২৪ এপ্রিল ছিল সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি আইরিন পারভীন বাঁধনের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৬ সালের এই দিনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে।
সেসময় সিঙ্গাপুর হাইকমিশনে তিনি কর্মরত ছিলেন। এক দীর্ঘসময় ধরে তিনি জীবনের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু আশির দশকের ক্যাম্পাসের এই প্রিয়মুখ সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সব বাঁধন ছিন্ন করে পরিবার-প্রিয়জন, শুভাকাঙ্খী, সুহ্নদ সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে অনন্তলোকে চলে যান। রেখে যান পরিবার পরিজনসহ সব ভালোবাসার মানুষগুলোকে।
দীর্ঘদিন ধরে মরণ ব্যাধি ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করছিলেন ‘ভিপি বাঁধন’ বলে বড় বেশি পরিচিত পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একসময়ের বড্ড প্রিয় এই মুখ। আইরিন পারভীন বাঁধন চলে গেলেও এখনও নক্ষত্র হয়ে জ্বলে আছেন তা বলাই বাহুল্য। আর তাই এখনও ছাত্র রাজনীতি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক আলোচনায় ‘ভিপি বাঁধন’ প্রাসঙ্গিক হয়ে আসেন।
মৃত্যঅব্দি জনপ্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও ‘ভিপি বাঁধন’ যেনো তাঁকে অমরত্ম দিয়েছে। আশির দশকে দেশের প্রায় সব শিক্ষার্থীর কাছেই তিনি যেমন পরিচিত ছিলেন তেমনি সমান জনপ্রিয়ও ছিলেন। সেই ব্যাপক পরিচিতি আর জনপ্রিয়তা এসেছিল তাঁর নিজস্ব নেতৃত্ব, সততা, মেধা আর আপন গুণের কারণেই।
মেধা আর নেতৃত্বের অপূর্ব গুণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্য। আশির দশকের প্রারম্ভে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন আইরিন পারভীন বাঁধন। শামসুন্নাহার হলের আবাসিক ছাত্রী হিসেবে শুরুতেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। সে সময় সারাদেশে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। আইরিন পারভীন বাঁধনও বসে নেই।
ছাত্রদের নায্য দাবি আর গণতন্ত্রের লড়াই-এ তিনিও সবার সামনে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আর ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রতিটি মিছিলেই মেধাবী এই মুখ দাবী আদায়ের লড়াই-এ অবতীর্ণ। তবে আইরিন পারভীন বাঁধন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বড় বেশ পরিচিত হয়ে উঠেন ৯০ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের সময়।
৯০ এর আগে টানা সাতবছর ডাকসু নির্বাচন বন্ধ থাকার পর ৮৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ফের ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থেকে সুলতান-মুশতাক পরিষদ প্যানেল জয়লাভ করে। এরপর নব্বই এর গণআন্দোলন পরবর্তীতে ৯০ সালের ৬ জুন আবার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এ নির্বাচনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐক্যবদ্ধ প্যানেল দিতে ব্যর্থ হলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদভুক্ত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাতীয় ছাত্রলীগসহ অন্যান্যরা আলাদা আলাদা প্যানেলে নির্বাচন করে। অন্যদিকে জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্রমেত্রী ঐক্যবদ্ধ নয়টি ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে নির্বাচন করে।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐক্যবদ্ধ না থাকার কারণে ধরেই নেওয়া হয় জগন্নাথ ও জহুরুল হক হল বাদে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ডাকসুসহ অন্য হলগুলোতে একচেটিয়া জয়লাভ করবে। ঘটনাও ঘটে তাই। ডাকসুতে ছাত্রদলের আমান-খোকন পরিষদ নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করে। জগন্নাথ হল ও জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগ জিতবে তা আগেই অনুমিত ছিল।
কিন্তু সবকিছুর মধ্যে অভাবনীয় এক সাফল্য বয়ে আনেন শামসুন্নাহার হলের ভিপি প্রার্থী ছাত্রলীগ নেত্রী আইরিন পারভীন বাঁধন। এই হলে ছাত্রলীগ থেকে বাঁধন-রুমা প্যানেল আর আগের ভিপি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মনিরা রহমান যথারীতি ভিপি পদে ফের ভোট যুদ্ধে নামেন। ছাত্রদল থেকে আঙ্গুর থাকেন ভিপি পদে। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে জয়লাভ করেন শামসুন্নাহার হলের স্নিগ্ধ স্বজন খ্যাত প্রিয়মুখ আইরিন পারভীন বাঁধন।
