চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

অ্যালিস্টার কুক: ইংলিশ ক্রিকেটের ‘বাতিঘর’

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক। সোমবার ঘোষণা দেন তিনি। ভারতের বিরুদ্ধে চলতি সিরিজের শেষ টেস্ট খেলেই ক্যারিয়ারে সিলমোহর মারবেন দেশের হয়ে টেস্টে সর্বোচ্চ রানস্কোরার।

৩৩ বছরের কুক ইংল্যান্ডের হয়ে ১৬০ টেস্টে ১২,২৫৪ রান করেছেন। তার টেস্ট রানের আশেপাশে কোনো ইংলিশ ব্যাটসম্যানই নেই। তার নামের পাশে আছে ৩২টি সেঞ্চুরি। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ষষ্ঠ সর্বাধিক রান সংগ্রাহক কুক। ওপেনার হিসেবে রেকর্ড ১১,৬২৭ রান করেছেন।

বিদায়বেলায় তাকে ক্রিকেটের ‘বাতিঘর’ বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ।

বিবিসি রেডিও ফাইভকে গুচ বলেছেন, ‘একজন খেলোয়াড় ও একজন মানুষ হিসেবে কুকের জন্য আমাদের সবারই গলা ফাটানো উচিত। তার কৃতিত্ব আপনি ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু তিনি একজন সুপারম্যান, আমাদের খেলাধুলার আইকন এবং নিজের খেলায় বেঁচে থাকবেন বাতিঘর হয়েই।’

কুকের বাল্যকালের নায়ক এবং তার সাবেক পরামর্শদাতা ছিলেন গুচ। তিনি ছাড়াও অন্যান্য অনেক কোচ, বন্ধু এবং সাবেক সহকর্মীরা সম্মান জানিয়েছেন তাকে। কিন্তু কুক কি এমন কোনো ‘আইকন’ তৈরি করেছেন যার জন্যে ওভালে (বিদায়ী টেস্টের ভেন্যু) তিনি ইমোশনাল বিদায়ী সম্মাননা পাবেন?

এমন প্রশ্নের উত্তর শোনা যাক তার মুরব্বিদের মুখ থেকেই…

গ্রাহাম গুচের ভাষায় কুক রোলমডেল, ‘যদি আপনি একজন রোলমডেল খোঁজেন, আপনি যদি খেলার একজন আইকন খোঁজেন এবং সেটা শুধু ক্রিকেট। তাহলে আপনি অ্যালিস্টার কুকের চেয়ে ভালো ব্যক্তি এবং সুদৃশ্য মানুষ পাবেন না। তিনি এমন একজন ক্রীড়াবিদ, যার মধ্যে আপনি সবকিছু পাবেন।’

সাবেক আরেক অধিনায়ক অ্যালেক স্টুয়ার্টের মন্তব্য, ‘তিনি সব রেকর্ড ভেঙে রাডারের কাছাকাছি চলে আসেন এবং তিনি এমন একজন খেলোয়াড় যিনি নিঃসঙ্গ পথেও শান্ত থাকেন। জাতীয় দল তো অবশ্যই, আরো যেসব টিমে খেলেন সবখানেই দলের হৃদয়বিন্দু তিনি।’

যার অধীনে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটি খেলবেন সেই পল ফারবাসের শিষ্য সম্পর্কে মূল্যায়ন, ‘দলের মধ্য সে একখণ্ড পাথরের মতো। যখন তার খারাপ সময় ছিল, অধিনায়ক থাকাকালীন যখন প্রচণ্ড চাপে ছিলেন তখনও সবাই বলেছে, ‘আমরা তাকে চাই, তাকে আমাদের দরকার। তিনি আমাদের আসল মানুষ। এটাই আসল সত্য। কুক কাঁধে পাথর বয়ে চলেছেন কিন্তু কখানোই স্বার্থপরতা দেখানি। শুধু সমালোচনার বাইরে থেকেছেন।’

কুকের সাবেক সতীর্থ ও বর্তমান ধারাভাষ্যকার গ্রায়েম সোয়ান বলেন, ‘তিনি বেঁচে থাকা সবচেয়ে ভালো মানুষদের একজন। তিনি এতো দীর্ঘদিন ধরে খেলতে পেরেছেন কারণ তিনি খুবই হাসিখুশি স্বভাবের এবং ক্রিকেটকে জীবন ও মৃত্যু বলে মনে করেন না। তিনি সর্বদা ১০০% দিতেন, কিন্তু জীবনের অন্যদিককে উপেক্ষা করতেন না।’

