করোনার কারণে কত ধরনের দুর্ভোগ জনজীবনে, ভুক্তভোগী কোটি কোটি মানুষ তার সাক্ষী। দেড় মাস আগে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী চিহ্নিত হয়েছিল বাংলাদেশে। এর পর দেড় মাস চলে গেছে। কত ধরনের অব্যস্থাপনা-অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত হয়েছে। গোটা দেশ এখন লকডাউনের আওতায়। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কলকারখানার বড় অংশ বন্ধ। পাঁচ কোটির বেশি ছাত্রছাত্রীর এ দেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি অফিস বন্ধ। কোটি কোটি মানুষ স্বাভাবিক জীবীকা হারিয়েছে। কিন্তু এমন অস্বাভাবিকতার মধ্যেও অনেক কিছু রয়েছে স্বাভাবিক, যা আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।
এ লেখাটি তৈরির জন্য আমি অন্তত অর্ধশত শহর ও গ্রামে সংবাদিকদের ফোন করেছি। কেউ কোথাও বলেনি যে বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে। এটা ঠিক যে লকডাউনের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে। কিন্তু একইসঙ্গে বলতে হবে যে, গৃহস্থালী কাজে গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। সারা দিনরাত চলছে কত ধরনের বিদ্যুৎচালিত সরঞ্জাম। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও কোটি কোটি প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে বিতরণ এক দুরূহ কাজ। উৎপাদন কেন্দ্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে, ট্রান্সমিশন লাইন বিকল হতে পারে এবং সেটা ঘটেও। অথচ যারা করোনার প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যেও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা তেমন দৃশ্যমান নয়। লোডশেডিং কেবল গরমকে দুঃসহ করবে না, করোনার সময়ে টেলিভিশন, ইন্টারনেটসহ কত কিছুই না অচল হয়ে পড়বে।
একই কথা বলা যায় শহরাঞ্চলে পানির সরবরাহ নিয়েও। বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে, কিন্তু গরমে পানির চাহিদা বরং বেড়েছে। ওয়াসা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা এখন পর্যন্ত পানি সরবরাহ বিঘ্নিত হতে দেয়নি। রমজান মাস সামনে। ওয়াসা নিশ্চয়ই এ বিষয়ে সচেতন।
রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বাড়ি বাড়ি গ্যাস সরবরাহও নিয়মিত রাখা সম্ভব হচ্ছে একদল নিবেদিত কর্মীর কারণে। সিলিণ্ডার গ্যাসের সংকটের কথাও এখন পর্যন্ত শোনা যায় না।
আমি দেশের সকল সিটি করপোরেশনে কথা বলেছি। অন্য শহরের সঙ্গে বাস্তব চিত্রে পার্থক্য নেই। করোনায় দেশ অচল হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে চলছে। যারা বাসাবাড়ি ও কলকারখানার প্রতিদিনের বর্জ্য অপসারণ করছে তাদের বেতন নামমাত্র, বর্জ্য অপসারণের জন্য উপযুক্ত উপকরণ দেওয়া যায় না। আমার বসবাসের এলাকায় প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ময়লা তুলে নেয় যারা, তাদের একজন বলেছেন হাসপাতাল-ক্লিনিকের বর্জ্য মিলছে প্রচুর। এর মধ্যে করোনা রোগী কিংবা তাদের সংস্পর্শে যাওয়া চিকিৎসক ও নার্সের ব্যবহৃত বর্জ্য যে নেই, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের অতুলন সেবা বাংলাদেশ চিরকাল স্মরণ রাখবে। মৌলভীবাজারের এক চিকিৎসক জানান, প্রতিদিন তিনি সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। তার বাবার দীর্ঘদিন ধরে অ্যাজমার সমস্যা। এ কারণে তিনি বাড়িতে যাচ্ছেন না, একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন, যেখানে স্ত্রী ও সন্তানদেরও আনার প্রশ্ন নেই।
