দেশের জনশক্তি খাত বরাবরই আমাদের সমগ্র অর্থনৈতিক খাতকে সচল রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বললে ভুল হবে না। প্রতিবছর এই খাত থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসে আর কোনো খাত থেকে সে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসে না-এটি অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান।
আরো উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো-অন্যান্য ব্যবসায়িক বা বিনিয়োগ খাতে সরকারকে যে পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা, ভতুর্কি বা প্রণোদনা দিতে হয়-এ খাতে সেভাবে দেওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। এবং এই একমাত্র খাত যেখানে সরকারের রিটার্ণ সবচেয়ে বেশি। বলতেই হয় আমাদের এই সাফল্যের সব কৃতিত্ব অভিবাসী শ্রমিকদের, যারা বছরের পর বছর মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজস্ব শ্রম বিক্রি করে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রেরণ করছেন।
জনশক্তি খাতে আমাদের সাফল্য ও সম্ভাবনার কথা সবাই বলে থাকে। বিশেষজ্ঞরাও বলে থাকেন এই খাত না থাকলে আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তো। কেননা এখন পর্যন্ত এই খাতে বছর ওয়ারি যে আর্নিং সেটা অন্য কোনো খাত টপকাতে পারেনি। কিন্তু একটা বিষয় আমরা বরাবরই লক্ষ্য করছি জনশক্তি খাতে ধারাবাহিকভাবে অভিবাসন ব্যয় বৃদ্ধি হওয়ার কারণে বারবার এই খাত বিতর্কিক এবং বিপর্যস্ত হচ্ছে।
জনশক্তি খাতে যে বহুবিধ সমস্যা বিরাজমান এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো-অভিবাসন ব্যয় বা মাইগ্রেশন কস্টের উচ্চহার। বাংলাদেশ থেকে এখন কোনো শ্রমিককে যে কোনো দেশে পাড়ি দিতে গেলে তার গড় হয় খরচ আড়াই লক্ষ টাকা থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা। কখনও কখনও তা আরও ছাড়িয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে এই বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে একজন তরুণ শ্রমিক যে স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে কাজ করতে যান সেই স্বপ্ন ভেঙে পড়ে দ্রুতই। অনেকেই তিন চার বছর ধরে বিদেশের মাটিতে শ্রম বিক্রি করে নিজের খরচের টাকাই উঠাতে পারেন না। আবার একশ্রেণীর দালার চক্র নানা অজুহাতে শ্রমিকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে থাকে। এরকম ঘটনা এখন সর্বত্রই। হাজার হাজার শ্রমিকের ভাগ্যে এখন এমনটিই ঘটছে।
মূলত জনশক্তি খাতে মধ্যস্বত্ত্বভোগী নামে যে বৈধ এবং অবৈধ দুষ্টুচক্র রয়েছে মূলত এরাই অভিবাসী হতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের জিম্মি করে এমন এক দুর্বিসহ অবস্থা তৈরি করেছে। এই চক্রের সাথে আবার পরিপূর্ণভাবে সম্পৃক্ত কিছু অতি মুনাফালোভী কথিত রিক্রুটিং এজেন্সী। আবার কিছু বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সীগুলোও এখন এই দালাল চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে প্রতীয়মান। বিভিন্ন সূত্রে মতে, দেশে এবং দেশের বাইরে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে দালালদের নিজস্ব শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। এই নেটওয়ার্ক একজন শ্রমিককে বিদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে শ্রমিকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকে।
এই দালাল চক্র একসময় মালয়েশিয়াতে এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে তাদেরকে ছাড়া চাকরিও যোগাড় করা সম্ভব হতো না। মালয়েশিয়াতে থেকে ভুক্তভোগীদের অনেকেই জানিয়েছেন তারা বিভিন্ন কোম্পানি বা ফ্যাক্টরিতে চাকরি করলেও তারা কখনই কোম্পানীর কাছ থেকে বেতন সরাসরি নিজের হাতে পান না। যে কথিত এজেন্টরা বিভিন্ন কোম্পানী, ফার্মে তাদের নিয়োগ দিয়ে থাকে মূলত তাদের হাত হয়েই তারা বেতন পেয়ে থাকে। ফলে কোনো সময়ই তারা তাদের প্রাপ্য বেতন পান না। এমন কী অনেকক্ষেত্রে তারা জানতেই পারে না তাদের মূল বেতন কতো। কেননা চুক্তিপত্র পর্যন্ত দালালরা নিজেদেও কাছে রেখে দেয়।
ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আরও জানা যায, মালয়েশিয়াতে একসময় কথিত দালাল চক্র বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে প্রথমে বিভিন্ন ডরমেটরিতে রেখে দিত। দালালরাই তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতো। এরপর দালালরা তাদের চাকরির ব্যবস্থা কওে দিত বড় ধরনের কমিশনের বিনিময়ে। আবার প্রথম মাসেই তারা শ্রমিকের বেতন থেকে কমিশন কেটে রাখতা। মালয়েশিয়াতে এই ব্যবসা এতোটাই জমে উঠেছিল যে ফলে অনেকেই ভিটেবাড়ি রেখে বছরের পর বছর মালয়েশিয়াতে থাকলেও তারা তাদের অভিবাসন খরচ পর্যন্ত উঠাতে পারতো না।
