এক
মাহবুব রেজাকে নিয়ে কি স্মৃতিগদ্য লেখা যায়!
কারণ সে নিজেই থাকে গভীর স্মৃতির ভেতরে। ছোট ছোট অনুষঙ্গ। নানা মায়াময় আর বিচিত্র সেইসব অনুষঙ্গ। এক আশ্চর্য সুন্দর স্মৃতিকাতরতায় মাহবুব সবসময়য় আচ্ছন্ন থাকে।
কিছুই ভোলে না সে। নারিন্দা, আজিমপুর কলোনী, শরৎগুপ্ত রোড, পুরানো ঢাকা, ইউরোপের নানান দেশের পুরনো শহর, মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, দেশিয় খাবার, শিং মাছের ঝোল, শুঁটকি ভর্তা, পাটশাক, রিকশা, ধ্রুব এষ, চিলেকোঠা, প্রেসক্লাব, আফলাতুনের টেবিল, শিশু একাডেমিতে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার রুম, ইত্তেফাকে দাদাভাইয়ের ছোট্ট ঘরে, বাংলা একাডেমির বইমেলা, শাহবাগ, পল্টনে পুরানা বইয়ের দোকান, রোম-মিলান-ফোরেন্স, বাংলা সাহিত্য, দৈনিক জনকণ্ঠে সাংবাদিকতা, গল্প লেখা, উপন্যাস লেখা, বন্ধুত্বের- কুঞ্জ পুঞ্জ স্মৃতির ভাণ্ডার আমাদের মাহবুব রেজা।
মাহবুব রেজা কথাসাহিত্যিক হিসাবে খ্যাতিমান। দশ হাতে সে লিখতে পারে। গদ্য রচনারীতি খুব স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল। যে কোনো বিষয়কে মাহবুব নিপুণ ক্ষমতায় গল্প-উপন্যাস বানিয়ে তুলতে পারে। ক্ষমতাবান লেখক। তার লেখনী শক্তির বৈচিত্র ও সৃজনশীলতা নিয়ে এখনো মূল্যায়ন হয়নি। মাহবুব রেজাকে বলা যেতে পারে- সে রকম কম মূল্যায়িত লেখক- অথচ অনেক বেশি রকমের মুল্যায়িত হতে পারত সে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। আমরা মাহবুব রেজাকে মূল্যায়ীত করতে পারিনি। অনেক লেখকের ভাগ্যে সময়কালের কালে শৌর্যবীর্য জোটে না। কিন্তু মহাকাল তাদের অবশ্যই মূল্যায়ন করে। মাহবুব সেই প্রজাতির লেখক। হালের বিচারের চেয়ে কালের বিচার যাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
মাহবুব রেজার গল্পের বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন আছে। কারণ তার গল্প সহজ, অনাড়ম্বর কিন্তু গভীর জীবন বোধে নৃত্যরত।
দুই
মাহবুব, তোমার সঙ্গে প্রথম পরিচয় কবে? ৮৫/৮৬ সালে। তখন আমাদের দুরন্ত যৌবন। সারাদিন আড্ডা দিয়ে বেড়াই। লালবাগ, আজিমপুর, নিলক্ষেত, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা- সবখানে।
দৈনিক আজাদ-এর অফিস লালবাগে। প্রতি বুধবার সেখানে মুকুলের মাহফিলের আসর বসে। ওখানেই মাহবুবকে প্রথম দেখি। খুব রসিক প্রকৃতির, খোঁচা মেরে কথা বলার ওস্তাদ এক নটবর। প্রথম দিনেই জমে গেলাম। দীর্ঘ আড্ডা হলো। তখন মাহবুব রেজা নিয়মিত আমলিগোলার বাসায় আসতো। আমার বাবা-মা ও ভাইদের সঙ্গেও ওর পরিচয় হতে সময় লাগলো না। আমার খালাত বোনের সঙ্গে মাহবুবের বড় ভাইয়ের বিয়েও হলো। সে কোন যুগের কথা!