চিকিৎসকদের কাজ করতে হচ্ছে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম ছাড়াই। করোনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কত গলদ। এটা ঠিক যে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত এমনকি হতদরিদ্র পরিবারগুলোও কিছু চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিশ্বমানের না হোক, এশীয় মানে পৌঁছে গেছে। কিন্তু ট্রাকের বাইরে গেলেই আমরা কত অসহায়? দেশব্যাপী মাত্র অল্প কয়েকটি আইসিইউ! এ সুবিধা ব্যবহার করতে হলে কাড়ি কাড়ি টাকা থাকতে হয়। আমাদের স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্তরা ধরেই নিয়েছেন যে দরিদ্রদের আইসিইউ বা ভেন্টিলেশন সুবিধার দরকার নেই! করোনা থেকে নিষ্কৃতি লাভ ঘটলে প্রথমেই কিন্তু কাটাছেঁড়া হবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার।
বাংলাদেশের প্রশাসনের গাফিলতি-লালফিতা নিয়ে কত অভিযোগ। পুলিশ তো ‘ঠোলা’র বৈ কিছু নয়। র্যাব আর ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুক যুদ্ধে দুষ্কৃতকারী নিহত’ অনেকের কাছে সমার্থক। কিন্তু টানা প্রায় দু’মাস ধরে অস্বাভাবিকতার মধ্যে কত কিছুই না স্বাভাবিকভাবে চলছে। এমনকি সেনাবাহিনীও ‘অদম্যদের কাছে’ কখনও কখনও যেন যথেষ্ট নয়। স্থানীয় প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছে লকডাউন মানাতে। অনেকের কাছে এটা ‘সরকারি নির্দেশ’ বৈ কিছু নয়। অথচ এটা হওয়াই কাম্য ছিল যে নিজের প্রয়োজনে, পরিবারের প্রয়োজনেই ঘরের বাইরে না যাওয়া ভাল, বিচ্ছিন্নতা ভাল। এরমধ্যেই প্রশাসনকে ত্রাণ বিতরণ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে বহু বছর ‘রিলিফ চোর’ ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বর সমার্থক শব্দ ছিল। এখনও কিছু দুর্বত্তকে আমরা চোরের ভূমিকায় দেখি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় অনেক কিছুই আমরা স্বাভাবিক রাখতে পারি। বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হলে এক-দুইদিন সময় পেলেই লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। বন্যাকে বাংলাদেশ ভয় পায় না। কিন্তু করোনার বিপদ প্রতিটি মানুষকে কোনো না কোনোভাবে ছুয়ে যাচ্ছে। এখন অনেক কিছু বন্ধ। ব্যাংকে স্বাভাবিক লেনদেন নেই। পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি আছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। এ অবস্থার মধ্যেই কিন্তু মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে ত্রাণ কাজ পরিচালনা করতে হচ্ছে। প্রশাসনে যারা কাজ করছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্বেগ যথেষ্ট। ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে, লকডাউন কার্যকরের প্রক্রিয়ায় যাদের সংস্পর্শে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আসছে, তাদের মধ্যে কার দেহে সংক্রমণ ঘটে আছে করোনার, সেটা কিন্তু জানা নেই। যশোরের একটি উপজেলায় এক নারী কর্মী মাস খানেক আগে দুজন বয়ষ্ক ব্যক্তিকে লকডাউন না মানায় শাস্তি দিতে গিয়ে নিজেই কঠোর শাস্তি পেয়েছে। তার কাজটি হয়ত যথাযথ হয়নি, কিন্তু মানুষকে ঘরে রাখতে হলে কঠোর হতে হবে- এ মনোভাবের বিকল্প কি আছে?
