এক.
মাহবুবুল হক শাকিল ছাত্ররাজনীতিতে আমার সিনিয়র ছিলেন। নিকট সিনিয়র নন, কিছুটা দূরের সিনিয়র। শুধু সিনিয়র ছিলেন বললে পুরোটা বলা হবে না। প্রথম দেখা হবার কথা বলা যাক। মধ্যনব্বই পরবর্তী সময়, মধুতেই অনির্ধারিত এক বিলম্বিত সকাল। একটু রাশভারি ছিলেন, মনে হচ্ছিল ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। পরে বোঝা গেল বাজিয়ে নিচ্ছিলেন। অনেকগুলো বইয়ের নাম বলে পড়েছি কিনা জানতে চাইছিলেন। বইগুলো পড়া ছিল। অতটা জানা-শোনা ছিল সে দাবি করা করা যাচ্ছিল না। কনটেন্ট ডেপথ এবং ডেলিভারি স্মার্টনেস সংগঠনের জুনিয়রতম কর্মীকে মুগ্ধ করছিল। অন্য অনেক কিছুর সাথে হেমিংওয়ে ছিল আলোচনায়। সে সময়কার রাজনীতির কিছু সরল পাঠও ছিল। অরুণদার মিষ্টি বা ছোট সিঙারা ছিল কিনা এখন আর মনে নেই। অস্তিত্ব জুড়ে একটা অস্থিরতা ছিল, পরে মনে করতে পারি। মিছিল শুরু হচ্ছিল, প্রথম দিনের প্রথম দেখা, আলাপন বেশি আগালো না। পড়াশোনা আর জানাশোনার তাগিদটা মাথায় গেঁথে থাকলো। পরের দিনই দ্বিতীয় দেখা, শাহবাগে। অতি সকালের পিকেটিং শেষে সিলভানার নাশতা, চলতি রাজনৈতিক চুটকি আড্ডার কম্পোজিশন গড়ে দিয়েছিল। ছন্দপাত ঘটাল পুলিশের গেরিলা কায়দায় ধাওয়া। সে আরেক গল্প।
দুই.
সে সময়ে কলেজগুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়মিত হতো। ব্যান্ড সঙ্গীতের মতোই বক্তা চাহিদা থাকতো। শাকিল ভাই ছিলেন চাহিদা তালিকার শীর্ষে। তাতে নানা রকম ঝামেলাও হতো। তারপরও জেলার নেতারা খুব চাইতেন শাকিল ভাইকে নির্বাচনী বক্তা হিসেবে পেতে। ব্যান্ড-এর জনপ্রিয় শিল্পীদের সমানতালে জনপ্রিয় বক্তা হিসেবে সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন। ফিদেল কাস্ত্রো, সালভাদর আলেন্দে, প্যাট্রিস লুমুম্বা, ইরানের মোসাদ্দেক আহমেদসহ পৃথিবীর জাতীয়তাবাদী নেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর তুলনা তুলে ধরতেন। ইতিহাস হত্যার সে ঘোরতর দুঃসময়ে তরুণ মানসে জাগিয়ে রাখতেন জাতির জনকের অক্ষয় কীর্তি। বইয়ের পাতায় না পাওয়া ইতিহাসের মহামূল্য ধারাবিবরণী মুগ্ধ বিস্ময়ের ঘোরে থাকা শ্রোতাদের বিতরণ করতেন। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহ-সভাপতি হিসেবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দিনগুলোতে তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সম্মানে কিভাবে স্কটল্যান্ড ট্যুর অসমাপ্ত রেখে লন্ডন ফিরে এসেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুকে বহন করা গাড়ির দরোজা নিজে খুলে দিয়েছিলেন তা বলতেন অননুকরণীয় দক্ষতায়। সে ঘোর দুঃসময়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নামটুকু পর্যন্ত মুছে ফেলার সব বন্দোবস্ত পাকা করা হচ্ছিল তখন চারণ কবির মতোই যারা ছড়িয়ে দিতেন সেই বার্তা, শাকিল তাদের অগ্রগণ্য ছিলেন। ইতিহাস এবং সমসাময়িক প্রসঙ্গের দারুণ মেলবন্ধন ঘটাতেন শ্লোগানে, মিছিলে, বক্তৃতায়। অপরাজেয় বাংলা, মধুর ক্যান্টিন, ডাকসু’র খোলা চত্বর ছাড়িয়ে যেতো ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে স্টাইলিশ কথামালা। পদ্যের আয়োজনে গদ্য পরিবেশন করতেন মাহবুবুল হক শাকিল।
তিন.