মাহবুবকে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চিঠি লিখেছিলেন। আশ্চর্য সুন্দর সেই চিঠি। মাহবুব তার জীবনের হতাশা ও ভাগ্য বিড়ম্বনার কথা লিখেছিলো। সুনীল তার আশাবাদী ভাষায় সেই চিঠির জবাব দিয়েছিলেন। সুনীল যার চিঠির জবাব দেয় সে একদিন বিরাট বড় লেখক হবেই- নিশ্চিত আমরা।
মাহবুব রেজার সঙ্গে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অনেক স্মৃতি। আড্ডার শেষ নেই আমাদের। শিশু একাডেমি চত্ত্বরে সারাদিন আড্ডা দিয়েছি। বাসায় সারাদিন আড্ডা। সম্পাদকদের টেবিলে টেবিলে ঘুরেছি সারাদিন। সঙ্গে মাহবুব রেজা।
১৯৮৭/ ৮৮ থেকে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে জড়িত হয়ে পড়লাম। ‘আসন্ন’-এর সম্পাদনা সূত্রে। কেন্দ্রের বিশাল বইয়ের সাম্রাজ্যে আমাদের আকর্ষণের মূল কারণ। আর মাহবুবের জীবন-সংগ্রাম শুরু হলো।
তিন
মাহবুব ছোট বেলাতেই পিতৃমাতৃহীন। ওরা ভাইবোনেরা গাদাগাদি করে মানুষ হয়েছে নানা-নানীর কাছে। তারপর ভাই বোন মিলে আলাদা বাড়ি করেছে। জীবন বয়ে চলে আপন গতিতে।
মাহবুব কিছু দিন ইটালিতেও দিলো ভাগ্য অন্বেষণে। মাহবুব ঘোরতর সংসারী। সাজানো গোছানো জীবন। মাহবুব এখন বিত্তবান। বাড়ি-গাড়ি, জায়গা-জমি, সব আছে। ছেলেমেয়েও মানুষের মত মানুষ হয়ে উঠছে। সফল জীবন বলা চলে। ভেঙে পড়া, আশাহীন জীবনের গহ্বর থেকে মাহবুব আজ যে জায়গায় এসেছে সেটা অনেক বড় সাফল্য। মাহবুবের সঙ্গে এখন দেখা হলে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবি- কেবলমাত্র সাহিত্যবোধই আমাদের জীবনকে শুভ ও কল্যাণময় করে তুলেছে। রিটন ভায়েইর তত্বাবধানে খবর গ্রুপের একটা মহিলা পত্রিকা ছিলো ‘মনোরমা’ নামে। সেই পত্রিকায় আমরা কাজ করতাম। আমি অনর্গল ভালো-মন্দ লিখে যেতে পারতাম। তরুণ বন্ধুদের মধ্যে এই গুণাবলী আমার চেয়েও বেশী ছিল মাহবুব রেজার মধ্যে। পত্রিকার নিউজ প্রিন্ট প্যাডে সে একটানা লিখে যেত। কোনো কোনো সপ্তাহে ‘মনোরম’ পত্রিকায় অর্ধেক হয়ত সে লিখে ফেলল একাই। পরেও সাংবাদিক জীবনে অনেক ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে মাহবুব কাজ করেছে।
মাহবুব গদ্য শিল্পী হিসেবে সমধিক খ্যাতি অর্জন করে। মাহবুব, সারওয়ার উল ইসলাম, রোমেন রায়হান, অকাল প্রয়াত ওবায়দুল গনি চন্দন। এদের ঈষৎ অগ্রজ আনজীর লিটন, ডাক্তার সজল আশফাক। মাহবুব-এর গল্প রচনার সহযাত্রী শাহ নিসতার জাহান, অমল সাহা- এখন কি আর লেখে?