কুকের বিদায় মনছুঁয়ে গেছে সর্বকালের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ভারতীয় কিংবদন্তি এবং ক্রিকেটের মহানায়ক শচীন টেন্ডুকারেরও। তিনি বলেছেন, ‘ইংল্যান্ডকে প্রতিনিধিত্ব করা ব্যাটম্যানদের মধ্যে অ্যালিস্টার কুকই সেরা ব্যাটসম্যান। মাঠে এবং মাঠের বাইরে তার আচরণও নিখুঁত।’

দৃঢ় মনস্তাত্ত্বিক কুক
সাবেক সতীর্থ পল কলিংউডের মন্তব্য, ‘এটা খুবই স্পষ্ট যে তিনি একজন নীরব চরিত্রের মানুষ। তিনি এতইটাই শান্ত থাকেন যে, দেখে মনে হয় না কখনো তিনি হতাশ বা অন্য কোনো খেলোয়াড়ের মতো চাপ নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছেন।’

কুকের মানসিকতা নিয়ে অ্যালেক স্টুয়ার্টের সংযোজন, ‘ওপেনিং ব্যাটিংয়ের শুরুতে কিছুটা পাগলামি আছে, কিন্তু তিনি সেটা খুব ভালো করেই সামলেছেন। তিনি সম্ভবত প্রকৃতিগতভাবে প্রতিভাধর ক্রিকেটার নন, কিন্তু অন্যরা তার মতো মানসিক শক্তি পায় না। প্রতিভা এবং মানসিক শক্তির সমন্বয়ের কারণেই কুক এত দীর্ঘ সময় খেলছেন এবং তিনি এতসব রেকর্ড ভেঙেছেন ও গড়েছেন।’

সাবেক কোচ পিটার মোরেসের বয়ানে কুকের মানসিক শক্তির বিবরণ, ‘তার অনেক গুণাবলীর জন্যেই ইংরেজদের মধ্যে সেরা ব্যক্তি তিনি। কুক অন্যের পরামর্শ রাখেন এবং চাপের মধ্যে দৃঢ়।’

মাইকেল ভনের ভাষায়, ‘কুককে কঠোর পরিশ্রম এবং প্রস্তুতির মাধ্যমে প্রতিটা রান সংগ্রহ করতে হয়েছে। এই কারণেই তিনি ১২ বছরের একটা অসাধারণ ক্যারিয়ার গড়তে পেরেছেন।’

প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী কুক
কুক কতটা প্রতিদ্বন্দ্বী সেটা শোনা যাক ইংল্যান্ডের সাবেক কোচ এবং এসেক্সে কুকের সতীর্থ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের ভাষায়, ‘শুরুতে তিনি কাঁধের উপরের বল খেলতে পারতেন না। হুক-পুলে খুবই সমস্যা ছিল। তার হতাশা ছিল, কিন্তু দৃঢ়তাও ছিল। যার ফলেই পরে সত্যিকার ব্যাটিংটা করতে পেরেছেন। আপনি যে কাউকেই কোচ করতে পারবেন। কিন্তু তিনি সব করতে পারবেন না। এটা গভীর থেকে আসে। ভেতরের ক্ষুধাই এক একজনকে মহাপ্রতিদ্বন্দ্বী করে গড়ে তোলে। কুক তাদের একজন যিনি আপনাকে সবসময় হারাতে চায়, তা স্কোয়াশ, টেবিল টেনিস বা ক্রিকেট হোক।’

স্টুয়ার্টের ভাষায়, ‘তিনি অন্যকে তেমন কোনো সুযোগই দেন না। কঠোর পরিশ্রম করেছেন এবং নিশ্চিত করেছেন যে তিনি সর্বদা ফিটনেস পরীক্ষায় শীর্ষস্থানীয়।’

সব অবস্থা মোকাবেলা করার মানুষ কুক
টেস্টে যে ৩২টা সেঞ্চুরি করেছেন কুক তার ১৮টিই বিদেশের মাটিতে। এরমধ্যে পাঁচটি করে সেঞ্চুরি করেছেন ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে।

