সুদূর অতীত থেকেই সবাই জানে জাপানের কঠোর পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের কথা। সেখানে ‘উচি-সোতো’ বলে একটা ধারণা প্রচলিত আছে, যার মাধ্যমে কাছের আর দূরের মানুষকে দু’টো আলাদা দলে জাপানিরা ভাগ করে।
উচি মানে ঘরের লোক, অর্থাৎ পরিবার, বন্ধু এবং খুব কাজের অল্প কিছু মানুষ। আর সোতো মানে বাইরের লোক, যারা সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা সীমারেখার বাইরে অবস্থান করে।
২৫ বছর বয়সী ভিয়েতনামি শিক্ষার্থী লিন নাগুইয়েন আগে থেকেই জানতেন জাপানের এই প্রথা সম্পর্কে। তাই বুঝেই নিয়েছিলেন নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ জাপানি সমাজ ব্যবস্থায় যতই কাছে যেতে চান না কেন, চিরকাল তিনি বাইরের লোক হয়েই থাকবেন।
কিন্তু বাস্তবে জাপানে গিয়ে লিন বুঝলেন তার ধারণা আর বাস্তবতায় কতটা ফারাক। কোনো এককালে আত্মকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও ধীরে ধীরে সেখানেও পরিবর্তন আসছে। এর কারণ জাপানের জনমিতিক পরিস্থিতি।
জাপানে নতুন শিশুর জন্মহার বর্তমানে যথেষ্ট কম। ফলে দেশটির অধিকাংশ মানুষ এখন বার্ধক্যের পথে। দেশটির ২০ শতাংশেরও বেশি মানুষের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি।
মোট লোকসংখ্যাও দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। ২০১৭ সালে জাপানে মাত্র ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬০ টি শিশুর জন্ম হয়েছিল, যা ১৮৯৯ সাল থেকে নথিকরণ শুরু হওয়া তালিকায় রেকর্ড পরিমাণ কম। বৃদ্ধের সংখ্যা বাড়তে থাকায় বেড়ে গেছে মৃত্যুহার।
এমন অবস্থায় সরকার অভিবাসন ইস্যুতে সরকারের প্রচলিত রক্ষণশীল মতধারা আর দেশের নতুন ও তরুণ কর্মীর চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে।
দেশের জনমতও পরিবর্তনেরই পক্ষে বলে এক বিশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে সিএনএন। দেশটিতে ‘জেনোফোবিয়া’ বা বিদেশিদের প্রতি আতঙ্কের মনোভাব ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের চলতি বছরে পরিচালিত এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ৫৯ শতাংশ জাপানি এখন বিশ্বাস করে, অভিবাসীরা এলে আসলে তাতে জাপান আরও শক্তিশালী হবে।
সরকারও মূলত এমনটাই ভাবছে। তাই প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকখানি সরে গিয়ে চলতি সপ্তাহে জাপানের আইনপ্রণেতারা অভিবাসন নীতিতে বড় রকমের একটা পরিবর্তনের প্রস্তাবের পক্ষে অনুমোদন দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রস্তাবিত ওই নতুন নীতি বাস্তবায়িত হলে জাপানে নতুন কয়েকটি ভিসা ক্যাটেগরি চালু হবে, যার সাহায্যে আগামী পাঁচ বছরে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার বিদেশি কর্মীর উচ্চ-দক্ষতা এবং কম মজুরি – দু’ধরনের চাকরির নতুন সুযোগ হবে।
এক্ষেত্রে তুলনামূলক কম বেতনের চাকরিগুলো পাবেন একটু কম যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মীরা। এ ধরনের ভিসা সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত নবায়ন করে জাপানে থাকা যাবে। আর অন্য ভিসাটি উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন অভিজ্ঞ ও উচ্চশিক্ষিত কর্মকর্তাদের জন্য। এই ভিসার কোনো নবায়ন সীমা নেই।
তবে দুই ক্ষেত্রেই আবেদনকারীকে জাপানি ভাষায় দক্ষ হতে হবে।
বিষয়টিকে ইতিবাচক এবং আশা জাগানিয়া হিসেবে দেখলেও অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন এই পরিকল্পনা জাপানে বেশিদিন টিকবে না।
অভিবাসীরা কেন জাপানকে বেছে নেবে?