মাহবুব খুবই চটপটে। কথাবার্তায় তুখোড়। কৌতুক প্রিয় আড্ডাবাজ। প্রাণ খুলে হাসে। আর খোঁচাখুচির সৃজনশীল অভ্যাস আছে মাহবুবের। ওর সবকিছুতেই খুব তীব্রতা। কারো সমালোচনা করলে তীব্রভাবে যৌক্তিক গ্রাউন্ডে তাকে আক্রমণ করবে। মাহবুব খুব মারদাঙ্গাও বটে। অল্পতেই রেগে যায়। তবে ভীষণ কোমল একটা মনও আছে তার। ছোটবেলার মাস্তানী মনোভাবটা এখনো ওর মধ্যে বলবৎ আছে।
কাউকে ভালোবাসলে জীবন দিয়ে ভালোবাসে। কাউকে ঘৃণা করলেও সেটা সর্বাত্মক ভাবে ঘৃণা করে।
মাহবুবের এই তীব্রতাই মাহবুব রেজার শক্তি। জীবনে উত্থানের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছে বেচারা। দীর্ঘ পরবাস জীবনে লেখালেখির সঙ্গে সংশ্রব ছিলো না।
চার
গত ১০/১৫ বছর ধরে মাহবুব সাহিত্য কর্মে খুবই নিবেদিত প্রাণ। প্রতি বইমেলায় ৭/৮ টা গল্প-উপন্যাস প্রকাশিত হয়। নিজের বই বিক্রি বা প্রচারের জন্য নির্লজ্জতা নেই মাহবুবের। সে অকারণ বাহুল্য কোনো কাজ-কর্মের মধ্যে থাকে না। মাহবুব খুব ভালোমতোই জানে, যদি লেখার মধ্যে কোনো সারবস্তু থাকে তবে এমনি তা আলোচিত হবে। প্রচার-প্রপাগাণ্ডা করে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে, টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে লেখক হওয়ার আকাঙ্খা তার নেই।
এমন কথা আমাদের এখানে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলার ক্ষমতা একমাত্র মাহবুব রেজা-ই রাখে।এবং সে এই কাজটা মারাত্মক ভাবে করে। মাহবুব এখন প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত। ‘পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স’র সৃজনশীল বিভাগের প্রধান সম্পাদক হিসেবে গত চার বছর সে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে এই প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনার মানকে অতীতের চেয়ে অনেক বড় জায়গায় নিয়ে গেছে- এই কৃতিত্ব মাহবুব রেজাকে দেয়া যায়। আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করি তারা যোগ্য ও মেধাবী লেখক মাহবুব রেজাকে দেখেই এখানে অনেক পরিকল্পনা আর লেখা নিয়ে গিয়েছি। পেশাদার প্রকাশনার আঙ্গিকগত পরিবর্তন ও উৎকর্ষ সাধন আর কিভাবে প্রকাশনাকে বিশ্বমানের পর্যায়ে নেয়া যায় সে ব্যাপারে মাহবুব অন্য দশজনের চেয়ে বেশিরকমের অবগত। প্রকাশনার সাম্প্রতিক বিকাশ নিয়ে মাহবুবের রয়েছে নিজস্ব পরিকল্পনা, ভাবনা। আর প্রকাশনা সংক্রান্ত এসব কাজে ওর সঙ্গে ধ্রুব এষের সঙ্গে চমৎকার বোঝাপড়া রয়েছে। কখনো কখনো মাহবুব আমাকেও ওর আর ধ্রুবর সঙ্গে যুক্ত করে নেয়- আমি তাতে অনেক নতুন কিছু যুক্ত করি।
অন্যের বই প্রকাশ করার ব্যাপারেও মাহবুব অনেক যত্নবান। আমার অনেক বই-ই মাহবুবের তত্ত্ববধানে প্রকাশিত হয়েছে। মাহবুব নিজের মত পুরো বই ছাপার পরে বাঁধাই করে আমার কাছে নিয়ে এসেছে। আমি মুগ্ধ হয়েছি। কোন সমালোচনা করতে পারিনি, মাহবুব আমার উপর দীর্ঘ স্মৃতি গদ্য লিখেছে। আমার প্রয়াত বাবা-মা’র স্মৃতি মাহবুবের কাছে এখনও উজ্জ্বল।
পাঁচ
