চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

অভিমানে ক্রিকেট ছেড়ে ফ্রিল্যান্সার

একবুক হতাশা আর অভিমানে ক্রিকেট ছেড়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে নাম লিখিয়েছেন দুই হাতে বোলিং করতে জানা শায়লা শারমিন। ফেব্রুয়ারি-মার্চে অস্ট্রেলিয়ায় হওয়া টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের স্ট্যান্ডবাই খেলোয়াড় ছিলেন সব্যসাচী এ প্রতিভা। সাত বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থমকে গেল ১৬ টি-টুয়েন্টি ও ৯ ওয়ানডেতে।

‘পারফর্ম করেও জাতীয় দলে নিয়মিত হতে না পারা ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) থেকে কয়েকবছর ধরে বেতন না পাওয়ার হতাশা থেকেই খেলা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর কখনোই ক্রিকেটে ফিরব না।’ খুলনার মেয়ে শায়লা চ্যানেল আই অনলাইনকে বললেন এমনই।

নানা দিক থেকে বঞ্চনার শিকার হওয়া ২৭ বছর বয়সী স্পিনিং অলরাউন্ডার শায়লার খেলাটার প্রতি জন্মেছে অভিমান। ফেসবুক থেকে মুছে ফেলেছেন নিজের ক্রিকেটার পরিচয়। এমনকি ক্রিকেট মাঠে তোলা ছবিও সরিয়ে ফেলেছেন। একজন সফল গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাই এখন তার একমাত্র লক্ষ্য। ল্যাপটপ নিয়ে সারাদিন কাটে শায়লার।

‘বাংলাদেশ সরকারের লার্নিং এন্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে গ্রাফিক ডিজাইন শিখছি। কাজও পেতে শুরু করেছি। একটি লোগা ডিজাইন করে ২৫ ডলার আমার প্রথম আয়। বিশ্বাস করি ফ্রিল্যান্সিং করে আরও সামনে যেতে পারব। যখন যেটি করেছি, সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও মনোযোগ দিয়েছি। প্রশিক্ষণ নেয়ার আগে থেকেই ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে কিছু বেসিক কাজ শিখেছিলাম। লকডাউনের সময়টা ডিজাইনিং নিয়েই পড়ে ছিলাম।’

‘অনেক অবজ্ঞার শিকার হয়েছি। অলৌকিক স্বপ্নের জাল থেকে মুক্ত হতে পেরে ভালো লাগছে। টিভিতে খেলা দেখা, নিউজ পড়া, ইউটিউবে ম্যাচের হাইলাইটস আর দেখি না। নিজের পরিচয় পুরোপুরি বদলে ফেলেছি।’

শায়লা এখন গ্রাফিক ডিজাইনার

‘স্বপ্ন দেখতাম আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে নিজেকে তুলব। সে চিন্তা থেকেই নিজেকে গড়ে তুলেছিলাম। কিন্তু সেভাবে ম্যাচ খেলার সুযোগ পাইনি। পাশাপাশি ২০১৭ সালের পর বিসিবির বেতন কাঠামোতেও আমি নেই। নিয়ম হল যারা জাতীয় দলে খেলবে তারা মৌসুম শেষে ক্যাটাগরি অনুযায়ী পুরো অর্থবছরের বেতন পাবে। বিশ্বকাপ ছাড়া গেল অর্থবছরে আমি ক্রিকেট বোর্ডকে সার্ভিস দিয়েছি। বিশ্বকাপের মূল দল ছাড়া সবখানেই ছিলাম।’

‘বিশ্বকাপের আগে ভারত সফরে গিয়েছি। শ্রীলঙ্কায় ইমার্জিং দলকে নেতৃত্ব দিয়েছি, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও খেলেছি, দ্বিপাক্ষিক সিরিজের দলে ছিলাম। অথচ একদম নতুন যারা এসেছে দুই-একটি ম্যাচ খেলেছে কিংবা খেলেনি, তারাও বোর্ড থেকে বেতন পাচ্ছে। বিসিবির উইমেনস উইং প্রধান থেকে শুরু করে সবার সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেছি, তারা সদুত্তর দিতে পারেননি। বলেছেন বিষয়টি দেখবেন। আর কত অপেক্ষা করব!’

‘চেয়েছিলাম বড় ক্রিকেটার হবো। পাশাপাশি নিজেকে তৈরি করব পরিপূর্ণভাবে। এআইইউবি’তে বিবিএ নিয়ে পড়ছিলাম। যদিও সেমিস্টার ড্রপ যাচ্ছিল খেলা, ক্যাম্প থাকায়। এখন ফ্রিল্যান্সিং নিয়েই বাঁচার স্বপ্ন।’

একটু একটু করে জমা অভিমানের বিস্ফোরণ ঘটে এ বছরের শুরুতে। বিশ্বকাপের জন্য দল ঘোষণার আগেই জানতে পারেন তার নাম নেই। অনুশীলনে ক্যাম্পে চার ম্যাচের দুটিতে রান পেলেও ভাগ্য লেখা হয়ে যায় আগেই! মিরপুরের ক্যাম্প ছেড়ে চলে আসতে চেয়েছিলেন। হেড কোচ অঞ্জু জৈনকে জানান, তিনি প্রস্তুতি ম্যাচে অংশ নেবেন না। দলের সঙ্গে থেকেও আর খেলেননি শায়লা। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে দল ঘোষণায় স্ট্যান্ডবাই রাখা হয় তাকে।

