২০০১-এর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট জেতার পর থেকে দেশব্যাপী ধর্ষণের উৎসব চলছিল। হিন্দু মেয়েরা ছিল রাজনৈতিকভাবে উৎসাহিত সেই দলগত ধর্ষণের প্রধান শিকার। এছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করে, এমন পরিবারের নারীরাও ব্যাপকমাত্রায় নির্যাতিত হয়েছিল। তৎকালীন সরকার কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ব্যাপক লেখালেখির পরও।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পরও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ভোটের রাতে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে এক গৃহবধূকে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করে আমাদের রাজনীতি বদলায়নি, আমাদের মন-মানসিকতা বদলায়নি। ধর্ষণের ক্ষেত্রে কেবল পক্ষ বদল হয়েছে। জামায়াত-বিএনপির পরিবর্তে এবার ধর্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা।
এমন একটি জঘন্যতম ঘটনা ঘটার এক সপ্তাহ পরও শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সেখানে যাননি, পরিবারটির পাশে গিয়ে বলেননি, এটা অন্যায়, এই অন্যায় দেশে চলবে না, যারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের উপযুক্ত বিচার করা হবে। বাংলাদেশে আর কখনও কেউ যেন এমন ঘটনা আর ঘটাতে না পারে, তেমন ব্যবস্থা করা হবে। না, আওয়ামী লীগের কোনো নেতার মুখ থেকে এমন উচ্চারণ আমরা এখনও শুনিনি।
আওয়ামী লীগ ক্রমশ বিএনপির সঙ্গে নিজেদের পার্থক্যের সীমারেখা টানতে ভুলে যাচ্ছে। দলপ্রধানের কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু কোথায় দলের সাধারণ সম্পাদক? ক্ষমতার মৌতাতে মাতোয়ারা হয়ে আপনারা কি তবে ন্যায়-অন্যায়-মানবিকতা ভুলে গেলেন? নিজ দলের কর্মী-সমর্থকরা এমন এক ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটালো, পুরো দেশ ও বিশ্বের কাছে আওয়ামী লীগের মাথা হেঁট করে দিল, অথচ আপনারা আজ অবধি দলের শীর্ষ পর্যায়ের কেউ আক্রান্ত পরিবারটির পাশে গিয়ে সান্ত্বনা দিতে পারলেন না? আপনাদের রাজনীতি তবে কেন, কার জন্য? অনেকেই বলছেন, বিএনপি-জামায়াতের আমলে তো ঘটনাগুলো আমলেই নেয়া হয়নি, এবার অন্তত সরকারের নির্দেশে পুলিশ নোয়াখালীর ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে এবং আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু এমন একটি ঘটনায় কেবল প্রশাসনিক ব্যবস্থাই কি যথেষ্ট? কোথায় আপনাদের মানবিক সমাজ গঠনের অঙ্গীকার? কোথায় বিএনপি-জামায়াতের দস্যুতার পুনরাবৃত্তি রোধ করার শপথ? যদি সেই একই অন্ধকারকে অনিবার্য বলে মেনে নিতে হয়, তাহলে আর আমরা এতো পথ হেঁটে এত জল ঘেঁটে কী পেলাম? এত ত্যাগ-তিতীক্ষায়ই বা কী লাভ হলো?