দেশের বিখাত সব শিল্পী-সাহিত্যিকেরা মাহবুবকে নিঃশর্ত ভাবে ভালোবাসে। তরুণ নবীন লেখকদের সঙ্গে মাহবুবের রয়েছে আন্তরিক বোঝাপড়া। ওর দীর্ঘকাল পত্রিকা আর মিডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততা লেখকদের সঙ্গে ওকে আরও বেশি গভীর বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। আমি জানি মাহবুব রেজা দেশের অনেক নতুন লেখকের কাছে অতি প্রিয়জন। মাহবুবকে তারা নানাকারনে মানে- তারা জানে মাহবুব রেজার হাতে একটি লেখা প্রকৃত অর্থে লেখা হয়ে ওঠে। মাহবুব রেজার সম্পাদনার হাত অসাধারণ- সে সম্পাদনাটা আর দশজনের চেয়ে অসম্ভব ভালো জানে এবং বোঝে।
মাহবুব রেজাকে ভালো না বেসে উপায় নাই। ধ্রুব এষ, কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরীর সে খুব নিকটজন। এছাড়া ইমদাদুল হক মিলন, লুৎফর রহমান রিটন, আসলাম সানী, আহমাদ মাযহার, ফারুক নওয়াজ, শার্লী রহমান, শিরীন বকুল, খায়রুল আলম সবুজ, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, হাবিবুল্লাহ সিরাজি, মুনতাসীর মামুন, হাশেম খান, শাহরিয়ার কবির প্রমুখের প্রিয়জন সে।
অগ্রজ লেখকদের সঙ্গেও তার খুব আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক । সিনিয়ার লেখকেরা মাহবুবকে পছন্দ করেন। ত্রিশ বছরের অধিককাল ধরে সাংবাদিকতা করছে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্থায়ী সদস্য হিসেবে সাংবাদিক মহলেও মাহবুব অসম্ভব জনপ্রিয়- মাহবুব কখনো তার এসব ক্ষমতাকে কাজে লাগায় নি। সে খুবই সহজ সরল। আর এসব কারণে মাহবুব সকলের ভালোবাসার পাত্র।
মাহবুবের মধ্যে আদর কেড়ে নেয়ার মিষ্টি ব্যাপার আছে। আমাদের কাছে মাহবুব রেজা এখনও কিশোর কালের সেই মাহবুব। ওর সঙ্গে দেখা হলেই এখনো আমরা আমাদের ফেলে আসা সেই যুবক বয়সে, যুবক কালে ফিরে যাই। শুরু কবি আড্ডা-নানা প্রসঙ্গে। আমাদের আড্ডায় নানা প্রসঙ্গের ফাঁকফোকরে এর তার নামে কথা চলে এসে- কখনো কখনো কারো নামে আমরা সমালোচনা করি, পক্ষ বিপক্ষ করি- মাঝে মধ্যে হয়তবা গীবৎও করি। পরচর্চা, পরনিন্দায় মেতে উঠি। তারপর আমাদের স্বপ্নের কথা, কাজের কথা শুরু হয়। ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা ভাবতে থাকি।
ছয়
মাহবুবের একটা প্রচণ্ড গুণ রয়েছে- সেটা হলো সে সব ধরনের পরিস্থিতিকে সামাল দিতে পারে। নিজেকে কোথাও বন্ধক দিতে শেখেনি সে। আর মাহবুবের দীর্ঘ সময়ের ইউরোপ বসবাস ও তার অভিজ্ঞতা তাকে তার আশেপাশের সব নোংরামি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সহায়তা করেছে। মাহবুবের এই সব কিছু সরে থাকার গুনটাও আমাকে মুগ্ধ করেছে। ও আসলেই একজন আধুনিক আর প্রাগ্রসর মানুষ, লেখক।
মাহবুবের আরেকটি ক্ষমতার কথা না লিখলে অপরাধ হবে আমার। সেটা হলো সে সার্বক্ষণিক লেখালেখি করতে পারে। এই বয়সে এসে এত কাজের ফাঁকে, এত ব্যস্ততার মধ্যেও মাহবুব প্রায় প্রতিদিনই সময় বের করে নিজের লেখাটা সে লেখে। নানা ধরণের লেখায় সে নিজেকে ব্যস্ত রাখে- নিজের সব কথা বলে যেতে চায়। দিন দিন ওর এই ক্ষমতাটি ক্ষুরধার হয়ে উঠছে- ওর সমকালীন অনেক লেখকের মধ্যেই এই গুনটি আমি দেখি না। মাহবুবের এই অনবরত লিখতে পারার ক্ষমতাকে আমি সমীহ করি।
ইদানীং মাহবুব রেজার সঙ্গে টেলিফোনে আড্ডা শেষই হতে চায় না।
ওর ভালোমানুষী, সৎ মনোভাব এবং দরদী হৃদয় তাকে আরো বড় লেখকে পরিণত করবে- স্থির বিশ্বাস আমার।