঞ্চে অভিনয় করবে রাজনৈতিক দলে নয়। তারা থাকবে বিভিন্ন নাট্য সংগঠনে। রাজনৈতিক দল হবে নিজ নিজ আদর্শিক ধারার নেতাদের। এখানে অভিনেতাদের উপস্থিতি কাম্য নয়। অভিনেতারা হলো সুসময়ের স্তুতিকার। তারা দলীয় ক্ষমতার সুবিধাটা নিতেই তৎপর থাকে। দলের ক্ষমতা পাল্টালে তাদের অভিনয়ও পাল্টায়। তবু তাদেরই উপর কেন এই নির্ভরতা? এই সহজ প্রশ্নটার উত্তর দেবে কে? আর এই নির্ভরতা কিন্তু সুফলতা নয় কুফলতাকেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)