আর সেই থেকেই ‘ভিপি বাঁধন’ নামেই তাঁর পরিচিতির ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। আসলেই সেদিন শত বিপর্যয়ের মাঝে অন্যরকম আলো ছড়িয়ে বিজয়ী হন আইরিন পারভীন বাঁধন। তাঁর সে বিজয় ছাত্রলীগের ইতিহাসে আজো এক স্মরণীয় অধ্যায়। বলতে দ্বিধা নেই বাঁধনের একক বিজয় সেদিন ছাত্রলীগকে অন্যরকম এক মর্যাদায় সিক্ত করেছিল।
যে বিজয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত। এরপর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি ক্ষণেই বাঁধন সামনের কাতারে থাকতেন। এরশাদ পতনের সর্বশেষ দিনে সকালে সব দলের মেয়েদের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি’ দাবি সম্বলিত যে ঐতিহাসিক মিছিল বেরিয়েছিল সেটার সম্মুখভাগেও ছিলেন ভিপি আইরিন পারভীন বাঁধন।
৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরও রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় থাকেন তিনি। কিন্তু একাদশতম বিসিএস-এ প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হলে মেধাবী এই ছাত্রলীগ নেত্রী ৯৩ সালে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেন রাজবাড়ী জেলাতে। এরমধ্যে ৯৭ সালে ছাত্রনেতা ইসহাক আলী খান পান্নার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন
বিবাহবন্ধনে এসে বাঁধনকে দোয়া করে যান প্রিয়নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার ভীষণরকম স্নেহধন্য তিনি ছিলেন বরাবরই। স্মর্তব্য যে, শেখ হাসিনা যে বার রাগ করে বলেছিলেন তিনি আর রাজনীতি করবেন না, সে সময় আইরিন পারভীন বাঁধনসহ অন্যান্যরা তাঁর সাথে দেখা করে অভিমান ভাঙান।
চাকরি জীবন ঘর-সংসার সবই তাঁর ভালই চলছিল। কিন্তু দুর্বিপাক শুরু হয় ২০০১ সালে। এসময় ক্ষমতায় আসে বিএনপি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মেটাতে বাঁধনকে একের পর এক হয়রানিমূলক বদলি করা হয়। তাঁকে সর্বশেষ জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার (ম্যাজিস্ট্রেট) হিসেব বদলি করা হয় রংপুরে।
ততক্ষণে ক্যান্সার এসে উঁকি দিয়েছে তাঁর শরীরে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সুচিকিৎসার জন্য ছুটি পাওয়াটাও তাঁর জন্যে কঠিন হয়ে পড়ে। সময়মতো প্রমোশন না পাওয়ার কারণেও মানসিক চাপে ভুগতে থাকেন। এতসবের মাঝেই সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টায় অবিরাম আত্মশক্তি নিয়োগ করেন আইরিন পারভীন বাঁধন।
মৃত্যুর আগে বড় একটা সময় ধরে সিঙ্গাপুর হাইকমিশনে কর্মরত থাকেন তিনি। এসময় মৃত্যুর সাথে এক দীর্ঘযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় তাঁকে। কিন্তু বড় অবেলায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আসলে এত অল্প সময়ে তাঁর চলে যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু নির্মম নিয়তি বলে কথা।
কথাবার্তা-আচার-আচারণে আইরিন পারভীন বাঁধন ছিলেন অসাধারণ একজন। মৃদুভাষী ছিলেন বরাবরই। মায়াবী চেহারার মানুষটি কথা বলতেন কম, শুনতেন বেশি। অন্তর্দৃষ্টি ছিল তাঁর বেশি প্রখর। সবচেয়ে বড় কথা মন খুলে সবাইকে ভালোবাসতে জানতেন তিনি। মানুষকে তাই কাছে টানতে পারতেন সহজেই। রাজনীতি থেকে প্রশাসন- জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাফল্য আর মেধার সৌন্দর্য দেখিয়েছিলেন তিনি।
২৪ এপ্রিল এলে বাঁধনকে সবাই বড় বেশি মনে করেন। কিন্তু স্বজনদের বেদনার ভার বড় বেশি। বাঁধনের পথ ধরেই তাঁর দুই ছোট বোনও বিসিএস ক্যাডার। ছোট বোন আসমা সিদ্দিকী মিলি বর্তমানে রাজবাড়ী জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এবার ২৪ এপ্রিল এলে প্রিয়বোনকে স্মরণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি লেখেন- বাঁধন আমাদের ছেড়ে, এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছে ২০১৬ সালের এই দিনে।
বলতেই বুকের ভেতর থেকে পাহাড়সম কষ্টের দীর্ঘশ্বাসে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। প্রতি মুহুর্তে আমাদের সাথেই আছে বাঁধন। তারপরও নেই। কি নিষ্ঠুর নিয়তি! আমি জানি অনেকে বাঁধনকে ভালবাসতেন, ভাল জানতেন।’
আসলেই আইরিন পারভীন বাঁধনকে ভালবাসতেন সবাই। মাগুরার এই কৃতিকন্যা শুধু স্বজন নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়কার সবার স্মৃতির পাতায় এখনও অমলিন অনন্য একজন।