অভিবাসন বিশ্বের অন্যতম একটি বড় সমস্যা। এ সমস্যায় আক্রান্ত অনেক দেশ। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। অবৈধ পথে অভিবাসী হতে গিয়ে অনেক বাঙালি প্রাণ হারিয়েছেন। সম্প্রতি গৃহযুদ্ধ ও জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের হুমকি থেকে বাঁচতে ৪০ লাখের বেশি সিরীয় দেশটি ছেড়ে পালিয়ে অন্যখানে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
এসব অভিবাসীর একটি বড় অংশ বসবাস করছেন তুরস্ক, লেবানন, জর্ডান, মিসর ও ইরাকের জনাকীর্ণ উদ্বাস্তু শিবিরে। বাকিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপের দীর্ঘ পথে যাত্রা করেছেন।
সবকিছু ফেলে এসব উদ্বাস্তু মধ্যপ্রাচ্য থেকে হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে মধ্য ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার মতো দেশগুলোয় প্রবেশ করছেন। অন্যরা নৌকা, ট্রেন ও ট্রাকের ওপর ছিঁচকে চোরের মতো ব্রিটেনে ঢুকছেন।
চলতি বছর বহু শরণার্থী সমুদ্রপথে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টাকালে মারা গেছেন। তারপরও প্রায় প্রতি রাতেই ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে এসব শরণার্থী জীবন আশঙ্কার ঝুঁকি নিয়েই ইউরোপ পৌঁছানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এমনই এক প্রচেষ্টায় মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে ৩ বছর বয়সী আয়লান কুর্দির। সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ তুরস্কের বোদরম থেকে গ্রিসের কস দ্বীপ পৌঁছানোর চেষ্টাকালে নৌকা ডুবে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তার। সমুদ্র উপকূলে পড়ে থাকা লাশটির ছবি তোলেন সাংবাদিক নিলুফার দেমি।
কোমরের দুই পাশে দুটি হাত রেখে ছোট শরীরটাকে ভেজা বালিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখে প্রবলভাবে নাড়া দেয় বিশ্ববিবেককে। অভিবাসী ইস্যুতে উপসাগরীয় অঞ্চলের ধনী হিসেবে খ্যাত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত ও বাহরাইন এ সংকটে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
এ ৫টি ধনী আরব দেশ একরকম চোখ বুজেই আছে। তবে, একমাত্র ব্যতিক্রম তুরস্ক। দেশটি এরই মধ্যে প্রায় ২০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের পেছনে ৬০০ কোটি ডলার খরচও করেছে। শরণার্থীদের জন্য ৬০০ কোটি ইউরো খরচ করতে রাজি হয়েছে জার্মানির জোট সরকার।
ইউরোপে যাওয়া শরণার্থীদের সহযোগিতার জন্য ২০ লাখ আমেরিকান ডলারের তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)। সম্প্রতি অভিবাসী সংকট চরমে ওঠায় আইওসি এ সিদ্ধান্ত নেয়।
সৌদি আরবে শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে আটক করা হয়েছে ৫ হাজার ৪৮০ অভিবাসীকে। অবৈধভাবে যেসব শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন তাদের বিরুদ্ধে দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয় অভিযান চালাচ্ছে। সম্প্রতি ১৮৩৭৭টি বেসরকারি খাতে অভিযান চালিয়ে ওইসব শ্রমিককে আটক করা হয়েছে। ৮ ডিসেম্বর এ কথা বলেছে দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়।
সৌদি আরবে রয়েছেন বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক। তারা বিভিন্ন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বেসরকারি খাতে কাজ করেন। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে কোন বাংলাদেশী আছেন কিনা তা জানা যায় নি। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রায় দু’মাস আগে শুরু হয়েছে অবৈধ বিদেশী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে এই অভিযান। তারা সব নিয়মকানুন মেনেই এসব অভিযান পরিচালনা করছে।
বৈধ-অবৈধ উভয় পথে বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসনের সম্পূর্ণ হিসাব পাওয়া বেশ জটিল। তবে সামগ্রিক অর্থে অভিবাসী শ্রমিকদের প্রেরিত রেমিট্যান্স বা বৈদেশিক মুদ্রা ও জাতীয় অর্থনীতিতে তার অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যার ফলে বিশেষ এই দিনটিতে আন্তর্জাতিক অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত মোট অভিবাসী শ্রমিকের একটি বড় অংশ এখন নারী। প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কর্মস্থলে নারী ও পুরুষ কখনই সমধিকার পায় না।
এরচেয়ে দুঃখজনক সত্য হলো- গ্রহীতা দেশের কর্মস্থলে সমঅধিকার প্রসঙ্গে অতীতে অনেক বেশি আলোচনা হলেও অভিবাসী নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা তথা সুরক্ষার বিষয়টি সব সময় আড়ালে পড়েছে। ব্যক্তি হিসেবে নারী শ্রমিক বা পুরুষ শ্রমিকের বাস্তবতা কখনই এক নয়। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী নারী শ্রমিকের প্রতি নিগ্রহমূলক আচরণ দিন দিন বেড়ে চলেছে। সুরক্ষার প্রশ্নে অভিবাসী নারী শ্রমিকের অধিকার তাই বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
