দেশে মাদকের বিরুদ্ধে প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর প্রতিরাতে একের পর এক লাশ পড়ছে। গত ১৫ মে থেকে শুরু হওয়া এ অভিযানে লাশের সংখ্যা অনন্ত ৮০। পুলিশ-র্যাব-সরকার-প্রশাসন বলছে নিহতরা ‘মাদক ব্যবসায়ী’। তবে কোন কোন পরিবারের অভিযোগ পুলিশ আগে থেকেই তুলে নিয়ে গেছে তাদের, যাদেরকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়।
গত ৪ মে থেকে র্যাব দেশজুড়ে মাদকবিরোধী এ অভিযান শুরু করে। পুলিশ ও র্যাবের সূত্র বলছে, অভিযান জোরদারের পর গত ১৫ মে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়। একদিন বাদে ১৭ মে নিহত হয় আরও তিন মাদক ব্যবসায়ী। তারিখওয়ারি নিহতদের সংখ্যার দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৫ মে ২ জন; ১৭ মে ৩ জন; ১৮ মে ১ জন; ১৯ মে ৩ জন; ২০ মে ৪ জন; ২১ মে ৯ জন; ২২ মে ১২ জন; ২৩ মে ৮ জন, ২৪ মে ১০ জন; ২৫ মে ১১ জন।
এই অভিযানের যে বিষয়টি লক্ষণীয় সেটা হলো প্রতিটি লাশ উদ্ধার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ-র্যাব যা দাবি করছে তার মধ্যে রয়েছে ‘গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধ’। গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনা বর্ণনার সময়ে তারা জানাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ থেকে নিহত আর সাথে অস্ত্র-মাদক উদ্ধার। তবে এসব বক্তব্যের মধ্যে যে সত্যতার ঘাটতি রয়েছে সেটা নিহতদের পরিবারের দাবিগুলোর মধ্যে স্পষ্ট। সকল ঘটনার উল্লেখ না করে কেবল কয়েকটি উদাহরণ টানলে এর স্পষ্ট চিত্র পাওয়া সম্ভব।
পুলিশ গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের যে গল্পকাহিনী সাজাচ্ছে তাদের অধিকাংশকেই আগে থেকেই ধরে নিয়ে এসেছে। এদের কারো কাছ থেকে আবার চাঁদাও দাবি করেছে বলে অভিযোগ।
লাশ উদ্ধারের ঘটনা জোরদার হওয়ার সময়ে ফেনীর ফুলগাজীতে বৃহস্পতিবার ভোরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মনির হোসেন ও শাহ মিরান শামীম নামের দুই মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন। পুলিশ তাদেরকে মাদক ব্যবসায়ী বললেও স্থানীয়রা বলছেন অন্য কথা। স্থানীয়দের ভাষ্য- শামীম ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল। শামীমের মা আনোয়ারা বেগম দাবি করেছেন, বুধবার দুপুরে পুলিশ এসে শামীমকে নিয়ে যায়। পরে পুলিশ দুই লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় রাতে ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে। প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করেছেন মনিরের বোন রেজিনা বেগম। তিনি বলেন, গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে বুধবার রাতে ফেনী শহরের বড় মসজিদ এলাকা থেকে তার ভাইকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এর বাইরে একাধিক নিহত পরিবারের দাবি তাদের স্বজনদের আগে থেকেই ধরে নেওয়া হয়, এবং পরে গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের কথা বলা হয়। লাশ উদ্ধারের সঙ্গে এরপর পুলিশ যে বক্তব্য দেয় সেখানে বলা হয় মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কথা। কিন্তু পুলিশ-র্যাবের হেফাজতে থেকে নিশ্চয়ই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে যাওয়ার কথা নয়; ফলে প্রশাসনের এমন বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়।
গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের দাবির বাইরে পুলিশ-র্যাবের অন্য দাবি মাদক ব্যবসায়ীদের সহযোগিদের সঙ্গে তাদের ‘বন্দুকযুদ্ধ’। প্রতি ঘটনার কাহিনী বর্ণনা ও পরিণতি একই। প্রতি ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরই মৃত্যু হয়। এটাকে পুলিশ-র্যাব সহ প্রশাসন নাম দিয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’।
এ প্রসঙ্গে গত ২২ মে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দাবি বলেছেন, ‘দেশে কোনও ক্রসফায়ার হচ্ছে না। যা হচ্ছে বন্দুকযুদ্ধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের জীবন বাঁচাতে বন্দুকযুদ্ধে বাধ্য হচ্ছে।’ মন্ত্রীর দাবি, ‘মাদকের কোনও চুনোপুঁটিদের ধরা হচ্ছে না। চুনোপুঁটিদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে না। যাদেরকে ধরা হচ্ছে তারা মাদকের শীর্ষ ব্যবসায়ী। শতভাগ নিশ্চিত হয়ে এবং তথ্য-প্রমাণ হাতে নিয়ে নক করা হচ্ছে। যাদের নক করা হচ্ছে তারা কখনও কখনও পালিয়ে যাওয়া সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলি ছোড়ে। তখন জীবন বাঁচাতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পাল্টা গুলি ছোড়ে। যাতে এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।’
একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ২০০১ সালে বিএনপির আমলে চালানো অভিযান ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’-এর সময়ে কর্তৃপক্ষ বলত ‘হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ’ হয়ে যাওয়ার কথা; র্যাবের সঙ্গে অভিযানের সময়ে বলা হত ‘ক্রসফায়ারে’ মৃত্যুর কথা। তখন প্রতি ঘটনায় একই বক্তব্য আসত সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে। বলা হত, ধৃত সন্ত্রাসীকে নিয়ে র্যাব অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে বের হত রাতে। খবর পেয়ে ওই সন্ত্রাসীর সহযোগিরা আসামিকে ছিনিয়ে নিতে গুলি চালাত, তখন র্যাবের হেফাজতে থাকা ধৃত ওই আসামি মৃত্যুবরণ করত। আর এখন পুলিশ-র্যাব-মন্ত্রী-সরকার যা জানাচ্ছে তা পূর্বেকার বক্তব্যগুলোরই ধারাবাহিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। একই ফর্মেট, একই সুরের এমন বক্তব্য আমরা শোনে আসছি দীর্ঘদিন ধরে। বক্তা বদল হলেও বক্তব্য বদল হয় নি।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে অগণন প্রাণের অপচয়ের পরেও এনিয়ে আমরা স্বতন্ত্র কোন তদন্তের ব্যবস্থা দেখতে পাচ্ছি না, সে সম্ভাবনাও নাই। সরকার-প্রশাসন-আদালত কেউই এনিয়ে ভাবিত নয়। যে প্রাণ গেল সে সত্যিকার অপরাধী কী না এনিয়ে প্রমাণের প্রয়োজনই মনে করছে না কেউ; অথচ এই প্রবণতা মারাত্মক এবং হৃদয়বিদারক।
পুলিশ-র্যাব কাউকে ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করে গুলি করে মেরে ফেলল, এরপর তারা নিজেদের মত করে একটা বক্তব্য দিয়ে দিল- এভাবেই একটা প্রাণের চিরসমাপ্তি ঘটে যাওয়া মানবিকতার বিপর্যয়। এটা মহাবিপর্যয়ে রূপ নেয় যখন দেশের সিংহভাগ লোক এই অন্যায় প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে অথবা চুপ করে বসে থাকে।
প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে গুলি করে মেরে ফেলে অন্য কারণ দাবি করা আর যাই হোক প্রশাসনিক সততার বিষয় নয়। পুলিশ-র্যাবকে বকে কেন এই প্রশাসনিক অসততার পথকে বেছে নিতে হচ্ছে? যে ঘটনায় সত্য প্রকাশ করা যায় না সেটা নিশ্চিতভাবে সৎকার্য নয়, তাহলে কেন তাদেরকে এমন অবস্থায় নিপতিত করা হচ্ছে?
কথাগুলো বলা ঝুঁকিপূর্ণ, তবু বলছি; কারণ সুস্থ সমাজের একজন বাসিন্দা হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার আমাদের সবার। যেকোনো অন্যায় প্রক্রিয়ার প্রতিবাদ করা ও প্রতিবিধানের দাবি জানানোটা আমাদের কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে। তা না করলে আমরা নিজের বিবেকের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকব, আজীবন।
আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, দেশে যখন নানা নামীয় বিভিন্ন অভিযান চলে তখন পুলিশের একটা বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত হয়। গ্রেপ্তার বাণিজ্য, ক্রসফায়ার বাণিজ্যের পর এবার হাজির হয়েছে বন্দুকযুদ্ধ বাণিজ্য। ফেনীর ছাত্রদল নেতা শাহ মিরান শামীমের নিহত হওয়ার সাথেও দুই লাখ টাকার চাঁদা দাবির অভিযোগ ওঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। এমন ঘটনা হয়ত আরও অনেক ঘটছে। শামীম মরে যাওয়ার পর তার পরিবার জানিয়েছে সে তথ্য। মোটা অঙ্কের টাকা না দিলে বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেলার হুমকি যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে না সেটা নিশ্চিতভাবেই কেউ বলতে পারবে না।
মাদক ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের যেকোনো ধরনের অভিযানের সমর্থন করে দেশের অধিকাংশ লোক; এনিয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে অভিযানের প্রক্রিয়া নিয়ে। রাস্তার পাশে কিংবা জনমানবহীন কোন স্থানে গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার মত কাহিনী শোনানো হচ্ছে, কিন্তু আদতে এগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। সরকার-প্রশাসনও জানে এমন গল্প কেউ বিশ্বাস করছে না, তবু বলছে। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে এনিয়ে মানুষের মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। মানুষ যতক্ষণ না নিজে আক্রান্ত হয় ততক্ষণ কোন বিষয়েই ভাবে না- এক্ষেত্রেও তাই ঘটছে।
তবে এমন অন্যায়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এর সুস্থ্য একটা সমাধানের দাবি জানানো উচিত। মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বিচারবহির্ভূত স্বনির্ধারণী বিচার বাদ দিয়ে আইন-আদালতকে এক্ষেত্রে শক্তিশালি করা দরকার। মাদক ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনে দ্রুতবিচার আইনের মুখোমুখি করে দ্রুততম সময়ে বিচার করা যেতে পারে।
বন্দুক নাকি আইন-আদালত কে শক্তিশালী- এমন প্রশ্ন বর্বর সমাজবাসীকে করলে সে বা তারা নিশ্চিতভাবেই বন্দুককে শক্তিশালী দাবি করবে; কিন্তু সভ্য সমাজের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে ঘটবে উলটো ঘটনা। সভ্য সমাজ ও সমাজবাসীগণ সর্বক্ষেত্রেই বন্দুকের শক্তিকে অস্বীকার করত আইন-আদালতকে শক্ত অবস্থানে দেখতে চাইবে। আমরা সুস্থ সমাজ, সুস্থ শাসন প্রক্রিয়ার অধীনে থাকতে উদগ্রীব; এক্ষেত্রে তাই বন্দুক নয় আইন-আদালতকেই শক্তিশালী দেখতে চাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)