একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের শরীরে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক কারখানা- ক্যামিক্যাল ফ্যাক্টরিটির নাম হচ্ছে ‘লিভার’। এই ‘লিভার’ই শরীরের ভেতরকার সব ধরনের রাসায়নিক পদার্থকে প্রক্রিয়াজাত (প্রসেসিং) করা। এই প্রসেসিং এর কাজটা যখন ব্যাহত হয়, অর্থ্যাৎ শরীরের স্বাভাবিক কর্মপ্রবাহের বিকৃতি বা বিচ্যূতি ঘটে- সেটিকে অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আসলে লিভারের অকার্যকারিতা থেকেই জন্ডিস নামের রোগটি উৎপত্তি- গ্রামাঞ্চলে যার এখনো পরিচিতি ‘পান্ডু ব্যারাম’ হিসেবে। জন্ডিস আক্রান্ত হলে একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক বর্ণের ‘বিকৃতি’ ঘটে, শরীর এবং চোখের রং হলুদ হয়ে যায়। বর্ণের বিবর্ণতা আসলে বাহ্যিক উপসর্গ, জন্ডিস ক্ষতিটা করে ভেতরের, এতোটাই ক্ষতি করে যে সময়মতো ব্যবস্থা নিতে না পারলে প্রাণ বাঁচানোই দায় হয়ে পড়ে।
সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘জন্ডিস’টা ঠিক কোন পর্যায়ে পৌছেছে- সাধারণ জনতা হিসেবে সেটি আমাদের পক্ষে অনুধাবন করা কঠিন। কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ‘অঙ্গের’ জন্ডিস আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারটি যার ডায়াগনসিসে ধরা পড়েছে, তিনি সেই তথ্যটুকু খোলামেলাভাবে প্রকাশ করেননি। সেটি অস্বাভাবিক কিছুও নয়। রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার দিকেও চিকিৎসককে নজর দিতে হয়। এই চিকিৎসক দীর্ঘদিন লন্ডনে বসবাস করেছেন, ফলে বিদেশি সংস্কৃতির অনেক ভালো দিক তার মধ্যে আছে। সে কারণেও হয়তো বা অসুস্থতার তথ্যটুকু প্রকাশ করলেও অসুস্থতাটা কোন পর্যায়ে সেটা প্রকাশ করেননি।
হ্যাঁ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দেশের অর্থনীতি এবং অর্থব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান দুটি প্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ এই অসুস্থতার খবর দিয়েছেন। গত শনিবার কিশোরগঞ্জে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, “যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক ইজ সাফারিং ফ্রম জন্ডিস, অর্থমন্ত্রীসহ অর্থ মন্ত্রণালয় ইজ সাফারিং ফ্রম জন্ডিস। তাদের কোনো আউটলুকই নেই।”(সূত্র: বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম)।
সৈয়দ আশরাফের তথ্য অনুসারে, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক – বাংলাদেশ ব্যাংক জন্ডিসে আক্রান্ত, দেশের অর্থমন্ত্রী নিজে জন্ডিসে আক্রান্ত, এবং পুরো অর্থ মন্ত্রণালয় জন্ডিসে আক্রান্ত। স্বল্পভাষী হিসেবে পরিচিত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক এবং শীর্ষ একজন মন্ত্রী যখন এই কথা বলেন, তখন তাকে হালকাভাবে নেওয়ার উপায় থাকে না। জন্ডিস যেমন মানবদেহের প্রধান রাসায়নিক কারখানা লিভারকে অকার্যকর করে ফেলার প্রচেষ্টা শুরু করে, তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘প্রধান রাসায়নিক কারখানাকে’ও নিশ্চয় অকার্যকর করে ফেলার প্রচেষ্টা নিয়েছে। হয়তো অনেকটা সফলও হয়েছে। নইলে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক প্রকাশ্যে এমন মন্তব্য করতেন না। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক অকার্যকর হয়ে পড়লে সরকারের কার্যকারিতা এবং সক্ষমতা নিয়ে কিন্তু আপনিতেই প্রশ্ন ওঠে।
কেননা- অর্থ মন্ত্রণালয় অকার্যকর হয়ে পড়লে সরকারের অর্থ সংক্রান্ত সব বিষয়েই তার প্রভাব পড়ে। দেশের অর্থনীতিতেও তার প্রতিক্রিয়া হয়। কিন্তু রাজনীতি নিয়ে আমরা যতোটা উচ্চকণ্ঠ, অর্থনীতি বা অন্যান্য নীতিনির্ধারনী বিষয়ে আমরা ততোটাই নীরব থাকি। তবুও মাঝে মধ্যেই বিনিয়োগের হার নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে চাপা ফিসফাস কানে আসে। এই সরকারের আমলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়ে যাওয়ার ঘটনাতো ‘সরকারি প্রেসনোটের’ মতোই প্রকাশিত এবং প্রচারিত। অর্থ মন্ত্রণালয় কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক লুটপাট বন্ধে কিছুতো করতে পারেইনি, এমনকি লুটপাটের পরেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। নতুন অনুমোদন পাওয়া মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ব্যাংকেও পর্যবেক্ষক বসাতে হয়েছে। অথচ এই ব্যাংকগুলো যখন অনিয়ম করে, তখন ধরার মতো, ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এর ‘একদা রাখাল ছিলাম রে’ ইমেজ যতোটা প্রচার পেয়েছে, অর্থনীতির বুনিয়াদ শক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা নিয়ে কমই কথাবার্তা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী তাঁর ‘বেফাঁস’ কথাবার্তার কারণেই হয়তোবা ‘লুটেরাদের দাদু জাতীয় অভিভাবক’ এর একটি ভাবমূর্তি তৈরি করে ফেলেছেন। দেশের শেয়ারবাজারে হাত পুড়ানো অনেক বন্ধুকেই দেখি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে কষে গালাগালি করেন। এতোদিন মনে হতো- শেয়ারবাজারে হাত পুড়ানোর যন্ত্রণার বহি:প্রকাশ।
কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রী যখন সরকারের এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে ‘অসুস্থ’ হিসেবে ঘোষণা করেন, তখন সেটিকে আর শুধু শেয়ারবাজারে হাতপুড়ানো নাগরিকদের মনোবেদনার বহি:প্রকাশ হিসেবে ভাববার সুযোগ থাকে না। তখন বরং বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত হতে হয়। প্রত্যেকেই জানেন- জন্ডিস লিভারের কার্যক্ষমতা ধরে টান দেয়। অবহেলায় কিংবা ভুল চিকিৎসায় জন্ডিসই আবার লিভার ক্যান্সারের রুপ নিতে পারে বলেও বলতে শোনা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বা অর্থ মন্ত্রণালয় কেবল অর্থনীতির ‘লিভার’ হিসেবেই কাজ করে না, সরকারের ‘লিভার’ হিসেবেও কাজ করে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় জন্ডিস আক্রান্ত হয়ে পড়লে, পুরো সরকার যে এই রোগ থেকে মুক্ত- তা আর শক্তভাবে বলা যায় না। সরকারকে এই রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে তখন জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থমন্ত্রী এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের জন্য কি ‘জন্ডিসের চিকিৎসা’ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে? না হলে সেই চিকিৎসাটা কখন, কিভাবে শুরু হবে? দেশের অর্থনীতি, সরকার তথা পুরো দেশকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়ার মতো একটা অসুস্থতাকে নিশ্চয়ই সরকার উপেক্ষা করবে না।