দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যা হচ্ছে, সেটি সম্ভবত আমাদের অসুস্থ রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। এই অসুস্থতার চর্চা হচ্ছে দু’পক্ষের তরফেই।
খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে জটিল আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত এ কথা সবাই জানেন। এর বাইরে আর কোনো জটিল সমস্যায় তিনি ভুগছেন কিনা, তা অবশ্য তিনি কারাগারে যাওয়ার আগে শোনা যায়নি। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে দুর্নীতি মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই তার অসুস্থতার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছেন তার আইনজীবী ও দলের নেতারা। বিশেষ করে আদালতে জামিন চাইতে গিয়ে। যদিও এর আগে যেদিন তাকে পুরান ঢাকার সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য আনা হয়েছিল, সেদিন গণমাধ্যমে তার বেশ হাস্যোজ্জ্বল ছবিই দেখা গিয়েছিল। এই হাসি রাজনীতিবিদদের পরিচিত হাসি নাকি অনেক সংকটের মধ্যেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা তা বোঝা মুশকিল। তবে যত বড় অপরাধই হোক, রাজনীতিবিদদের যখন পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তখন তারা আঙুলে বিজয় চিহ্ন দেখান। তারা এই বিজয় চিহ্ন দিয়ে কার বিজয়ের বার্তা দেন, সে জবাব তারাই দিতে পারবেন।
বেগম জিয়ার বয়স হয়েছে। এই বয়সে স্বাভাবিকভাবেই শারীরিক অনেক সমস্যা দেখা দেয়। তার ওপর দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা, ছোট ছেলের মৃত্যু, দণ্ডিত বড় ছেলের প্রবাসজীবন, দলের অভ্যন্তরে কোন্দল, নেতাকর্মীদের হতাশা সব মিলিয়ে খুবই বাজে সময় পার করছেন তিনি।
দেশের প্রধান দুই দলের দুই নেত্রীর প্রতি দেশের সাধারণ মানুষের ভালোবাসা, আবেগ বা বিশ্বাস কতটুকু, তা ব্যালট পেপার ছাড়া প্রমাণ করা মুশকিল। তবে কারাগারে যাওয়ায় খালেদা জিয়ার প্রতি মানুষের কিছুটা বাড়তি সহানুভূতি তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। যদিও কোনো দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেল খাটার ঘটনা দেশে এটিই প্রথম। এই ঘটনা ভবিষ্যতে দেশে অন্যান্য দুর্নীতির মামলার বিচারে কতটা ভূমিকা রাখবে বা দেশে আইনের শাসনকে কতটা এগিয়ে নেবে, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এই তর্ক ছাপিয়ে এখন বেগম জিয়ার অসুস্থতাই মুখ্য হয়ে উঠেছে।
সরকারের তরফে বারবারই বলা হচ্ছে যে, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। পক্ষান্তরে বিএনপির অভিযোগ, সরকার খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা করছে না। ফলে কারাগারে যদি তার বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে সরকারকেই এর দায় নিতে হবে।
সরকার বেগম জিয়ার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে চায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে (বিএসএমএমইউ)। কিন্তু খালেদা জিয়া চান রাজধানীর গুলশানে, তার বাসার কাছে ইউনাইটেড হাসপাতালে। তার দলের নেতাদের যুক্তি, ইউনাইটেডের ডাক্তাররা এর আগে বেগম জিয়ার চিকিৎসা করেছেন। ফলে তার সমস্যাটি তারা ভালো জানেন ও বোঝেন।
বাস্তবতা হলো, বিএসএমএমইউ দেশের সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক হাসপাতাল। দেশসেরা চিকিৎসকরাই এখানে কাজ করেন। কিন্তু তারপরও বেগম জিয়া বা তার দল কেন এই হাসপাতালের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না, সেটি একটি প্রশ্ন। সম্ভবত তাদের আশঙ্কা এই যে, যেহেতু এই হাসপাতালটি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, তাই সরকার যা চাইবে, চিকিৎসকরা তার বাইরে যাবেন না। পক্ষান্তরে ইউনাইটেড যেহেতু বেসরকারি হাসপাতাল এবং সেখানের কয়েকজন চিকিৎসক খালেদা জিয়াকে আগে দেখেছেন, ফলে এটির উপর তাদের আস্থা ও ভরসা বেশি। রোববার অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, যদি চিকিৎসকরা মনে করেন তাহলে বিএসএমএমইউর বাইরে অন্য কোনো হাসপাতালেও খালেদা জিয়ার চিকিৎসা হতে পারে। তার মানে সরকার এক্ষেত্রে বেশ নমনীয় মনে হচ্ছে।
