বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে ২০১৮ সালের পর অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সকে আর দরকার হবে না বলে মনে করেন তৈরি পোশাকখাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা এখন বেশ সচেতন। নীতিমালা মেনেই কারখানা স্থাপন করছেন সবাই। আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে উদ্যোক্তারা ঝুকছেন সবুজ কারখানার দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের জরিপে বিশ্বের প্রথম ১০টি কারখানার ৭টি হচ্ছে বাংলাদেশের। শুধু তাই নয়, বর্তমানে বিশ্বের এক নম্বর সবুজ কারখানাও বাংলাদেশে।
উদ্যোক্তাদের দাবি, পোশাক প্রস্ততকারীরা কারখানায় আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বজায় রাখতে সংযুক্ত করছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। যদিও এতে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুন।
তাদের অভিযোগ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে অ্যালায়েন্স গত চার বছরে ১২৮ টি কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এছাড়া অন্য জোট অ্যাকর্ডের চাপে বন্ধ হয়ে গেছে ৫০ এর অধিক কারখানা। এতে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে বেকার হয়ে পড়ছে হাজার হাজার শ্রমিক। তাই জোট দুইটির বাড়াবাড়ি থেকে মুক্তি চান ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে অনন্ত গার্মেন্টেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনামুল হক খান বাবলু চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘২০১৮ সালের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার ত্রুটি সংস্কারের জন্য ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সকে আর দরকার হবে না। তারা যে পদ্ধতিতে করে ঠিক সেইভাবে কারখানা মালিকেরা সংস্কার কাজ সম্পন্ন করতে পারবে।’
বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের ৮২ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। কিন্তু ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ভবন ধসের পর পোশাক খাতে নেমে আসে বড় ধরনের বিপর্যয়। এরপর বাংলাদেশের কারখানায় নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে দুইটি জোট গঠন করে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা। এর একটি হচ্ছে ‘ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ’ বা অ্যাকর্ড। অন্যটি হচ্ছে ‘অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি বা অ্যালায়েন্স’।
জোট দুইটি নিরাপত্তা ইস্যুতে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেয় মালিকদের। শর্তের মধ্যে অগ্নিনিরাপত্তা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ফায়ার ডোর, হোসপাইপ, জুকিপাম্প, অটোস্প্রিঙ্কলার, ইলেকট্রিক্যাল ড্রইং, ফায়ার ড্রইং ও সিঙ্গেল লাইন ডায়াগ্রাম এবং ভবন নিরাপত্তার মধ্যে বিল্ডিংয়ের অনুমোদন, অবকাঠামোগত নকশা, ফ্লোরের ধারণক্ষমতা যাচাই করা ইত্যাদি। এ ছাড়া কারখানার সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয় শর্তানুযায়ী।
এতে প্রত্যেক কারখানায় আগের তুলনায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া কাঠামোগত সংস্কার, অগ্নিনিরাপত্তা ও প্রতিরোধ কার্যক্রম এবং বৈদ্যুতিক সংস্কার বাবদ প্রতিটি কারখানাকে ব্যয় করতে হচ্ছে গড়ে ৫ কোটি টাকা। তবে সে হারে বাড়েনি পণ্যের দাম। বরং দাম কমেছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত।
জানা গেছে, অ্যালায়েন্সভুক্ত কারখানাগুলোর ৬৮ শতাংশ সংস্কার কাজ সম্পন্ন করেছে। জোটের ভাষ্যমতে ১৮ সালের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হবে।
এছাড়া এ পর্যন্ত ৯৪৭টি কারখানার ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে অ্যালায়েন্স। সংস্থাটি প্রায় ৭শ কারখানায় সংস্কার কাজ সম্পন্নের দায়িত্ব নেয়। অন্যদিকে অ্যাকর্ডের অধীনে প্রায় ৮০ শতাংশ কারাখানার সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও সরকারের কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর হিসেবে অনুযায়ী প্রায় তিন হাজার কারখানা পরিদর্শন হয়েছে গত দুই বছরে। এর মাধ্যমে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ তেত্রিশটি বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি বহু কারখানাকে পর্যায়ক্রমে প্রয়োজনীয় সংস্কারের গাইডলাইন দেয়া হয়েছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে বাকি কারখানাগুলোর কাজ নিজেরাই সম্পন্ন করতে পারবেন তারা।
অনন্ত গার্মেন্টেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, শ্রমিক সংগঠন, কলকারখানা অধিদপ্তর, শ্রমমন্ত্রনালয়, কারখানা মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। কিভাবে কারখানা সংস্কার ও নীতিমালা মেনে ভবন নির্মাণ করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে অ্যালায়েন্সভুক্ত কারখানাগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হবে। বাকি কাজ ২০২১ সালের জুনের আগেই সম্পন্ন করতে পারবেন উদ্যোক্তারা। সেক্ষেত্রে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সক আর দরকার হবে না। এই দুই জোটের বাড়াবাড়ি থেকে মুক্তি চান ব্যবসায়ীর। তবে এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্টপোষকতা একান্ত প্রয়োজন।
অ্রাকর্ড-অ্যালায়েন্সকে যে আর বেশি প্রয়োজন নেই সে বিষয়ে কলকারখানা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহম্মদ একমত পোষন করেছেন।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, কারখানার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কাজে তদারকি বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে ‘লিমা’ নামে একটি অ্যাপস চালু করা হয়েছে। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৮ সালে। এরপর যেসব কারখানার সংস্কার কাজ বাকি থাকবে সেগুলো সব সেক্টরের সমন্বয়ে সম্পন্ন করা হবে।
তবে ২০১৮ সালের পর অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স বাংলাদেশে থাকুক তা কোনো ভাবেই চাননা বলে সাফ জানিয়ে দিলেন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘উদ্যোক্তারা এখন কারখানা নিযে বেশ সচেতন। নীতিমালা মেনেই সবাই কারখানা স্থাপন করে। বর্তমানে সবাই সবুজ কারাখানার দিকে ঝুকছেন। বিশ্বের এক নম্বর সবুজ কারখানা বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে। এতেই বুঝা যাচ্ছে এদেশের কর্মপরিবেশ কতটা উন্নত।’
‘অতএব এদেশে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সকে আর চাই না। তাদের বাড়াবাড়ি থেকে মুক্তি পেতে আমরা বদ্ধপরিকর আমরা, জানালেন সিদ্দিকুর রহমান।’