জুন মাসের ২ তারিখ জাতীয় সংসদে আগামী অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশে তার আগের রেকর্ড ভাঙবেন । শুনতে পাচ্ছি এবারের বাজেটের আকার হবে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা। আগের বাজেটের তুলনায় এ বাজেট হবে সম্প্রসারণমূলক সেটা জানি । তবে এতবড় বাজেট কি উচ্চাভিলাষী হবে ? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বাজেট মানেই তো দেশ- সমাজের সমানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার প্রকাশ। এগিয়ে যেতে টাকার দরকার, দরকার পরিকল্পনার। সেই টাকা কোথা থেকে আসবে- কী কী খাতে খরচ হবে তার পথনির্দেশনা- ই তো বাজেট।
বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় রাজস্ব খাতে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা পরিশোধ করে। গত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ২ হাজার ৭ শত ৮১ কোটি টাকা। যা ছিল মোট বাজেটের ৩৪.৮৩ শতাংশ।
নতুন বেতন স্কেলে বর্ধিত হারে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধের জন্য আগামী অর্থবছরে বর্ধিত হারে ভাতাদি পরিশোধ করা হবে। তাতে আসন্ন বাজেটের একটি বড় অংশ চলে যাবে বেতন- ভাতার জন্য । এটা দরকার আছে একই সাথে অন্যান্য উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে সাথে নতুন কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টির জন্য বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিনিয়োগ করা উচিত । শুধু রাস্তা- সেতু- হাসপাতাল- বেতন- ভাতার নয়। মানুষের হাতে কাজ দিতে হবে এবং সেটা স্থায়ী ভিত্তিতে।
অনেকের সাথে আমিও মনে করি কোন খাতে কতজন পুরুষ ও মহিলা নতুন করে চাকরি পাবে তার পরিসংখ্যান স্বচ্ছতার সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার সময় উপস্থাপন করা উচিত । তাতে বেকার জনগোষ্ঠী ও তাদের পরিবার আশ্বস্ত হবে। এতে সামাজিক অস্থিরতা দূর হবে আর কতো মানুষকে কাজ দেয়া গেল আমরা বছর শেষে তার একটা হিসেব পাবো।
সেটা গেল একটা দিক, এবার অন্যদিকে আসি। বাজেট যেহেতু দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার পথরেখা সে জন্য পরিকল্পনাটি হতে হবে সুষম উন্নয়নের দিকে খেয়াল রেখে, যে সব অঞ্চল পিছিয়ে আছে সে অঞ্চলগুলো কি ভাবে এগিয়ে আনা যায় সেটা পরিকল্পনায় থাকতে হবে। আমাদের সংবিধান কিন্তু এই বাধ্যবাধকতা বলে দিয়েছে। কিন্তু সেটা এতদিনে হয় নি। দেশের কোন কোন অঞ্চলকে এগিয়ে আনা হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আবার কোন কোন অঞ্চল কে পিছিয়ে রাখা হয়েছে পরিকল্পিত ভাবে।
১৯৭৪ সালের ৩০ মে ডক্টর কুদরত- ই খুদা শিক্ষা কমিশনের যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয় সেখানে দেশের সব বিভাগীয় শহরে একটা করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকায় প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সে সময়ে দেশের জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ যে বিভাগে বাস করতো সেই খুলনায় একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছিল। হ্যাঁ খুলনায় একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তবে সেটা গড়ে তোলা হয়েছে সেই সুপারিশ প্রণয়নের ১৬ বছর পরে ১৯৯০ সালে।