ক্যাম্প শেষ করে সেই যে বেরিয়ে গেছেন, আর ফেরেননি ক্রিকেট মাঠে। মিরপুরের একাডেমি মাঠ থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন থাকবেন না আর এই খেলায়। খুলনায় ফিরে ব্যাট-বল ধরেননি শায়লা। লকডাউন ওঠার পর শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে নিয়মিত অনুশীলন করা সালমা খাতুন, রুমানা আহমেদরা প্রথমে ভেবেছিলেন করোনার কারণেই হয়ত মাঠে আসছেন না শায়লা। পরে সতীর্থরা জানতে পারেন অভিমানে খেলাই ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন টাইগ্রেস অলরাউন্ডার।

বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক রুমানা আহমেদ তাকে নিয়ে বললেন, ‘খুবই পরিশ্রমী একজন ক্রিকেটার শায়লা। খেলায় থাকলে অনেক ভালো কিছু করতে পারত।’

যার হাত ধরে ক্রিকেটে আসা, খুলনা বিভাগীয় নারী দলের সেই কোচ ইমতিয়াজ হোসেন পিলু বললেন, ‘শায়লার সবচেয়ে বড় গুণ শৃঙ্খলা। খুবই পরিশ্রম করত। মার্কিং করলে ‘এ’ ক্যাটাগরির ক্রিকেটার বলব। জাতীয় দলে ঠিকভাবে সুযোগ পেলে ‘এ’ প্লাসও হতে পারত।’

‘খুবই দুর্ভাগা একজন ক্রিকেটার। একযুগ আগে বাবাকে হারিয়েছে। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অনেক উত্থান-পতন দেখেছে। ওর খেলায় দুইবার চোট বাধা হয়ে এসেছিল। একবার হাত মচকাল, আরেকবার পা। তারপরও দমে যায়নি। অনেক স্বপ্নবাজ একটি মেয়ে। বাংলাদেশ দল ভালো একজন ক্রিকেটার হারাল।’

শায়লা সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে। স্কটল্যান্ডে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ফাইনালে নেপালের মেয়েদের বিপক্ষে ৩ ওভারে ৯ রান দিয়ে উইকেট নেন ২টি। অক্টোবরে ইমার্জিং এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক করে শ্রীলঙ্কা পাঠানো হয় তাকে। গত জানুয়ারিতে ভারতের মাটিতে ত্রিদেশীয় টি-টুয়েন্টি সিরিজের দলেও ছিলেন।

২০১৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই হাতেই বোলিং করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নজর কাড়েন শায়লা

অল্পদিনেই শায়লার খুব কাছের একজন হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় দলের ওপেনার মুর্শিদা খাতুন। প্রিয় সতীর্থের খেলা ছাড়ার খবর জেনে বিস্মিত-আবেগাপ্লুত হয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে মনের দুয়ার খুলে দিলেন তিনি।

‘আমার নিজেরই খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব প্রতিভাবান একজন ক্রিকেটার। তারচেয়েও ভালো একজন মানুষ হিসেবে তাকে গণ্য করি। শায়লা আপুর কাছ থেকে ডিসিপ্লিন জিনিসটা শিখেছি। আর যেকোনো খেলায় এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিকেট নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। মাঝেমাঝেই তার সঙ্গে কথা হতো, বলতো খেলা ছেড়ে দেবে। বিশ্বাস করতে চাইনি, তবে সেটিই সত্যি হল।’

২০১৩ সালে জাতীয় দলে অভিষিক্ত হওয়া শায়লা নিজেকে দুর্ভাগা মনে করেন। বললেন, ‘২০১৭ সালে নারী দলের সকল ক্রিকেটারকে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে দেয়া এক লক্ষ টাকার পুরস্কারও আমি পাইনি। শ্রীলঙ্কার ঘরোয়া লিগ খেলায় আমি গণভবনে যেতে পারিনি। আমার জানা মতে সেই চেক বিসিবিতে আসার কথা। ওই অনুষ্ঠানে খাদিজাতুল কুবরাও দেশের বাড়িতে থাকায় উপস্থিত থাকতে পারেনি। কিন্তু পরে বিসিবি তাকে চেক বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি সেটি আজ পর্যন্ত পেলাম না।’

‘গত বছরের প্রিমিয়ার লিগের টাকাও অর্ধেক পাওনা আছে। শেখ রাসেল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট একাডেমির ম্যানেজার বলেছিলেন ২৫ নভেম্বর ২ লাখ ১০ হাজার টাকা বুঝিয়ে দেবেন। কিন্তু তারা কথা রাখেননি। জানি না কেনো আমার সঙ্গে বারবার এমন হয়! ক্রিকেট থেকে কিছু পাওয়ার আর আশা নেই। মনকে শক্ত করে বেরিয়ে এসেছি। বুঝেশুনেই ক্রিকেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আর ফিরব না।’