কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতায় লিখেছিলেন:
‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।’
আবার আমরা তো জানি সেই অমোঘ বাণী: বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।
তো যা হোক, আঠারো সংখ্যাটিই আমাদের মুখ্য বিষয়। এই বয়সটা কী দুঃসহ, দুঃসাহসেরা দেয় উঁকি। আবার বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। কী সাংঘাতিক সব ব্যাপার-স্যাপার!
আঠারো মাস। বছরের হিসেবে দেড় বছর। সামনের এই আঠারোটি মাস আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন পরীক্ষার মাস। বলা যায়, শিক্ষার্থীরা যেমন প্রথম শ্রেণী থেকে দশটি ক্লাশ শেষ করার পর এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়, তেমনি দুই দফা ক্ষমতায় থেকে দশটি বছর পার করবে আওয়ামী লীগ আগামী ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। তারপর একাদশ সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগের জন্য তো নিঃসন্দেহে এসএসসি পরীক্ষার টেনশনের মতই আগামী নির্বাচনটি। এমনিতেই নানা দুর্যোগ যাচ্ছে এ সরকারের আমলে। যার অনেকগুলোই ঘুরে-ফিরে সরকারের ওপরেই বর্তায়।
এসএসসি পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীরা কঠিন অধ্যাবসায় আর রুটিনমাফিক জীবনযাপন করে থাকে। কখনো কখনো খাওয়া দাওয়া ভুলে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে। কারণ দশ বছরের শিক্ষাজীবন শেষে একটি সনদ তারা অর্জন করতে যাচ্ছে। সেই সনদটি যাতে পরিবারের, বিশেষ করে অভিভাবকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় সেজন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে পড়াশোনা করে যায় প্রতিটি শিক্ষার্থী।
আর আওয়ামী লীগের জন্য এবারের সনদটি সেই এসএসসির সনদের চেয়ে আরও কঠিন। কারণ এবারের ফলাফল যাতে দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় সেই চেষ্টা তারা করবে। গতবারের মত যেন সমালোচনার মুখে পড়তে না হয়। (যদিও এর আগেরবার বিএনপির গোয়ার্তুমিই আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় বসার পথকে সুগম করেছিল।) তারা এবার ভোটে জিততে পারলে হ্যাট্রিক করবে ক্ষমতায়।
হ্যাট্রিকের কথা ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেই দিয়েছেন, তারা এবার হ্যাট্রিক করবেন। কাদের সাহেব নেতাকর্মীদের হুশিয়ারী উচ্চারণ করে পৃথক অন্য একটি জায়গায় বলেছিলেন, এবার ক্ষমতায় আসতে না পারলে দেশে থাকা লাগবে না। দেশ ছেড়ে পালাতে হবে, এই রকম একটি মন্তব্যও করেছেন। অর্থাৎ যেকোনো উপায়ে জনগণের মন জয় করে ক্ষমতায় আসতেই হবে, এটি তার কথার সারবস্তু ছিল।
ইদানিং নির্বাচন নিয়ে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের কথাবার্তাই বেশি শোনা যাচ্ছে। বলা যায়, আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগই বেশি চিন্তিত। এই চিন্তা সরকার প্রধান থেকে শুরু করে একেবারে নেতাকর্মীদের ভেতর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তৃণমূলের অবস্থা দুর্বল বা নাজুক এটা প্রধানমন্ত্রী নিজেও অনুভব করেন। তাই তাকে বলতে শোনা যায়, দল ভারি করার স্বার্থে বিএনপি-জামায়াতের দাগি লোকদের দলে ভেড়ানো হচ্ছে। মামলা থেকে বাঁচতে এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ভাগিদার হতে এরা আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছে। এরা দলে ঢুকে এতটাই শক্তিশালী হয়ে যায়, এদের কনুইয়ের গুঁতায় দলের নিবেদিত নেতাকর্মীরা টিকতে পারে না। এসব আবর্জনা দলে না টানার পরামর্শ দিয়েছেন।
ক্ষমতায় দুইবার থাকার কারণে দেশের সবখানেই সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের ভেতর স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী অনুধাবন করতে পেরেছেন। তাই নেতাকর্মীদের সাবধান হতে বলছেন প্রায়ই কোনো না কোনো সভা বা সেমিনারে। এটা সত্যিই আশার কথা। কিন্তু তারপরেও কি থামছে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম?
২০১৪ সালে যাদেরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল এবার তাদের অনেককে বাদ দেওয়া হতে পারে, এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। কারণ তারা যেভাবে সাংসদ হয়েছিলেন তাতে তারা নির্বাচনী আমেজে লড়াই করে মানুষের মন জয় করার কষ্টটা বুঝতে পারেনি। তারা পেয়েছিলেন তৈরি মসনদ। এ কারণেই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হয়, তাদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি সরকারকে বলতে হয়, এগুলো বোঝার চেয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন।
এবারের কঠিন পরীক্ষার বিষয়টি হচ্ছে, এসব সাংসদদের জায়গায় কাদেরকে দেওয়া দরকার, সেই বিচারের ভার কাদের ওপর দেওয়া যায়? সেই নির্বাচনটা যদি ভুল হয় তা হলে একেবারে মাঠে মারা। তৃণমূলে ত্যাগী তরুণ নেতার বড় অভাব। যারা আওয়ামী লীগকে বুকে ধারণ করতে পারবে। যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে, স্বপ্নকে মননে ও মগজে স্থান দিতে পারবেন শ্রদ্ধার সাথে।
ইতোমধ্যে আরেকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী। সেটি হচ্ছে সারাদেশের গ্রামগঞ্জে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে সাধারণ মানুষকে এক করে নেতাকর্মীদের উঠান বৈঠক। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আমজনতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সভা-সমাবেশের চাইতে উঠান বৈঠক বেশি কার্যকর বলে নেতারা মনে করেন।
গত ৩ জুলাই থেকে শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে এই উঠান বৈঠক করার চিঠি পাঠানো শুরু হয়েছে সারাদেশে।
আরও জানা গেছে, সারাদেশে যেখানে যেখানে দলীয় কোন্দল রয়েছে, সেখানে তা মিটিয়ে ফেলার জন্য নেতাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওই চিঠিতে। পাশাপাশি নিষ্ক্রিয়দের তালিকাও করে কেন্দ্রে পাঠাতে বলা হয়েছে।
এতে করে এটাই প্রতীয়মান হয় না যে আওয়ামী লীগের নিজেদের ঘর সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন? তাদের ভেতরে শঙ্কা ঢুকে গেছে, তাদের ঘরে উইয়ের বসবাস। এই পোকা সরাতে না পারলে তুষের ঘরের মত তাদের ঘর ধ্বসে যাবে।
সামনের আঠারো মাস খুব হিসেব করে পা ফেলতে হবে। খুব হিসেব করে কথা বলতে হবে। এমন কোনো কথা বলা যাবে না, যা আবেগের ঘোরে বা ক্ষমতার দাপটে বলে ফেললাম, পরে শুধরানো যাবে। সেই সুযোগ থাকবে না। মানুষের আস্থা অর্জন করার মত কাজ এবং পরিকল্পনাও গ্রহণ করতে হবে। সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত হচ্ছে সারা দেশে প্রার্থী নির্বাচন। সেই কাজটা করতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। টাকার বিনিময়ে প্রার্থী বাছাইয়ের দিন শেষ।
সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে কাজটি করলেই দুঃসহ মনে হবে না কোনো কিছুই। স্পর্ধায় মাথা তুলে দাঁড়াবার ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব। সামনের আঠারোটি মাস কাটুক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে। যে সিদ্ধান্ত সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহায়ক হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)