মনে রাখা দরকার, খালেদা জিয়ার পরিচয় যাই হোক; তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা এবং একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী তারপরও তিনি এখন দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। কোনো বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তড়িঘড়ি করে এই বিচারটি হয়নি। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ায় প্রচুর সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই আদালত তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। সুতরাং এ মুহূর্তে তিনি একজন কয়েদি। স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি যে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার দাবিদার, কারাগারে নিশ্চয়ই সেটি পাবেন না। সরকারকে একদিকে যেমন কারাবিধি মেনে চলতে হয়, তেমনি বেগম জিয়ার নিরাপত্তাও মাথায় রাখতে হয়। কেননা কারাগারে তিনি যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে তার দলের পক্ষ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হবে। দেশে-বিদেশে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে।
মাঝখানে একবার শোনা গিয়েছিল, চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে হয়তো বিদেশে পাঠানো হবে। এটি খুব অস্বাভাবিক ছিল না এ কারণে যে, আমাদের নেতানেত্রীরা, এমনকি পাতিনেতারাও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। বিএসএমএমইউর মতো হাসপাতাল থাকতেও আমাদের এমপি-মন্ত্রীদের খুব সামান্য সংখ্যইকই এখানে চিকিৎসা নেন। তবে এ মুহূর্তে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া দেশে যেতে হয়তো রাজি হবেন না। সে কারণেই বোধ হয় বারবার ইউনাইটেড হাসপাতালের কথা বলছেন।
প্রশ্ন হলো খালেদা জিয়ার অসুস্থতাটা কী? তার চিকিৎসকদের ধারণা, সম্প্রতি তার মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। এ কারণে মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। কিন্তু সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, মাইল্ড স্ট্রোক নয়, বরং বেগম জিয়ার সুগার ফল করেছিল। চকলেট খাওয়ানোর পরে তা ঠিক হয়ে গেছে। যদিও কয়েকদিন আগে তার আইনজীবী, চিকিৎসক ও দলের নেতারা বলেছেন, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা আসলেই কতটা গুরুতর, তা চিকিৎসকরাই ভালো বলতে পারবেন। এখানে সমস্যা হলো, তার ব্যক্তিগত এবং দলীয় চিকিৎসকরা স্বাভাবিকভাবেই চাইবেন বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করতে যাতে আদালত জামিন ইস্যুতে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হন। আবার সমস্যা জটিল হলেও সরকার চাইবে এটিকে হাল্কাভাবে নিতে। অর্থাৎ একজন মানুষের অসুস্থতাই এখন রাজনীতির বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
যে অসুস্থ রাজনীতির কথা আমরা বলি, এবার অসুস্থতা নিয়েই তার চর্চা হচ্ছে বলে মনে হয় যা কাম্য নয়। বেগম জিয়া যদি সত্যিই বেশি অসুস্থ হন তাহলে তার পছন্দ অনুযায়ীই তার চিকিৎসার সুযোগ দেয়া উচিত। কেননা সরকার যদি নিজের সিদ্ধান্তে তার চিকিৎসা করে এবং তাতে যদি খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অনবতি ঘটে, তাহলে তার জন্য সরকারকে দায়ী করার একটা সুযোগ তৈরি হবে। নির্বাচনের বছরে এসে বিএনপিকে সরকার সেই সুযোগ কেন দেবে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)