বাংলা বর্ণমালার এই অক্ষরগুলো কালো। এই অক্ষরগুলো শোকের। শোক থেকে মহাশোকে পরিণত হতে হতে ১৫ই আগস্ট এখন মহাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। আমরা বঙ্গবন্ধুর শাহাদৎ বার্ষিকীকে এখন আর শুধু মাতম, শোক বা মহাশোকের মধ্য দিয়ে স্মরণ করি না। এই দিবস এখন মহাশক্তির জাগরণের এক অনুপ্রেরণা। এই মহাশক্তির মাধ্যমে দেশের সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে সত্যগ্রাহী সত্যের জাগরণের সময়। দানবের বিরুদ্ধে মানবের জেগে ওঠার অনুপ্রেরণার নাম ১৫ই আগস্ট। বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করার সেই প্রচেষ্টা এতো বছর পরে শুধু ধ্বংসই হয়নি বরং উল্টো বঙ্গবন্ধু এখন এক মহাশক্তি হিসেবে সারাবিশ্বে আর্বিভূত হয়েছেন শোষিত, নিপীড়িত, দলিত মথিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত, নিষ্পেষিত ও মজলুম মানুষের দিশারী হয়ে।
অসমাপ্ত শোকগাঁথা যা যুগ যুগ ধরে বহমান সারাবিশ্বের বাঙালির মননে সেই অসমাপ্ত শোকগাথা আজ বাঙালির অসমাপ্ত শক্তি সাহসের প্রতীক হয়ে ফিরে এসেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাকে এবং তার চেতনার জাগরণ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই-এই কথা এখন আর কোন দেশপ্রেমিক বাঙালির চেতনায় প্রতিভাত নয়। তিনি আছেন আমাদের সাথে সর্বত্র সবসময় সকল সত্য শক্তির সাথী হয়ে মানুষের পাশে। এটিই সবচেয়ে বড় সত্যি।
১৫ আগস্টের শোকগাঁথা এক অসমাপ্ত যাত্রা। এই শোকগাথা কোনদিন শেষ হবে না। যতোদিন বিশ্ববাঙালি জেগে থাকবে ততোদিন অনিবার্য ধারায় চলমান থাকবে এই শোকগাঁথা আর তার সাথে ক্রিয়াশীল থাকবে এই মহাশোকের মাধ্যমে মহাশক্তির উদ্বোধনের ধারা। তাইতো আজ বিশ্ববাঙালি জাতির কণ্ঠে বারবার ধ্বনিত হয়- ‘যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
সেই দিনের সেই ১৫ই আগস্ট জাতির জন্য ছিল সত্যিই কলঙ্কময় দিন। ৪৩ বছর আগে ১৯৭৫ সালের এই দিনে একদল বিপথগামী পাক হায়েনাদের প্রেতাত্মা তথা সেনাবাহিনীর একটি চক্রান্তকারী চক্র স্বপরিবারে হত্যা করে বাঙালি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ৪৭, ৫২, ৬৯, ৭০ সহ বিভিন্ন সময়ে মৃত্যুর দ্বার হতে বার বার ফিরে এসেছিলেন, ৭১-এ পাকিস্তানি হায়েনারা যা করতে পারে নাই, সেই কাজটিই অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ও পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সম্পাদন করে পাপিষ্ঠ ঘাতকরা। ওরা মানুষ নামের হায়েনার দল, ওরা শয়তানের প্রেতাত্মা। ওরা জঘন্য। ওরা বিপদগামী হিংস্র জানোয়ারের দল। একদিন যে অঙ্গুলি উঁচিয়ে বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর অঙ্গুলি চিরদিনের জন্য নিস্তেজ করে দিতে চেয়েছিল ঘাতকরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক সেই বাড়িতে। তারা ভেবেছিল আর কোনদিন ওই অঙ্গুলি আমাদেরকে প্রেরণা দিতে আসবেনা, দিবে না মুক্তির বারতা। কিন্তু তা হয়নি- বঙ্গবন্ধুর সেই তর্জনির গর্জন আরও শত সহস্রগুণ বেশি অনুরণিত হয়ে আজ বিশ্ববাঙালির ঘরে ঘরে প্রবাহিত। বঙ্গবন্ধু আর তাঁর তর্জনির গর্জনও মৃত্যুহীন।
মানুষ মরণশীল বলে সবারই একটি মৃত্যুদিন থাকে। তবে কোনো কোনো মানুষের শুধু দেহাবসানই ঘটে, মৃত্যু হয় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যিনি আমাদের জাতির পিতা, তার কি মৃত্যু হতে পারে ? না তিনি মৃত্যুহীন। চির অমর।
১৫ই আগস্টের সেই কালরাতে কী ঘটেছিল? বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী রেসিডেন্ট পি এ আ ফ ম মোহিতুল ইসলাম এর এজাহারে বর্ননায় পাওয়া যায়। ১৯৭৫ সালে তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে কর্মরত ছিলেন। ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ রাত আটটা থেকে ১৫ আগস্ট সকাল আটটা পর্যন্ত তিনি ডিউটিতে ছিলেন ওই বাড়িতে। ১৪ আগস্ট রাত বারোটার পর ১৫ আগস্ট রাত একটায় তিনি তাঁর নির্ধারিত বিছানায় শুতে যান। মামলার এজাহারে মোহিতুল উল্লেখ করেন, ‘তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তা খেয়াল নেই। হঠাৎ টেলিফোন মিস্ত্রি আমাকে উঠিয়ে জাগিয়ে তুলে বলেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব আপনাকে ডাকছেন। তখন সময় ভোর সাড়ে চারটা কি পাঁচটা। চারদিকে আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু ফোনে আমাকে বললেন, সেরনিয়াতের বাসায় দুষ্কৃতকারী আক্রমণ করেছে। আমি জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করলাম। অনেক চেষ্টার পরও পুলিশ কন্ট্রোল রুমে লাইন পাচ্ছিলাম না। তারপর গণভবন এক্সচেঞ্জে লাইন লাগানোর চেষ্টা করলাম। এরপর বঙ্গবন্ধু ওপর থেকে নিচে নেমে এসে আমার কাছে জানতে চান পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে কেন কেউ ফোন ধরছে না। এ সময় আমি ফোন ধরে হ্যালো হ্যালো বলে চিৎকার করছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু আমার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বললেন আমি প্রেসিডেন্ট বলছি। এ সময় দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে এক ঝাঁক গুলি এসে ওই কক্ষের দেয়ালে লাগল। তখন অন্য ফোনে চিফ সিকিউরিটি মহিউদ্দিন কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। গুলির তান্ডবে কাঁচের আঘাতে আমার ডান হাত দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। এসময় জানালা দিয়ে অনর্গল গুলি আসা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু শুয়ে পড়েন। আমিও শুয়ে পড়ি।
কিছুক্ষণ পর সাময়িকভাবে গুলিবর্ষণ বন্ধ হলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। ওপর থেকে কাজের ছেলে সেলিম ওরফে আবদুল বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবী ও চশমা নিয়ে এলো। পাঞ্জাবী ও চশমা পরে বঙ্গবন্ধু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। বঙ্গবন্ধু বললেন আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি এত গুলি চলছে তোমরা কি কর? এসময় শেখ কামাল বলল, আর্মি ও পুলিশ ভাই আপনারা আমার সঙ্গে আসুন। কালো পোশাক পরা একদল লোক এসে শেখ কামালের সামনে দাঁড়ালো। আমি মোহিতুল ও ডিএসপি নূরুল ইসলাম খান শেখ কামালের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নূরুল ইসলাম পেছন দিক থেকে টান দিয়ে আমাকে তার অফিস কক্ষে নিয়ে গেল। আমি ওখান থেকে উঁকি দিয়ে বাইরে দেখতে চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি গুলির শব্দ শুনলাম। এসময় শেখ কামাল গুলি খেয়ে আমার পায়ের কাছে এসে পড়লেন। কামাল ভাই চিৎকার করে বললেন, আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল, ভাই ওদেরকে বলেন।’ মোহিতুল ইসলামের এজাহারে বলেন, ‘আক্রমণকারীদের মধ্যে কালো পোশাকধারী ও খাকি পোশাকধারী ছিল। এসময় আবার আমরা গুলির শব্দ শোনার পর দেখি ডিএসপি নূরুল ইসলাম খানের পায়ে গুলি লেগেছে। তখন আমি বুঝতে পারলাম আক্রমণকারীরা আর্মির লোক। হত্যাকাণ্ডের জন্যই তারা এসেছে। নূরুল ইসলাম যখন আমাদেরকে রুম থেকে বের করে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলেন তখন মেজর বজলুল হুদা এসে আমার চুল টেনে ধরলো। বজলুল হুদা আমাদেরকে নিচে নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড় করালো। কিছুক্ষণ পর নিচে থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর উচ্চকণ্ঠ শুনলাম। বিকট শব্দে গুলি চলার শব্দ শুনতে পেলাম আমরা। শুনতে পেলাম মেয়েদের আত্মচিৎকার, আহাজারি। এরই মধ্যে শেখ রাসেল ও কাজের মেয়ে রুমাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। রাসেল আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমাকে মারবে না তো। আমি বললাম না তোমাকে কিছু বলবে না। আমার ধারণা ছিল অতটুকু বাচ্চাকে তারা কিছু বলবে না। কিছুক্ষণ পর রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রুমের মধ্যে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর মেজর বজলুল হুদা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মেজর ফারুককে বলে, অল আর ফিনিশড।’
কিন্তু না ঘাতকের সেই কথা সত্যি হয়নি। শেষ হয়নি কিছুই। বরং শুরু হয়েছে মাত্র। বঙ্গবন্ধু আর তার চেতনাকে হত্যা করা যায়নি বরং সেই চেতনার বিকাশ শুরু হয়েছে মাত্র। আর এই চেতনার ধারা অব্যাহত আছে যুগে যুগে কালে কালে বিশ্ববাঙালির হৃদয়ে। তাই ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অসমাপ্ত শোকগাথা অসমাপ্ত মহাশক্তির জাগরণের এক দিন হিসেবে আজ বিবেচ্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)