২০১৫ সালের জুন মাসের কথা। অশ্লেষার রাক্ষসী বেলায় সেই শেষ সাংগঠনিক সফর এক সাথে। সাবেক সাধারণ সম্পাদক রোটনসহ এক গাড়িতে করে যাত্রা। পথে রোটনের গ্রামের বাড়িতে বিরতি এবং আহার। সে যাত্রায় মূল অনুষঙ্গ ছিল এক-এগারোর সময়ের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা। মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের খুব সুনাম করছিলেন। এক-এগারোর কঠিন দিনগুলোতে আনুগত্য আর বিশ্বস্ততার কঠিন কিন্তু খুবই প্রার্থিত নানা বিষয়ে আড্ডা চলছে অবিরাম। এক পর্যায়ে লন্ডনে আমাদের ভয়েস ফর শেখ হাসিনার কথা উঠলো। জানতে চাইছিলেন অন্য বন্ধুদের ভূমিকা। আমি চেপে যাচ্ছিলাম সঙ্গত-অসঙ্গত নানা কারণে। এক পর্যায়ে নাম ধরে জানতে চাইলে নীরবতার দেয়াল আর অটুট থাকলো না। উনি নিজেও কিছু ঘটনার কথা বললেন যা আমরা আগে জানতাম না। নেত্রীর আবেগকে কেউ কেউ কিভাবে কাজে লাগান তার সরেস কিছু বয়ান হলো। অসত্য, অর্ধসত্য কথামালার মিশেলে নেত্রীর অনুকম্পা আদায় করার মজার কথাবার্তাও বাদ পড়লো না। যতটুকু বলছিলেন তাই শুনছিলাম। সতর্ক ছিলেন কোনো আপাত গোপনীয় বিষয়ের পরিবেশনায়। আমরাও বাড়তি প্রশ্ন করে বিব্রত করা থেকে বিরত ছিলাম। ছাত্রলীগের সম্মেলন উপলক্ষ্যে যাওয়া। সময় বের করে প্রেসক্লাব যাওয়া এবং প্রত্যেক সাংবাদিকের ব্যক্তিগত খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। তার বস মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাৎক্ষণিক অর্থ সাহায্য এবং আরো কি করণীয় তা নিয়ে কথা বলছিলেন। সম্মেলনের মঞ্চে একটা তথ্য দেয়ার কারণে খুব খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এটা যেন আমি বার বার বলি। বিষয়টি ২০০৮ সালের মে মাসের। নেত্রি তখন আমেরিকা থেকে লন্ডন হয়ে ঢাকা ফিরবেন। লন্ডনে যাত্রা বিরতির সময় জারি হল সেই গায়েবি প্রেসনোট। বাংলাদেশের জল, স্থল ও আকাশ সীমায় কোনো বাহন যেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বহন না করে। ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজ নেত্রীর কনফার্ম করা টিকেটের বোর্ডিং দিচ্ছিলো না। অনেক তর্ক-বিতর্ক হলো হিথরো এয়ারপোর্টে। ব্রিটিশ এম পি এন মেইন সহ অনেকেই এসেছিলেন সেদিন। সে ঘোর অনিশ্চয়তার সময়ে নেত্রী হিসেব করতে বসেছিলেন পরিবার পিছু একটা করে চাকরি দেয়া যায় কিনা। কতোটা দেয়া সম্ভব, কতোদিন লাগবে। কতো বেশি ভর্তুকি দিলে কৃষক কতো বেশি উৎপাদন করবে। যখন দেশে ফেরার বোর্ডিং পাশ পাচ্ছেন না, কবে পাবেন জানছেন না তখন নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় চিন্তা করছিলেন তরুণদের কথা, কৃষকের কথা। শাকিল ভাই বার বার বলছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যার এই অনতিক্রম্য দেশপ্রেমের কথা যেন বার বার প্রচার করি। খুবই উদ্বেলিত হয়েছিলেন। একপর্যায়ে বেশ আবেগি হয়ে বলছিলেন, তোমাকে নিয়ে সারা দেশ ঘুরবো, বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার গল্প বলবো। সেই শেষ সাংগঠনিক যাত্রা, একসঙ্গে আড্ডা দেয়া, নানা স্বপ্ন দেখা।
এরপর সংক্ষিপ্ত দেখা জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায়। সেদিনই সন্ধ্যায় প্যারিস চলে আসবো বলে উনার দেয়া ডিনারটা মিস করেছিলাম। তারপর জীবিত একেবারেই শেষ দেখা আওয়ামী লীগ-এর জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয় অধিবেশনের শুরুর দিকে। এরপর দেখা হয়েছে বৃষ্টিঝরা এক দুপুরে। ময়মনসিংহের নিজ বাড়ির অনতি দূরে ভাটিকাশর কবরস্থানে। ইমামের মোনাজাত শেষ হলে মনে মনে প্রশ্ন করেছিলাম, কি এখানে শুয়ে আছেন কেন? অনেক কাজ বাকি রইল তো। রূপকথার কথামালার রাজপুত্রকে কিছুতেই মানাচ্ছিলো না ভাটিকাশর-এর শেষ শয্যায়। সহযাত্রী মিলনের সাথে যুগল প্রার্থনা শেষে নির্নিমেষ তাকানো। গর্সিয়া লোরকার মরণগাঁথা স্মরণে আসছিলো,
‘হেমন্ত আসবে ছোট সাদা শামুকের সাথে,
কুয়াশা রঙ আঙুর আর সারি সারি পাহাড়ের সাথে।
কিন্তু কেউ তোমার চোখে চোখ রাখবে না আর।
কারণ তুমি চিরকালের জন্য মৃত।’
ফরাসি লেখক পল ভ্যালেরি থেকেই ধার করেছিলাম, ‘সুন্দর স্মৃতি হলো হারিয়ে যাওয়া অমূল্য রত্ন’।
ভাটিকাশরে শেষ শয্যায় শায়িত মাহবুবুল হক শাকিল-এর সকল স্মৃতি আমার এবং অনেকের জন্য হারিয়ে যাওয়া রত্ন বিশেষ। জীবিত শাকিল-এর নানা কর্ম, ভুল-ভ্রান্তি (আমরা সবাই কম-বেশি তাই) ছাপিয়ে আমার কেবলি মনে হচ্ছিল, ‘আজিকে হয়েছে শান্তি, জীবনের ভুল ভ্রান্তি সব গেছে চুকে’।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)