বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার আকাশসম বিশালতায়, সীমাহীন ঔদার্য্যে, অপরীসীম ভালোবাসায় মহিমান্বিত হয়েছে এই ভুখন্ড, গোটা বিশ্ব। অথচ কি দুভার্গ্য এই জাতির। আগস্টের কলঙ্কিত সেই দিনের অমোচনীয় কালিমা প্রতিমুহুর্তে চিৎকার করে জানাচ্ছে কতটা নিকৃষ্ট আমরা, কতটা অমানবিক, কতটা বোধহীন।
শোকের সেই আঁধারময় মাস শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু এই শোক, এই বেদনা, এই দীর্ঘশ্বাস যে অন্তহীন, চিরন্তন। ‘চোখে বাংলার জন্য সকল ব্যাকুলতা, এমনকী আকাশকেও আমি কখনো এমন গভীর ও জলভারানত দেখিনি’ সেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে কতটা না পাশবিকতায় হত্যা করেছে এই বাঙালিদেরই কয়েকজন। হ্যাঁ, তারা বাঙালিই ছিলো –“
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলা মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।
(হন্তারকদের প্রতি, শহীদ কাদরী)
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, লজ্জার এই বাক্যটিই প্রচারিত হয়েছে বিশ্বে, প্রতিনিয়ত কটাক্ষ করছে আমাদের সত্ত্বাকে, অস্তিত্বকে।
এই হত্যার পরও কি বাঙালি প্রতিবাদে উন্মত্ত হয়েছে? দূর্বার আক্রোশে ভেঙে দিতে চেয়েছে সেই পশুদের রক্তমাখা হাত? না অক্ষম, সঙ্কির্ণতায় আচ্ছন্ন এই জাতির গুটিকয়েক ‘মানুষ’ ছাড়া কেউতো অধীর হয়নি। বরং দীর্ঘ ২১ বছরের মতো ঘাতকেরা সচেষ্ট ছিলো তাকে ভুলিয়ে দেবার। কিন্তু সূর্যের প্রখরতার মতোই জাতির হৃদয়-মননে যিনি দিপ্তীমান, তাকে বর্বর ঔদ্ধত্যে, সীমাহিন মূর্খতায় হয়তো অস্বীকার করা যায়, প্রকাশ্যে শ্রদ্ধায়, কৃতজ্ঞতা জানাতে ভীরু দূর্বল চিত্ত দ্বিধায় পড়তে পারে, কিন্তু একেবারে মুছে দেবে-তাতো কল্পনারও অতীত।
সেই কৈশোর থেকেই বাঙালি জাতির শোষণ বঞ্চণার বিরুদ্ধে অটল অবস্থানে থাকা বঙ্গবন্ধুর বিশালতার পরিচয় শুরু থেকেই পেয়েছে এই বাঙলার নদী, জল, সাধারণ মানুষ। ১৯৫৪ এর নির্বাচনে গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া এই দুই থানা নিয়ে ছিলো বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী এলাকা। মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী বিত্তশালী ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী খরচ অল্প অল্প অর্থ দিয়ে যুগিয়েছেন তারই কর্মী সমর্থকসহ স্থানীয় দরিদ্র মানুষেরাও। সেসময় থেকেই তার প্রতি মানুষের অগাধ ভালোবাসার দৃষ্টান্ত তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে রয়েছে অনেক। নির্বাচনী প্রচারণার সময় এক হতদরিদ্র বৃদ্ধার মমতা, নির্বাচনী খরচে সামান্য যোগান দেয়ার চেষ্টা আবেগাক্রান্ত করে পাঠকদের।
“আমার মনে আছে, খুবই গরীব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘন্টা রাস্তায় দাড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, “বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।” আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বললো,“খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।” আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, “তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।” টাকা সে নিল না, আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বললো, “গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।” নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না’।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ২৫৫, ২৫৬)
না, মানুষকে তিনি কখনোই ধোঁকা দেননি। তার সাগরসম উদারতায় বরাবরই অগাধ আস্থায় ঠাই নিয়েছে বাঙালিরা, আর বজ্রকঠিন হুঙ্কারে কেঁপে উঠেছে পাকিস্তানি নরপিশাচদের শোষণের ভীত। বারবার জেলে ভরেও একেবারেই টলানো যায়নি বাঙালিদের প্রতি সুবিচারের জন্য তার আপোষহীন দৃড়তাকে। তার ভালোবাসার তীব্র অধিকারের মুখে স্তম্ভিত হয়েছে পাকিস্তানি শোষকরা, এদেশের মানুষরাও কি হয়নি?
‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’ মামলা (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা –নামে অধিক পরিচিত) চলাকালীন সময়ে তার নিঃশঙ্ক মনোভাবের কিছু ঘটনা হতভম্ব করে দেয় আমাদেরও। ক্যান্টনম্যান্টের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুসহ আরও বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা এবং বেসামরিক আমলা ও ব্যক্তির বিচার চলছিলো। খুবই হাতেগোনা কতিপয় সাংবাদিক সেই বিচারকার্যের সংবাদ পরিবেশনের জন্য ছাড়পত্র পেয়েছিলেন। তাঁদেরই একজন ফয়েজ আহমদ। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন তিন সাংবাদিক ‘আপদ, বিপদ এবং মুসিবত’-এর (আবদুল গাফফার চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ এবং এবিএম মূসা) একজন।
“সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশ, কোনও সাংবাদিক আসামিদের কারও সঙ্গে কথাবার্তা এমনকি দৃষ্টি বিনিময় পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মামলার আসামিদের বসিয়ে দেওয়া হলো কাঠগড়ায়। কয়েক হাত দূরে সাংবাদিকদের বসার আসন। বিচারকের আসনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কতিপয় কর্মকর্তা। বঙ্গবন্ধু প্রধান আসামি, বসে আছেন তারঁ আসনে। এ সময় ফয়েজ আহমদের দিকে তাঁর চোখ পড়ল। তিনি উচ্চকন্ঠে ফয়েজ আহমদকে ডাকলেন। কিন্তু ফয়েজ আহমদের তো ঐ ডাকে সাড়া দেওয়ার অথবা চোখ তুলে তাকানোর কোনও উপায় নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো পরোয়া করেন না ওসব। দুবার ডাকের পরেও সাড়া না পেয়ে তিনি সমগ্র এজলাস কাঁপিয়ে সিংহের মতো গর্জে উঠলেন, ‘এই ফয়েজ, আমার দিকে তাকাস না যে! মনে রাখিস, এই বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের দিকেই তাকাতে হবে আর তার কথাই শুনতে হবে।’ ”(নিরীক্ষা, ২০১ তম সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১২)
শুধু এমনটিই নয়, এমন অজস্র উদাহরণের মাঝেও সেই বিচার চলাকালীন আরও একটি ঘটনা তার অপরীসীম সাহস, দৃড়তার পরিচায়ক।
“মামলার ৩ নং অভিযুক্ত স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান (নৌবাহিনী) যখন তার ওপর পরিচালিত নিষ্ঠুর নির্যাতনের হৃদয়বিদারক ঘটনার বিস্তারিত বিবৃতি প্রদান করছিলেন, তখন প্রত্যেক অভিযুক্তের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে যান এবং মঞ্জুর কাদেরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে উচ্চস্বরে ক্রোধান্বিতভাবে বলেন, ‘মিস্টার মঞ্জুর কাদের, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? আমি এর প্রতিশোধ নেব।’ আদালত কক্ষের প্রতিটা লোক হতবিহ্বল হয়ে গেলেন। বিচারকেরা একে অপরের প্রতি তাকালেন এবং মঞ্জুর কাদের ছিলেন নির্বাক। যে লোকটি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে অল্পদিনের মধ্যে শাস্তিপ্রাপ্ত হবেন, রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী মঞ্জুর কাদেরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে তাঁর এই উক্তি ছিল অভাবনীয় এবং অকল্পনীয়। (সত্য মামলা আগরতলা, কর্নেল শওকত আলী, পৃষ্ঠা ১২২)
না, তার অসীম সাহসিকতার মাত্রা শুধু কল্পনাই করা যায়। অধিকাংশ বাঙালির মানসিক দৈন্য, অকল্পনীয় সঙ্কির্ণতার ঠিক বিপরীত ছিলেন তিনি। তার বিশালতার কিছুটা হলেও হৃদয়ে ধারণ করতে পারলেই নিজেদের সম্মান দিতে পারবে এই জাতি।
কি নিদারূণ, অসহনীয় সঙ্কির্ণ মানসিকতার এই জাতি। মুক্তিযুদ্ধের অব্যাহতি পরেই নির্মম নির্যাতনের শিকার নারীরা পরমাত্মীয়দের আচরণে নির্মম বাস্তবতার সম্মুখিন হয়ে ‘মনুষ্যত্বের অপমৃত্যুতে প্রচন্ড ঘৃণা ও জেদে’ তখন পাগলপ্রায়। অভাবনীয় হলেও সত্য বাবা-মা-ভাইয়েরাও সমাজের ভয়ে এই বীরাঙ্গণাদের ঘরে তুলতে দ্বিধাগ্রস্থ। আর তখনও বঙ্গবন্ধুর বিশালতায় ঠিকই মিলেছিলো তাদের ঠাই। (পুনবার্সন কেন্দ্রে থাকা ৭/৮ জন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গিয়ে) “সেদিন আমাদের চোখের জলে বঙ্গবন্ধুর বুকটা ভিজে গিয়েছিল। বলেছিলেন, ‘তোরা আমার মা, জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিস। তোরা শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা। আমি আছি, তোদের চিন্তা কি? সত্যিই সেদিন মনে হয়েছিল আমাদের বঙ্গবন্ধু আছেন, আমাদের চিন্তা কি?” (আমি বীরাঙ্গনা বলছি, নীলিমা ইব্রাহিম, পৃষ্ঠা ২২)
না, তার বিশালতার পরিমাপ আমরা করতে পারবো না। শুধু শোকের এই কলঙ্কিত মাসের শেষ লগ্নে অগাধ ভালোবাসায় স্মরণ করি তোমাকে হে মহামানব। এই জাতিকে তুমি ক্ষমা করো। তোমার বিশালতার সামান্য হলেও ধারণ করার গৌরব যেনো আমরা পাই। কবি মহাদেব সাহার অমর কাব্যে তোমায় স্মরণ করি।
“তাই আমার কাছে বার্লিনে যখন একজন ভায়োলিন-বাদক
বাংলাদেশ সম্মন্ধে জানতে চেয়েছিলো
আমি আমার বুক-পকেট থেকে ভাঁজ করা একখানি দশ
টাকার নোট বের করে শেখ মুজিবের ছবি দেখিয়েছিলাম
বলেছিলাম, দেখো এই বাংলাদেশ;
এর বেশি বাংলাদেশ সম্পর্কে আমি আর কিছুই জানি না।”
(আমি কি বলতে পেরেছিলাম)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)