ধর্ষণ তো কেবল সংখ্যাতত্ত্ব নয়। ধর্ষণের অর্থ, অমানবিক নির্যাতন, জঘন্য অপরাধ, ভয়াবহ হিংসার প্রকাশ, যে হিংসার মধ্যে সামাজিক ক্ষমতাবৈষম্য ও লিঙ্গবৈষম্যের তীব্র প্রতিফলন ঘটে থাকে। প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনাই আসলে অসংখ্য অপরাধের সমতুল্য। কোনও ‘যদি’ ‘তবে’-র স্থান নেই এখানে, ধর্ষণকারী কোন দলের লোক কিংবা কোন দলের নয়, এমন কোনও প্রশ্ন তোলার জায়গা নেই। এই মৌলিক সত্য অগ্রাহ্য বা অমান্য করার কোনও অবকাশ নেই। আমরা আশা করব সুবর্ণচরের ঘটনাটির চার্জশিট ১৫ দিনের মধ্যে দায়ের করা হবে, ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্টে বিচার হবে। অপরাধীরা এক মাসের মধ্যে শাস্তি পাবে।
শুধু তাই নয়, আমরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আরও দৃঢ় অঙ্গীকার শুনতে চাই। ধর্ষণ-উত্ত্যক্তকরণ-নারী নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্তদের আওয়ামী লীগ কিংবা তার কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য করা হবে না। এমন কিছু অঙ্গীকার ছাড়া আওয়ামী লীগের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ হবে না। দেখতে-শুনতে ছোট হলেও এ সব শাস্তির একটা বড় প্রতীকী গুরুত্ব আছে। এভাবে বুঝিয়ে দেয়া যায় যে আওয়ামী লীগ এই ধরনের অপরাধকে ‘জিরো-টলারেন্স’ দৃষ্টিভঙ্গিতে গুরুত্বসহকারে বিচার করে।
আমাদের নিজেদেরও এ ব্যাপারে সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে। বৃহত্তর সমাজকেও একটা বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। শাস্তি বাড়িয়ে অপরাধের পথে একটা বাধা তৈরি করা যায় নিশ্চয়ই, কিন্তু সামাজিক সংবেদনশীলতা বাড়ানোর কাজটাও তার চেয়ে কম জরুরি নয়। প্রতিটি সংসার থেকে এই সংবেদনশীলতা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে, আমাদের ঘরের ছেলেদের বলতে হবে যে আমাদের মেয়েরাও তাদের সমান, তাদের থেকে এক চুলও কম নয়। এই নাগরিক সংবেদনশীলতা ছড়িয়ে পড়া দরকার প্রতি দিনের বাস, ট্রেন, রিক্সা, ভ্যান পর্যন্ত, যাতে অল্পবয়সী সাধারণ মেয়েরা পড়াশোনার কারণে, বা চাকরির কারণে, বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য নিশ্চিন্তে নিরাপদে চলাচল করতে পারে। আমাদের মেয়েরা বোনেরা বিপন্ন হতে থাকবে, আর আমরা নিশ্চেষ্ট দর্শক হয়ে থাকব, এমন যেন কিছুতেই না হয় সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে, সরকারকেও, সমাজকেও।
গণমাধ্যমকেও এ ব্যাপারে আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। এই অপরাধ-ঘটনাগুলির রিপোর্টিং কীভাবে হওয়া উচিত, সেটা কিন্তু আর একটু ভেবে দেখা দরকার। প্রশাসনের তরফে গাফিলতি থাকলে সেটা ধরিয়ে দিতে হবে, সমালোচনা করতে হবে, কোন পথে সমাধান সম্ভব, তার আলোচনা করতে হবে। কিন্তু এই কাজগুলো করার সময় নিজেদের প্রবৃত্তিগুলিকেও একটু সংযত করতে হবে, হিস্টিরিয়া লাগিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে জনপ্রিয়তার যুদ্ধে মেতে ওঠা থেকে যত দূর সম্ভব বিরত হতে হবে। সত্যিকারের সমাধানের পথে এগোনোই হোক আমাদের সকলের অন্বিষ্ঠ।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ঘটনাটি মনে করিয়ে দিল, আমাদের আরও অনেক, অনেক দূর যেতে হবে। আওয়ামী লীগকেও অনেক অনেক পরিবর্তিত হবে। পরিবর্তন ও এগোনোর অনুপ্রেরণা হোক ওই ঘটনাটি। রাজনৈতিক কারণে তো নয়ই, কোনো কারণেই দেশে আর ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে না, এমন একটি দেশ নির্মাণের অঙ্গীকার ঘোষণা করুক নতুন সরকার।