একই অবস্থা এখন সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। একশ্রেণীর সিন্ডিকেট এবং দালাল চক্রের কারণে সিঙ্গাপুরে অভিবাসন খরচ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অভিবাসী হতে ইচ্ছুক অনেক শ্রমিকই মোটা অংকের টাকার কারণে বিদেশে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। জানা যায়, এই ভুক্তভোগীর শিকার সবেচেয়ে বেশি অদক্ষ শ্রমিকরা।
অভিবাসন ব্যয় যে আমাদের দেশে তুলনামূলক অনেক বেশি এ অভিযোগ করে আসছে অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এরকম অনেক আন্তজাতিক সংগঠন। মনে পড়ে বছর কয়েক আগে ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) তাদের এক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে বলেছিল দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় সবচেয়ে বেশি।
যে টাকা খরচ করে ভারত, নেপাল থেকে একজন শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যান্য দেশে গমন করতে পারছে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের একজন শ্রমিকের তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুন টাকা খরচ হচ্ছে। ঐ গবেষণায় আরো বলা হয়েছিল বাংলাদেশে যে অভিবাসন ব্যয় হয় তার অন্তত ৬০ ভাগ দালাল মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা কোনো না কোনোভাবে গিলে খায়।
সরকারের নিয়ম মোতাবেক মধ্যপ্রাচ্যে একটি শ্রমিকের সবমিলিয়ে নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে সমস্ত ধরনের ব্যয় ধরা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই ব্যয় কোথাও কোনোভাবে প্রযোজ্য নয়। একই সাথে এও সত্য বাস্তবতার বিবেচনায় সরকার নির্ধারিত এই ব্যয় কতোটা যৌক্তিক সেটাও বিবেচনার দাবি রাখে। আমরা বাস্তবে এও দেখছি- গাঁও গেরামের অনেক তরুণ তিন চার লক্ষ টাকা খরচ করে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। কিন্তু তারা অদক্ষ শ্রমিক হওয়ার কারণে সেখানে ভালো কোনো কাজ পাচ্ছেন না।
ফলে উপায়ন্তর না দেখে তারা কম পয়সায় কাজ নিচ্ছেন। এতে করে দেখা যাচ্ছে খেয়ে দেয়ে চার পাঁচ বছর কাজ করেও তারা তাদের মূল বিনিয়োগের টাকা উঠাতে পারছেন না। হালে এই অবস্থা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু আশি এবং নব্বই-এর দশকে চিত্রটা ছিল এরকম যে কেউ একবার কোনোরকম বিদেশ যেতে পারলেই শুধু তার নয় পুরো পরিবারেরই ভাগ্যের দ্রুত বদল ঘটছে। কিন্তু এখন একেবারেই উল্টোটা। সোনা-দানা, জমিজিরেত বন্ধক রেখে সোনার হরিণের পেছনে ছুটে অনেকেই নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে দেশে ফিরছেন। অনেকেই একুল ও কূল দু কূল হারিয়ে পথের ফকির হয়েছেন। বছরের পর বছর পরবাসে থেকে অনেকেই খরচের টাকাও তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়টি নিয়ে বারবার হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হচ্ছে। অভিবাসন নিয়ে যেসব উন্নয়ন সংগঠন কাজ করে তারাও এ বিষয়ে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরেও আসে বিষয়টি। সেই ২০১১ সালে ঢাকায় চতুর্থ কলম্বো প্রসেস চলাকালীন প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক উদ্বোধন কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সেই সময়কার প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীও অভিবাসন ব্যয় কার্যকর করতে তার স্পষ্ট অবস্থান জানিয়েছেছিলেন। মন্ত্রী নিজেও বলেছিলেন অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনা না গেলে শ্রমিকদের মাঝে ভালো বেতনের চাকরি খোঁজা এবং চুক্তিবদ্ধ জায়গা বদল করার যে প্রবণতা তা কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না।
এদিকে অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনা এবং বিদেশে কর্মী প্রেরণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তৈরির লক্ষে টাস্কফোর্স গঠন এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান অভিবাসন আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হলেও তাতেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না। আগস্টে কলম্বো প্রসেসের চতুর্থ অফিসিয়াল ও মন্ত্রী পর্যায়ের সভাতেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
এক কথা সত্য যে, দেশের জনশক্তি খাতে স্থবিরতা তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি বড় ফ্যাক্টর-অভিবাসন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া। এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি কোনোমতেই ঠেকানো বা দমন করা যাচ্ছে না। দিন যতই যাচ্ছে ততই অভিবাসন ব্যয় কেবলই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভিসা ট্রেডার এবং আনঅথরাইজড রিক্রুটিং এজেন্সীদের অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। এটি করা না গেলে এবং একটি কার্যকর পলিসি উন্নয়ন ও প্রয়োগ করা না গেলে অভিবাসন ব্যয় কেবলই বাড়তে থাকবে।
(এ
বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর
সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)