রিলিফ ও অন্যান্য সামগ্রী আত্মসাৎ হয় কিনা, সেটা প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। একাধিক জেলা থেকে সাংবাদিকরা বলেছেন, জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যারা ‘ব্যবসায়ী’ তারা এ অপরাধে বেশি জড়িত। এখন পর্যন্ত ত্রাণ আত্মসাতের ঘটনা কারও মতে এক-দুই শতাংশ, কেউ বা বলেন পাঁচ শতাংশ। কিন্তু লকডাউন বেশি দিন স্থায়ী হলে বিপদ বাড়তে পারে। আরও একটি বিষয় নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের যে সব নেতা-কর্মী জনপ্রতিনিধি-যেমন উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়্যারমান কিংবা মেয়র-কাউন্সিলর, তারা ত্রাণ বিতরণ ও লকডাউন কার্যকরে সক্রিয়। কিন্তু যেসব দলীয় নেতা-কর্মীর জনপ্রতিনিধি তকমা নেই, তারা অনেকটাই স্বেচ্ছাবন্দী। জনগণকে সচেতন করা ও ত্রাণ বণ্টনে অনিয়ম বন্ধে তাদের ভূমিকা দেখা যায় না।
বিএনপি দাবি করে, তারাই সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। তাদের হাতে সরকারি ত্রাণ ভাণ্ডারের পণ্য নেই। কিন্তু মানুষের পাশে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দাঁড়ানোর অন্য যে সব উপায় রয়েছে সেটা কেন কাজে লাগানো হচ্ছে না? কেন বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিজেদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে দিয়েছে?
অনেক অস্বাভাবিকতার মধ্যেও আমাদের কৃষি খাত যথেষ্ট স্বাভাবিক। কৃষকরা ভয়ভীতির মধ্যেই মাঠে আছে। বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। সরকার এ খাতে যে সব প্রণোদনা ঘোষণা দিয়েছে, সেটা বণ্টন করার চালেঞ্জ প্রশাসনের। করোনার মেয়াদ বাড়তে থাকলে কৃষি খাতে বাড়তি সমস্যা দেখা দেবে। এ জন্য হয়ত আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দেশের উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো ধান থেকে। এখন পর্যন্ত সার বা সেচের পানির সংকটের কথা শোনা যায়নি। কৃষকরা ধান কাটার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিকের সমস্যায় যেন না পড়ে, সে উদ্বেগ আছে। আরও বড় উদ্বেগ, ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার শঙ্কা। কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য পেলে ত্রাণ ভাণ্ডারের ওপর চাপ কিছুটা কমবে।
সবশেষে বলি, গণমাধ্যম কর্মীদের কথা। তার আগে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের সময় যখন এ স্লোগান দেওয়া হয়, তখন কতই না ব্যঙ্গবিদ্রুপ শোনা গেছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে বলা হতো-‘ডিজিটাল গেল’, পানি বা গ্যাস না থাকলে বলা হতো ‘ডিজিটাল নেই’। অথচ এখন কোটি কোটি মানুষের অবলম্বন হয়ে উঠছে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি। অনেক অনেক মানুষ কেবল একটি ফোন করেই বাসায় বসে প্রয়োজনীয় পণ্য পাচ্ছেন। চিকিৎসা সুবিধা মিলছে। এমনকি করোনার টেস্ট করার কর্মী বাড়িতে চলে আসছে। কোটি কোটি শিশু-কিশোরের জীন যে দুঃসহ হয়ে উঠছে না তার বড় একটি কারণ অবশ্যই ইন্টারনেট সুবিধা। করোনা পরবর্তী বাংলাদেশে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই।
গণমাধ্যম কর্মীরা চরম ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছেন। টেলিভিশনে যারা খবর সংগ্রহ বা পাঠ করেন কিংবা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন, বয়সে তারা নবীন। অনেক মেয়ে রয়েছে এ পেশায়। প্রত্যেকেই জানেন, কী ঝুঁকি নিয়ে তারা প্রতিদিন ঘরের বাইরে পা রাখেন। টেলিভিশনে একজন কর্মীর করোনা ধরা পড়া মাত্রই তার সংস্পর্শে যারা এসেছে সকলকে ‘গৃহবন্দি’ করা হয়। পত্রিকার কর্মীদেরও একই সমস্যা। কিন্তু দায়িত্ব ছেড়ে পালাচ্ছে না কেউ।
অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে যারা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার কাজে নিবেদিত, আমরা তাদের অবদান কোনোদিন ভুলব না। স্যালুট তাদের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)