তবে তার জন্য অনেক আন্দোলন- সংগ্রামের প্রয়োজন হয়েছে । দক্ষিণাঞ্চলের পিছিয়ে থাকা মানব সৃষ্ট- এর পেছনে এই অঞ্চলের মানুষের কোন দায় নেই- দায় ছিল রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির- পরিকল্পনার। ২০১০ সালে গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস ঢাকা- চিটাগাং- রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের মানুষের আগের ছয় মাসে তাদের জীবনমানের কতোটুকু উন্নতি হয়েছে এই মর্মে একটা জরিপ চালায়। সেই জরিপে দেখা যায়- ঢাকার আশ পাশের জেলাগুলোর আশিভাগ মানুষ বলেছে গত ছয় মাসে তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়েছে- পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের সত্তর শতাংশ মানুষ বলেছে হ্যাঁ তাদের অবস্থা আগের থেকে ভালো আর খুলনার মাত্র ২০ ভাগ বলেছে – তারা “ভালো আছে”
অঞ্চল ভেদে এই ভালো ও খারাপ থাকার কারণ কী ? এই প্রশ্নটির উত্তর সোজা। রাষ্ট্র তার সব নাগরিককে সমান চোখে দেখে নি। যেখানে সংবিধানে বলা হয়েছে- রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন করতে পারবে না, অঞ্চল- নারী- পুরুষ- লিঙ্গ বিভাজন করা যাবে না সেখানে রাষ্ট্র নিজেই সংবিধান উপেক্ষা করেছে। কোন কোন অঞ্চলকে বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে এগিয়ে দিয়েছে আবার কোন অঞ্চলের মানুষকে পিছিয়ে রেখেছে অথবা এমন কিছু বাধা তৈরি করেছে এতে সেই অঞ্চলের মানুষ এগুতে পারেনি।
আবার সব অঞ্চলের প্রতি সমান মনোযোগ না দেয়ার কারণে কোন কোন অঞ্চলের মানুষ পিছিয়েছে শিক্ষা- স্বাস্থ্য-অর্থনীতি বা জীবনমানের দিক দিয়ে । একটা উদাহরণ আবার সামনে আনা যায়- ২০০৩-২০০৪ অর্থ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সিলেটের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ দশমিক ২০ শতাংশ আর খুলনার জন্য বরাদ্দ ছিল ২ দশমিক ৩২ শতাংশ সেটা ২০০৭ সালে গিয়ে দাঁড়ায় সিলেটের জন্য ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশে আর খুলনার জন্য ২ দশমিক ৯১ শতাংশে।
অর্থাৎ চার বছরে সিলেটের জন্য যেখানে বরাদ্দ বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৭ ভাগ সেখানে খুলনার জন্য বেড়েছে দশমিক ৫৯ শতাংশ।( কেয়ারটেকার সরকারের সময় “অনগ্রসর অঞ্চলের দারিদ্য বিমোচন কৌশল শীর্ষক টাস্ক ফোর্স রিপোর্ট, ২০০৯ ) এই এগিয়ে যাওয়া- পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ রাজনৈতিক । রাজধানী হওয়ার কারণে ঢাকা – সব থেকে বড় বন্দর হওয়ার কারণে চিটাগাং এগিয়েছে আর অর্থমন্ত্রীর পদটি বার বার সিলেটের রাজনীতিকদের কাছে চলে যাওয়ায় তারা নিজেদের এলাকার উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হয়েছেন।
অথচ এটা কে না জানে- আপনি যখন রাষ্ট্রের কোন দায়িত্ব পালন করবেন তখন আপনার নিজের অঞ্চল বলে কিছু থাকার সুযোগ নেই। শপথ অনুযায়ী আপনি কারো প্রতি “অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হইয়া” কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। অথচ সেটা হয়েছে। আজ দক্ষিণের পিছিয়ে পড়া নিয়ে যে আলোচনা, সেটা আঞ্চলিকতা নয় বরং এই অঞ্চলকে যে পিছিয়ে রাখা হয়েছে সেটাই ছিল স্থূল আঞ্চলিকতা- বিভাজনের দোষে দুষ্ট । একই রাষ্ট্রের ভেতরে বিভাজনের দেয়াল তৈরি করে আর তার ফল সব সময় সুখকর হয় না। এই বিভাজনের বিষয়টি ডক্টর ফখরুদ্দিনের কেয়ারটেকার সরকার সরকারী ডকুমেন্টসে স্বীকার করেছিলেন।
২০০৮-৯ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় ষে সময়ের অর্থ উপদেষ্টা মীর্জা আজিজুল ইসলাম বলেছিলেন, “ বিগত বছরগুলোতে অর্জিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সারাদেশে সুষম ছিল না। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে সম্পদ ও আয় বৈষম্য।“ সেই কেয়ারটেকার সরকার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে টাস্কফোর্স গঠন করে সেই কমিটির প্রতিবেদনে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে উঠে আসে। কিন্তু কেন এই বৈষম্য ?
