তৃণমূলে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে কতটা সুসংহত-ঐক্যবদ্ধ এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলের অনেক নীতি নির্ধারকরাই কথা বলছেন। বিভিন্ন সময়ে আলোচনা ও বক্তব্যে সতর্ক করছেন। দলীয় সভানেত্রীসহ সাধারণ সম্পাদক সর্বত্রই বলছেন আগামী নির্বাচন মোকাবিলা করতে হলে, নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে তৃণমূলে দলকে কঠিন ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। দল ঐক্যবদ্ধ না থাকলে দলের জন্যে তা বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এসব বিষয়েই বলতে গিয়ে কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের একটি সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আবার একধাপ এগিয়ে গিয়ে দলীয় নেতা কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘দল ক্ষমতায় না থাকলে টাকা পয়সা নিয়ে পালাতে হবে।’ রাজনীতির ময়দানে ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য এখন মুখে মুখে ফিরছে। বক্তব্যটি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ এখনও চলছে।
গতকাল ২০ মে গণভবনে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। যে বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সেখানেও মূল আলোচ্য বিষয় ছিল- তৃণমূলে আওয়ামী লীগের ঐক্য-অনৈক্য, বিভেদ-ভেদাভেদ এবং আগামী দিনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা কৌশল। বর্ধিত সভার আলোচনার খবর দেশের শীর্ষ মিডিয়াতে যেভাবে এসেছে তাতে করে এটি স্পষ্ট যে, তৃণমূলে আওয়ামী লীগের অবস্থান খুব একটা সুসংহত, শক্তিশালী নয়। এর প্রধান কারণ জেলা থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত চরম দলীয় বিভেদ, মতপার্থক্য স্পষ্ট। কোথাও কোথাও তা ভয়ংকরও বটে। বিশেষ করে মন্ত্রী, সাংসদদের সাথে নেতা-কর্মীদের আস্থা-বিশ্বাসের জায়গাতে তৈরি হয়েছে এক বিরাট ফাটল। কারো প্রতিই কারো যেনো বিশ্বাস আস্থা নেই।
বেশিরভাগ জেলা-উপজেলাতেই আওয়ামী লীগ এখন দ্বিধাবিভক্ত। দলীয় কোন্দলের কারণে কোথাও কোথায় হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। অনেক জেলাতেই এখন দুই পক্ষ আলাদা মিটিং, সভা করে। কোথাও কোথাও তিন চার পক্ষও রয়েছে। আবার অনেক জায়গাতে রাজনীতি পুরোটাই কোনো না কোনো ব্যক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে সবার অংশগ্রহণে যেভাবে দলীয় কর্মসূচি, নির্দেশনা পালন হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। একদল রাজনীতির মাঠে থাকলে আরেকদল নিশ্চুপ থাকছে।
গণভবনের বর্ধিত সভায় দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনেও তাই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই খোলামেলা আলোচনা করেছেন। বলেছেন তৃণমূলে দলের প্রকৃত অবস্থার কথা। বর্ধিত সভায় মাঠ পর্যায়ের নেতাদের বেশিরভাগই মন্ত্রী সাংসদদের দলীয় কর্মকাণ্ড, অযাচিত সিদ্ধান্ত, নিজ স্বার্থ হাসিল করতে গোপনে গোপনে দলের ভেতরে বিএনপি-জামাতের নেতাকর্মীদের জায়গা করে দেওয়া, অনৈতিক লেনদেন- এ সব বিষয়ে দলীয় সভানেত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, মন্ত্রী সংসদদের মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মী এবং সাধারণ জনগণের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। বিষয়টি নিয়ে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাও চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে সতর্ক করেন। তিনি নিজেই বলেন, নিজ দল ভারি করার স্বার্থে অনেকেই জামায়াত এবং বিএনপির লোককে এনে আওয়ামী লীগে জায়গা করে দিচ্ছে। গণভবনের সভায় যারা তৃণমূল নেতাদের নিয়ে অভিযোগ করেছেন তারা একটু মিথ্যা বলেননি, সত্যটাই তুলে দিয়েছেন।
পর্যবেক্ষণ এবং অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি জেলাতেই আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত। অনেক জেলাতে কোনো ধরনের দলীয় কর্মকাণ্ড নেই। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে প্রচুর কর্মসূচি থাকলেও অনেক জেলাতেই দেখা গেছে এ বিষয়ে কোনো ধরনের কর্মসূচি পালন করেনি, নিরুত্তাপ থেকেছে। অনেক জেলা উপজেলাতে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে ঐক্য না থাকার অন্যতম কারণ হলো সাংসদসহ কিছু উপসারির নেতার দখলদারিত্ব, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা। এসব কারণে অনেক জায়গাতে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের চরমভাবে অপমানিত হতে হয়েছে, লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ে প্রায় ঘরে ঘরে এখন যে বিরোধের আগুন তৈরি হয়েছে তার বড় একটি কারণ হলো সর্বশেষ ইউপি এবং জেলা পরিষদের নির্বাচন।