তার এই ব্যাটিং নিয়ে গুচ মন্তব্য, ‘২০১২-১৩ মৌসুমে ভারত সফরে অধিনায়ক ছিলেন কুক। ওই সফরে ২-১ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জিতেছিল ইংল্যান্ড। সিরিজে তার পারফরম্যান্স আমাকে জাস্ট অবাক করেছিল। ঘূর্ণি বল কীভাবে খেলতে হয় সেটারই প্রদর্শনী ছিল ওই সিরিজ। কুকের রানের উপর ভর করেই ভারতের মাটিতে ভারতকে হারাতে পেরেছিল ইংল্যান্ড।’

২০১০-১১ মৌসুমের অ্যাশেজে কুকের অবদান নিয়ে গ্রায়েম সোয়ান বলেন, ‘তার রান ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আমরা কোনোভাবেই অ্যাশেজ জিততে পারতাম না।’

কালের শেষ সাক্ষী?
সাবেক স্পিনার ফিল টাফনেল বলেন, ‘আমি নিশ্চিত নই যে, তার মতো আর কাউকে দেখব। তিনি ছিলেন পুরনো দিনের ওপেনারদের মধ্য অন্যতম। কুকের জন্য টেস্ট দলে এখনো কিন্তু জায়গা আছে।’

শৈশব হিরো গুচ বলছেন, ‘কুক সরে যাওয়ায় জিমি অ্যান্ডারসন ছাড়া সবাই টি-টুয়েন্টির যুগের। সুতরাং তিনি একটি কালের শেষ সাক্ষী। অন্য কাউকে এই মুহূর্তে আমি দেখি না যারা তার জায়গা নিতে পারে এবং টেস্টে তার রান স্পর্শ করতে পারে। এক কথায় তিনি অমূল্য সম্পদ।’

কুকের জায়গা কি অপূরণীয়?
গুচ বলছেন, টেস্ট ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের হয়ে ব্যাটিং শুরু করার সময় অন্য কাউকে দেখাটা খুবই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হবে।

আর মোরেস বলেন, ‘অন্য কেউকে নিয়ে একটা নতুন জুটি গড়া হয়তো সহজ হবে। কিন্তু তার মতো গ্রেট সব রেকর্ড করা বা গড়াটা মোটেই সহজ হবে না। এটা অবশ্য নতুন অন্তত দুজন ক্রিকেটারকে সুযোগ করে দেবে যারা ইংল্যান্ডের জন্য নতুন আশার সঞ্চার করতে পারেন।’

কুকের বিকল্প নিয়ে কলিংউডের মত, ‘তার জায়গা পূরণ করাটা কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। আশা করি, কেউ একজন এই জায়গা পূরণে হাত বাড়িয়ে দেবেন এবং দলকে পথ দেখাবেন।’

কুকের অনুপস্থিতিতে অন্যদের দায়িত্ব সম্পর্কে ফারবাস বলেছেন, ‘বোর্ডের যে নির্বাচকমণ্ডলীরা রয়েছেন এবং ইংল্যান্ডের দুজন ভালো উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানের জায়গা নিশ্চিত করাই তাদের কাজ হবে। কুক যখন শেষ করছেন এবং এ নিয়ে যে অভিজ্ঞতা তাতে আমরা যা অনুভব করছি সেটা অন্যরাও দেখছেন। কুক যে রান করেছেন, তিনি চলে যাওয়ায় সেখানে একটা বড় গর্ত হচ্ছে।’

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের মত, ‘গ্রেট খেলোয়াড়রা চলে গেলেও খেলাটা এগোতে থাকবে। তাকে সবাই মিস করবে, কিন্তু অন্যান্য তরুণ ইংলিশ ক্রিকেটার আছেন যারা খেলাটার জন্য ক্ষুধার্ত, মানসিকভাবে শক্তিশালী তাদের পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ধাপে ধাপে দলকে এগিয়ে নিতে হবে।’

কুক কি ইংল্যান্ডের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান?
অ্যালেক স্টুয়ার্ট বলছেন, ‘যদি কেউ তার টেস্ট রেকর্ড ভাঙতে চায়, তাহলে তাকে অনেক অনেক ভালো খেলোয়াড় হতে হবে এবং সেটা করতে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ সময় লাগবে।’

সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান নিয়ে গুচের বিচার, ‘সে নিজের জায়গায় ঠিক আছে। আপনারা বলতে পারেন তার জায়গায় আরো অনেক উত্তেজনাপূর্ণ এবং বিনোদনমূলক খেলোয়াড় আছেন। কিন্তু আমি বলব, তিনি শীর্ষ দুই বা তিনে থাকবেন।’