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে দেশ- রাজনীতি- সমাজ- অর্থনীতিকে ভাগ করে ফেলা হয়েছিল। রাজনৈতিক শক্তি ও সমর্থন আদায়ের জন্য দেশের মধ্যে কোন অঞ্চলকে এগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে তাদের সমর্থন আদায় ছিল সেই পরিকল্পিত বৈষম্যের লক্ষ্য । এতে কোন কোন অঞ্চল যেমন এগিয়েছে আবার কোন কোন অঞ্চল পিছিয়েছে। সব দিক থেকে পিছিয়ে থাকা দুটো বিভাগ হল খুলনা ও বরিশাল। যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকার পরেও এই অঞ্চল দুটোর পিছিয়ে থাকার কারণ উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক মনোযোগ না পাওয়া ।
অথচ জলবায়ু পরিবর্তন সহ প্রাকৃতিক কারণে সব থেকে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এই দুটো বিভাগের মানুষ। আমরা আশাবাদি খুব দ্রুত সময়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হবে। এই সেতু নির্মিত হলে এই দেশের মুল অংশের সাথে সরাসরি সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ঐ দুটো বিভাগে কর্মসংস্থানের সুযোগ তেমন একটা নেই। এক সময়ে খুলনা শহর কেন্দ্রিক যে শিল্প ছিল তার প্রায় সবটাই বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে একদিকে প্রাকৃতিক কারণে শেকড় ছেড়া মানুষ আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে কর্মহারা মানুষ বেকারের মিছিল দীর্ঘ করেছে।
এই সেতু নির্মিত হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার সাথে সাথে ঐ অঞ্চলে পুরো মাত্রায় গ্যাস সরবরাহ শুরু হলে শিল্পায়নের বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হবে। এক সময় মংলা বন্দর কেন্দ্রিক যে প্রাণ চাঞ্চল্য ছিল সেটাকে পুরোদমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এটা একটা প্রাকৃতিক বন্দর, এই বন্দরটির ৬৫ লাখ ম্যাট্রিক টন পণ্য ও ৫০ হাজার টিইউএস কন্টেইনার ব্যবহার এর ক্ষমতা রয়েছে কিন্তু বিএনপি সরকার বন্দরটি ব্যবহার বন্ধ রেখেছিল।
২০০৮-৯ সালে বন্দরটির মাত্র ৯ ভাগ সম্ভাবনা কাজে লাগানো হয়েছে। বন্দরটি ঐ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানের একটা বড় ক্ষেত্র ছিল। ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা বোর্ডের হিসেব অনুযায়ী বন্দরটি সংকুচিত করার আগ পর্যন্ত বারো হাজারের বেশি শ্রমিক- কর্মচারীর কাজের সুযোগ ছিল। এর বাইরে বন্দর কেন্দ্রিক নানা কাজের সাথে আরও প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ যুক্ত ছিলেন। মনে রাখা দরকার সব মিলিয়ে এই যে পঞ্চাশ হাজার মানুষের আয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল আরও প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ।
এই সেতু বন্দরটিকে আবার উন্নয়নের লাইফ লাইনে যুক্ত করবে। জাতীয় অর্থনীতিতে এবং এই অঞ্চলের কর্মসংস্থানের উপর সেতুটির ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটনের শিল্প বিকাশের বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে এই সেতু। পৃথিবীর এক মাত্র সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা যেখান থেকে সূর্যোদয়- সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায় ফলে এই সৈকতটি দেশি বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারবে। আর সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা আসা যাওয়া করতে কক্সবাজারের চেয়ে কম সময় লাগবে ।
দূরত্ব কমে যাওয়ায় দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসার সুযোগ থাকবে বলে পর্যটকরা এই সৈকতটি বেছে নেবেন। যমুনা সেতু দিয়ে উত্তারঞ্চলের কৃষক বা ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য যত দ্রুত সময়ে রাজধানীর বাজারে নিয়ে আসতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য নির্ভর জেলে – ব্যবসায়ীরা সেটা পারেনা, ফলে হয় তাদের পণ্য কখনো মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে যায় বা তারা তুলে দিতে বাধ্য হন। আবার যশোর ও তার আশ পাশের জেলায় সব্জি ও ফুল চাষের যে নতুন ক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে তাদের জন্য বাজার সুবিধা টেকসই হবে।
আমরা অনেকেই হয়তো জানি না, যশোর বা তার আশ পাশ থেকে প্রতিদিন অন্তত এক কোটি টাকার ফুল রাজধানীতে আসে । ভোর রাতের মধ্যে এই ফুল ঢাকায় পৌছাতে না পারলে তারা এগুলো বিক্রি করতে পারে না- একদিনের সব্জি পরের দিন বিক্রির সুযোগ থাকলেও ফুলের ক্ষেত্রে সেটা নেই। আবার সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় এগুলো শুকিয়ে যায়। ফেরি নির্ভর বর্তমান যোগাযোগ এই ক্ষেত্রে ফুল ব্যবসায়ীদের জন্য বড় সমস্যা।
পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুততার সাথে এগিয়ে চলছে তবে শুধু দক্ষিণের মানুষের ভাগ্য বদলাবে না। শিক্ষা- স্বাস্থ্য- পয়ঃ নিষ্কাশন সমস্যা – জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষির উৎপাদন কমে যাওয়া, জমির লবণাক্ততা দূর করা, বাস্তচ্যুতি এগুলো এই অঞ্চলের বাড়ন্ত ইস্যু। নতুন এই সব সমস্যা দূর করতে বাজেটে কি দিক নির্দেশনা থাকবে ? নাকি একটা অঞ্চলের প্রতি অবহেলার চিত্র এবার ও অর্থমন্ত্রীর নজরের বাইরে থাকবে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)