প্রথমবারের মতো গত বছরের মার্চ মাস থেকে ধাপে ধাপে দেশের সবগুলো ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দল থেকে যে প্রক্রিয়ায় মনোনয়ন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়- সেখানে সেই নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়। মন্ত্রী সাংসদ আর তাদের সমর্থনপুষ্ট নেতারা অনেকটা নিজেদের মতো করে, নিজেদের স্বার্থ দেখে কেন্দ্রে নাম প্রেরণ করে। এখানেই শেষ নয়। এক্ষেত্রে অনেক টাকা-পয়সারও লেনদেন হয়। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ের উপরসারির নেতারা মনোনীত চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নগদ টাকাসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা গ্রহণ করে। আবার অনেক জায়গাতেই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকেরা দলের নেতা কর্মীদের কাছেই চরমভাবে নিগৃহীত হন। আবার অনেক জায়গাতে স্থানীয় সাংসদ নিরবে দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থীর উপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে বিত্তবান স্বতন্ত্র বা অন্যদলের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে তার জয়ের পথ সুগম করে দেন। যেমন দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরও ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার আবাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন মৃধা। স্থানীয় সাংসদ সমর্থন না দেওয়ায় তিনি রাজনীতির মাঠ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। এখানেই শেষ নয়, এরপরেও বীরমুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন মৃধাকে গত বছরের অক্টোবরে কিছু দলীয় কর্মীদের হাতে নির্মমভাবে প্রহৃত হতে হয়। ঝিনাইদহের শৈলকুপার মতো আরও অনেক জায়গাতেই এ ঘটনা ঘটেছে। অনেক জায়গাতেই মন্ত্রী, সংসদদের পোষ্য এবং আশ্রিতদের হাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতা-কর্মীদের নির্যাতিত, লাঞ্ছিত এবং অপমানিত হতে হয়েছে। যশোরের ঝিকরগাছার শিমুলিয়া ইউনিয়নের সভাপতি মতিয়ার শিকদারও চেয়ারম্যান নির্বাচনে নৌকা পেলেও বিজয়ী হতে পারেননি উপরের নেতাদের নির্দেশে। এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে। আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া, রাজনীতি করতে গিয়ে সর্বস্ব হারানো অনেককেই দলীয় নেতাকর্মীদের হাতে নির্যাতিত, লাঞ্ছিত হতে হয়েছে।
আসলে যারা আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে তাদের বড় অংশের পক্ষেও নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভব ছিল না বলেই অনুমিত ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গাতে মন্ত্রী, এমপিরা চরমভাবে হস্তক্ষেপ করে নির্বাচনী ফলাফল নিজেদের পক্ষে আনেন। এ সব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন জেলা, উপজেলাতে চরম অসন্তোষ তৈরি হয়ে আছে। অনেকের মতেই সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব অসন্তোষের সন্তোষজনক ফয়সালা না হলে নেতিবাচক প্রভাব যে পড়বে না তা নয়।
আওয়ামী লীগের তৃণমূলে যে চরম অসন্তোষ বিরাজমান রয়েছে তারা সর্বশেষ প্রমাণটা হলো জেলা পরিষদের নির্বাচন। এই নির্বাচনও প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে হয়। দল থেকেই প্রার্থী মনোননয়ন দেওয়া হয়। জেলা পরিষদের নির্বাচনে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ করেনি। মূলত আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলীয় জোটের নেতারাই এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু দল থেকে মনোনয়ন দেওয়ার পরও দেখা যায়, দলীয় মনোনয়নের বাইরে বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে ১২ জন দলীয় প্রার্থী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনে পরাজয় বরণ করেছে। দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে জয়লাভ করে ২৫ জন প্রার্থী। আর ২১ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের মতেই, জেলা পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু হলে আরও বেশিরভাগ জায়গাতেই বিদ্রোহী প্রার্থীরাই জয়লাভ করতো। কেননা অনেক জায়গাতেই নৌকার প্রার্থীরা ক্ষমতা এবং অন্যান্য প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে এক অর্থে ভোটারদের কিনেও নেয়।
তৃণমূলে হালে বড় যে বিবাদ তৈরি হয়েছে সেটা হলো-মন্ত্রী, এমপিদের কৃপায় নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সাথে থানা ও ইউনিয়ন নেতাদের মতপাথর্ক্য। বেশিরভাগ জেলার এমপি ইউপি চেয়ারম্যান নির্ভর রাজনীতি করছেন বলে অভিযোগ আছে। সরকারি বিভিন্ন সুবিধা বণ্টনসহ সবকিছুর মধ্যে চেয়ারম্যানরাই অগ্রগণ্য থাকছেন। কিন্তু সেখানে ভীষণরকম উপেক্ষায় থাকছেন ইউনিয়নের নেতারা। ইউনিয়নের নেতারা মনে করেন, চেয়ারম্যান নন তৃণমূলের প্রাণভোমরা হলো ইউনিয়ন পর্যায়ের সংগঠকরা। কিন্তু মন্ত্রী, এমপিদের কাছে তারা ভীষণ উপেক্ষিত।
তৃণমূলে আওয়ামী লীগের নিজেদের ভেতর এখন যে বাদ বিবাদ বিদ্যমান তা প্রশমন করতে হলে আওয়ামী লীগকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দ্রুত সবার অংশগ্রহণে সমন্বয়মূলক সভা করতে হবে। যে সব জেলা এবং উপজেলাতে প্রকাশ্য বিরোধ রয়েছে সেখানে সভা করে বিবাদ মেটাতে হবে। এভাবে ভাবার কোনো অবকাশই নেই যে, জাতীয় নির্বাচনই এলেই রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে অনেকেই অনেক কিছু ছাড় দিলেও এবার আওয়ামী লীগ তৃণমূলে সু সংগঠিত দল সত্য, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটাতে না পারলে তার বড় খেসারত দিতে হবে। কারণ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্যাতিত-নিপীড়িত, বঞ্চিত, জেলা-উপজেলার উপেক্ষিত আওয়ামী লীগের লড়াই যে হবে না এর কোনো গ্যারান্টি নেই। তৃণমূলের ভেতরে ভেতরে কিন্তু ভীষণরকম আগুন জ্বলছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)