নানা বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রথম বিদেশে নারী কর্মী পাঠানো শুরু করেছিল। নব্বইয়ের দশকে শুরু হয়ে মাঝখানে দীর্ঘদিন নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশ থেকে নারী অভিবাসন হ্রাস পায়। ১৯৯১ সাল থেকে এ বছর মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় পৌনে ৪ লাখ বাংলাদেশী নারী শ্রমিক পৃথিবীর ১৮টি দেশে অভিবাসন করেছেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ব্যুরো এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’র তথ্যমতে, সাম্প্রতিককালে শ্রম অভিবাসনে নারীর অংশ নেয়া উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ যাবৎকালে প্রেরিত মোট নারী শ্রমিকের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই শুধুমাত্র গত ৫ বছরে। সামগ্রিকভাবেও নারী শ্রমিকের হার বেড়েছে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত মোট শ্রমিকের প্রায় ১৮ ভাগ ছিল নারী, চলতি বছরের প্রথম ২ মাসেই এ হার দাঁড়িয়েছে ২২ ভাগ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১০ সালে সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের অবস্থা নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৫০ গৃহকর্মীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরিকৃত ওই প্রতিবেদনে দেশটিতে গৃহকর্মী নির্যাতনের এক ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। বেতন, ছুটি ও অন্যান্য সাধারণ অনিয়মের পাশাপাশি গৃহকর্মীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ পায়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব গৃহকর্মী যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যেহেতু গৃহকর্মীদের কর্মস্থল মালিকের বাড়ি, তাই নিয়োগকর্তা কর্তৃক জোরপূর্বক আটকে রাখা বা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে না দেয়া একটি গুরুতর অভিযোগ।
সাধারণত বাড়ির মালিক বা মালিক পরিবারের সদস্য অভিবাসী গৃহকর্মী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত। এমতাবস্থায় চলতি বছর সৌদি আরবে নতুন করে নারী গৃহকর্মী প্রেরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ দেশটির সঙ্গে এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। নিঃসন্দেহে সৌদি আরব বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য একটি বিরাট বাজার। তবে দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর নানা নির্যাতনের অভিযোগে অনেক দেশ তাদের শ্রমিক পাঠানো স্থগিত রেখেছে।
এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন নেপাল, শ্রীলঙ্কা এমনকি ফিলিপাইন তাদের কর্মীদের সুরক্ষার প্রশ্নে জোর দিয়ে নতুন করে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ রেখেছে। স্বাভাবিকভাবেই কম খরচে অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণে সৌদি আরবের জন্য তাই বাংলাদেশ এখন একমাত্র বাজার। দীর্ঘদিন শ্রমিক গ্রহণের পর ২০০৮ সালে হঠাৎ করেই নানা অজুহাতে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক গ্রহণ বন্ধ করে দেয় সৌদি আরব।
৬ বছর ধরে বিভিন্ন কূটনৈতিক তৎপরতার পর এ বছর দেশটি বাংলাদেশী শ্রমিক গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করায় একদিকে যেমন আশার সঞ্চার হয়েছে, অন্যদিকে আশঙ্কা রয়েছে অনেক বেশি। এখনও অনেকে অথৈ সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় মানবেতর দিন কাটাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন জাতিসংঘের অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের (ইউএনওডিসি)।
বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার চলমান বিনিময় হার এবং এ-সংক্রান্ত সরকারি পদক্ষেপ এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমান সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহ দিয়ে আসছে।
এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) অনেক দিন ধরে ব্যাপক প্রচারণা করে আসছে।
এরই মধ্যে অনেক সুফল চোখে পড়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বৈধ-অবৈধ বিতর্কের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অভিবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্সের বিনিময় হার। বিষয়টি নিয়ে খুব দ্রুত সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)