‘উন্নয়নের মহাসড়কে, অভিবাসীরা সবার আগে’ এ প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশে উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সব দেশে পালিত হয়ে আসছে দিনটি।
বিশেষ এই দিনটিতে প্রবাসী বাঙ্গালিদের শুভকামনা জানিয়ে এবং কাছের মানুষদের নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’র সমন্বয়ক শাহানা হুদা। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন:
“আমার মা কয়েকমাস আগে আমাকে ফোন করে বলল, “শুন শাহজাহান তোর সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছে।” শাহজাহান অনেক আগে আম্মার ফাই-ফরমাশ খাটতো। এখন সবজি বিক্রি করে। আমি বেশ বিরক্ত হয়ে বললাম, “কেন আম্মা? আমার কাছে আবার কী দরকার?” উত্তরে আম্মা যা বলল তাতে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পাচ্ছিলাম না। আম্মা বলল, “না ওই যে তুই নাকি বিদেশে লোক পাঠাইস, এইটা জেনে ও আসছে। বিদেশে যেতে চায়।” আমি বললাম, “আম্মা এর মানে কী? আমি কি আদম ব্যবসায়ী? এইসব কী বলে বেড়াচ্ছ তুমি একে তাকে? আচ্ছা আমার কাছে ভাল এজেন্সির নাম ঠিকানা আছে, তুমি শাহজাহানকে দিয়ে দেও। আর আম্মা, প্লিজ কখনও বলো না যে আমি বিদেশে লোক পাঠাই। লোকে আমাকে আদম ব্যবসায়ী মনে করবে।” আম্মার এ রকমটা বলার অবশ্য একটা কারণ আছে।
শিল্পী আমার বাসায় ছিল প্রায় ৫/৬ বছর। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ও পড়াশোনাও করেছে ওপেন ইউনিভারসিটির অধীনে। বরাবরই ওর চলাফেরা, কাজকর্ম, আচার-আচরণ ছিল খুবই চমৎকার, স্মার্ট এবং সবচেয়ে বড় কথা দারুণ প্রফেশনাল। আমাদের বাসাতে ও যতদিন ছিল, ওকে নিয়ে আমরা খুব খুশি ছিলাম। যদিও অনেকে ভাবতো আমি ওদের অতিরিক্ত আস্কারা বা স্বাধীনতা দিয়েছি।তা কিছুটা দিয়েছি বটে। কারণ আমি বিশ্বাস করি স্বাধীনভাবে কথা বলা, কাজ করা আমাদের সবারই অধিকার, যদি তা বেপরোয়া না হয়। আমি যখন অভিবাসন নিয়ে কর্মরত, আমার কলিগ সারাওয়াতের মাধ্যমে খবর পেলাম হংকং-এ নারী গৃহশ্রমিক নিচ্ছে, সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নিলাম শিল্পীকে পাঠিয়ে দিবো। ওর সবকিছু একবারে পারফেক্ট ছিল, অভিবাসনের জন্য।
তারপর দৌঁড়াদৌঁড়ি করে ওর পাসপোর্ট করানো হলো, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করলাম, মেডিক্যাল করালাম, ট্রেনিং সেন্টারে পাঠালাম – ব্যস তারপর শিল্পী একদিন প্লেনে চেপে চলে গেল হংকং। এরপরের যুদ্ধটা ও একাই করেছে। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, নতুন ভাষা, খাবার দাবারও অচেনা (সাপ, ব্যঙ, কেঁচো কোনটাই বাদ নাই) এবং সবচেয়ে কষ্টের ছিল যে ওর আশেপাশে কোন স্বজন ছিল না। কিন্তু শিল্পী জয় করেছে সব বাধা। পুরোটাই ও একা সামলেছে। আমি শুধু ওকে সাহস দিয়ে গেছি।
দু’বছর পর এসে আবার কনট্রাক্ট নবায়ন করে গেছে। ওর বেতন প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। থাকা খাওয়া, আসা-যাওয়া সব ফ্রি। ও যার বাসায় কাজ করছে, তারা ওকে অনেক ভালবাসে। এখন তো ওদের দোকানেও সেলসে কাজ করে । ফটাফট কথা বলছে ইংরেজী ও চাইনিজ ভাষায়। হংকং এখন ওর হাতের মুঠোয়। ও স্বপ্ন দেখছে সুযোগ পেলে চলে যাবে ইউরোপে। ব্যাপারটা আমি এখনও আমার এই অবস্থানে থেকেও ভাবতে পারি না। একা একা কোনো অচেনা মুল্লুকে গিয়ে কাজ করে টিকে যাচ্ছি। ভাবাই যায় না।
শিল্পী একজন নারী হয়েও অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে সফল হয়েছে। আসলে মনোবল, স্মার্টনেস, ভাল এজেন্সীর সহায়তা পেলে, নিয়ম মেনে বিদেশ গেলে এবং একটু ঝামেলা পোহানোর মত মানসিকতা নিয়ে আমরা ওদের পাশে দাঁড়ালে – অনেকেই এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারবে। শিল্পী ওর পুরো পরিবারকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শিল্পীকে দেখে উৎসাহিত হয়ে এখন যাচ্ছে ওর বোন চম্পা। ওরও সব প্রসিডিওর শেষ, এখন শুধু প্লেনে ওঠা বাকি। চম্পা ছিল আমার বন্ধু রাফাতের কাছে। আমি এবার উদ্যোগ নিয়েছি আমার আরেক গৃহকর্মী সুলতানাকে পাঠানোর জন্য, যে এসেছিল শিল্পীর জায়গায়। পাসপোর্ট রেডি, তবে কিছু প্রসিডিওর এখনও বাকি।
যখন দেখি আমার দেশের খুব সাধারণ একটি নারী বা পুরুষ বিদেশের মাটিতে নিজ উদ্যোগে, সাহস করে, কষ্ট সহ্য করে দাঁড়িয়ে গেছে এবং তাদের আয়ের টাকায় আমার দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে – তখন গর্বে এ বুকটা ভরে ওঠে। স্যালুট জানাই আমার দেশের সব অভিবাসী ভাই ও বোনদের। তোমাদের কাছে আমরা ঋণী।”