একটি গণতান্ত্রিক দেশে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করার অধিকার সবারই আছে। যদি বিক্ষুব্ধ কোন গোষ্ঠী নিজেকে বঞ্চিত মনে করে তবে তারা অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দোষারোপ এবং অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানো রাজনীতি নিয়ে কিছু না লিখে পারছি না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবেই লিখছি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারি, গত মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে অবস্থান করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি টিএসসি, কলাভবন, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ঘুরে প্রশাসনিক ভবনে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে আসার চেষ্টা করে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান এসময় নিজ অফিসেই ছিলেন। প্রশাসনিক ভবনের গেট তালাবদ্ধ থাকায় তা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরে ভবনের ভেতরে থাকা পরপর আরও দুটি গেট বন্ধ দেখলে সেই দুটি তালাও ভেঙ্গে উপাচার্যের কক্ষের সামনে গিয়ে তারা উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। আন্দোলনকারীরা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা উপাচার্য ও প্রক্টরকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
এখন প্রশ্ন হলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আন্দোলন করার সময় এমন যুদ্ধাংদেহী মনোভাবে কেন তারা আবির্ভূত হলেন? হাতুড়ি-শাবল দিয়ে তারা লোহার গেইট ভেঙ্গে প্রবেশ করার প্রয়োজন কেন মনে করলো? সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আন্দোলন হলেও সেখানে বাম সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী নয় এমন অনেককে সেদিন সেই আন্দোলনে দেখা গেছে। এমনকি আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম তখনও যাদের দেখিছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছি ৪ বছরের বেশি সময় আগে এখনও তারাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারেই আন্দোলন করছেন।
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, সামাজিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে প্রথমে আন্দোলনকারীদের অসহিষ্ণু আচরণ চোখে পড়েছে। দীর্ঘক্ষণ উপাচার্যকে আটকে রাখলে এক পর্যায়ে যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন ছাত্রলীগ উপাচার্যের অফিসের কাছে যেয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করে। যেহেতু প্রথম থেকেই পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ করে রেখেছিল আন্দোলনকারীরা, তাই তারা প্রথমেই ছাত্রলীগকে ডিফেন্ড করতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। সংখ্যা এবং শক্তিতে ছাত্রলীগ বেশি হলেও সংঘর্ষ বাধলে দুই পক্ষের মধ্যেই হাতাহাতি হয়। কিন্তু আমাদের দেশের সব পত্রিকা, টিভি, অনলাইন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবরটা এমনভাবে এসেছে যে, ছাত্রলীগ ওখানে গিয়ে নির্বিচারে সবাইকে মেরেছে এবং তারা সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে।
তার আগে আন্দোলনকারীরা ওখানে যে তাণ্ডব চালিয়েছে তার বয়ান সৎভাবে আসেনি কোন মিডিয়াতেই। সম্ভবত মিডিয়ার এমন আচরণকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ডিস অনেস্ট মিডিয়া’ বলে সম্বোধন করে থাকেন।
ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের হাজারটা দোষ থাকবে এটা অস্বীকার করার উপায় নাই। তবে সব দোষ নন্দ ঘোষ টাইপের হলে সেখানেই সমস্যা সৃষ্টি করে। সবাই যেভাবে ছাত্রলীগকে ধুয়ে দিচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে- ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের মারার জন্যই সেখানে গিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। পরিস্থিতি বাধ্য করেছে দুই পক্ষকে সংঘর্ষে জড়াতে। সংঘর্ষ তো করেছে দুই পক্ষই। তবে কেন শুধু শুধু এক পক্ষের বিরুদ্ধে দোষ পড়লো সেটা আমার বোধগম্য নয়।
কিছু কিছু সময় থাকে শুধু মারতে পারলেই হিরো হওয়া যায় না। সেখানে যদি মার খাওয়া যায় বা মার খাওয়ার অভিনয় করা যায় তবে মিডিয়া কাভারেজ ভালো হয়। সেই কাজটাই হয়েছে গত মঙ্গলবারের আন্দোলনে। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী উভয় পক্ষের মারামারিতে আহত হলে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করেন ছাত্রলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইমতিয়াজ বাপ্পী, সাংগাঠনিক সম্পাদক তানভীর। লিটনকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা পর্যন্ত বাপ্পী নিজে দাঁড়িয়ে তদারকি করেন। এমন একটি ছবি দিয়ে তিনি তার ফেসবুকে পোষ্টও করেছেন।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাপ্পী সামান্য আহত লিটনকে হাত ধরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন। সেই ছবিতে কোন বড় আঘাত বা রক্তের কোন দাগ না থাকলেও হাসপাতালে গিয়েই লিটন একটি ব্যান্ডেজ লাগিয়েছে এমন ছবিও গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে। কোন আঘাত বা ছিড়ে-ফেটে না গেলে মাথায় কেন ব্যান্ডেজ বাধা হলো তা বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই জানেন। লিটনের এই ছবির সত্যতা প্রমাণে স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছে দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকা।
ওই পত্রিকার খবর থেকে জানতে পারি, পত্রিকাটির বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি লিটন নন্দীর মাথায় তিনটি সেলাই দেয়া হয়েছে মর্মে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেন। আবার লিটন নন্দী তার একদিন পরেই হাসপাতাল থেকে মাথায় কোন প্রকার ব্যান্ডেজ ছাড়াই মধুর ক্যান্টিনে আসেন। মাত্র একদিনের ব্যবধানেই তিন তিনটি সেলাই করা মাথা কী করে ভালো হয়ে গেল তা দেশের কোন মিডিয়া জানতে চাইল না?
আর ছাত্রলীগ যেই দোষে দোষী সাব্যস্ত হলো তা থেকে উত্তোরণের জন্য তারা নিজেরাও কোন চেষ্টা করল না। তাদের সংগঠনেরই একজন প্রতিপক্ষের আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে চিকিৎসা করাতে পাঠালো, এই উদারতার বিষয়টিও হয়তো গ্রুপিং রাজনীতির কারণে সবাই প্রচার করেনি। ছাত্রলীগের বর্তমান যে রাজনীতি, ভাইয়ের সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে ভাই বন্দনা তা থেকে বের না হলে এমন অপপ্রচারের জবাব তারা দিতে পারবে না।
ন্যায়সঙ্গত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে সব পক্ষেরই সবসময় সমর্থন থাকে। কিন্তু সশস্ত্র বা সহিংস আন্দোলন আমাদের মনে করিয়ে দেয় বিগত কয়েক বছরে দেশের একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর আন্দোলনকে। তবে কি এই আন্দোলনের মধ্যে সেই দল বা গোষ্ঠীর কর্মীরা ঢুকে পড়েছিল? এমন প্রশ্নের উত্তর জানাটাও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি লাশ ফেলতা না পারার আক্ষেপ অনেকেরই রয়েছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)