টোকিওর মেইজি ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসাকাজু কাতোর মতে, প্রধানমন্ত্রী আবে যদি চান তার দেশের জনসংখ্যা যেন ২০৬০ সাল আসতে আসতে ১০ কোটির নিচে চলে না যায়, তবে তাকে অভিবাসীদের যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে জাপানকে কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়ার জন্য।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের লোকজন একে অপরকে কোন চোখে দেখে, ২০১৫ সালে পিউ পরিচালিত এমন একটি জরিপে দেখা গেল, ৭১ শতাংশ জনগণের মধ্যক জাপানের প্রতি এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে, যা নেতিবাচক চিন্তাধারাকে ৫-১ হিসেবে হারিয়ে দিচ্ছে।
অন্যদিকে লিন নাগুইয়েন বলেন, পরিবেশের সুরক্ষায় সচেতনতা এবং দেশের সন্তোষজনক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জাপানের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি পয়েন্ট।
তবুও ‘কিন্তু’ থেকে যায়…
এমনিতে রক্ষণশীল হলেও জাপান প্রায়ই কাজের খাতিরে অভিবাসীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। কিন্তু সেই অভিবাসীদের ঠিকঠাক মূল্যায়ন ও ব্যবস্থাপনায় ঐতিহাসিকভাবে বারবার ব্যর্থতা দেখিয়ে এসেছে দেশটি।
১৯৯০ এর দশকে তীব্র শ্রম সংকটের মুখে জাপান সরকার তার অভিবাসন নীতিতে সংস্কার এনেছিল। ওই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান থেকে ল্যাটিন আমেরিকায় চলে যাওয়া অভিবাসীদের উত্তরসূরীদের প্রলুব্ধ করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী, নবায়নযোগ্য ভিসার অফার দেয়া হয়েছিল। দীর্ঘমেয়াদী সুযোগের আশ্বাসে বেশিরভাগই চলে এসেছিলেন জাপানে।
কিন্তু ২০০৮ সালে জাপানে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে সরকার সেই অভিবাসীদেরকেই বললেন ব্রাজিলসহ ল্যাটিন আমেরিকার যেসব দেশ থেকে তারা এসেছিলেন সেখানে যেন ফিরে যান।
‘জাপান তার বিদেশি কর্মীদের সঙ্গে টিস্যু পেপারের মতো আচরণ করে,’ বলে মন্তব্য করেছেন টেম্পল ইউনিভার্সিটির জাপানিজ স্টাডিজের অধ্যাপক জেফ কিংস্টন। সিএনএন’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ওরা ব্যবহার করে ফেলে দাও মানসিকতার অধিকারী।’
তাছাড়া জাপানের কাছাকাছিই আছে অভিবাসীদের জন্য বেটার অপশন – সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুর তুলনামূলক ব্যয়বহুল হলেও তা তুলনামূলকভাবে অভিবাসন-বান্ধব। ১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই ছোট্ট নগররাষ্ট্রটি আশপাশের দেশগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী নেয়ার মধ্য দিয়ে নিজস্ব একটি বৈচিত্র্যময় সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
বর্তমান সময়ে সিঙ্গাপুরের মোট শ্রমশক্তির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বিদেশি, যদিও সেখানকার পরিস্থিতি কম দক্ষতার শ্রমিকদের জন্য অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং এবং শ্রমিক নিপীড়নের বহু ঘটনাও ঘটছে সেখানে।
তবে সিঙ্গাপুরের ওয়েবসাইটে সরাসরিই বলা আছে, তারা নন-রেসিডেন্ট (অস্থায়ী অধিবাসী) বিদেশিদের জন্য এমন কাজ রাখে যা সিঙ্গাপুরের জনগণ করতে আগ্রহী না। ফলে এসব কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের নাগরিক ও অভিবাসীদের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতাও হয় না।
তাই নতুন নীতি অনুমোদন হলেও প্রশ্ন উঠেছে, অতীতের খারাপ রেকর্ডের পর আদৌ অভিবাসীরা সাহস করবে কিনা জাপানে আসার।