প্রতিদিনের যুদ্ধের দামামা ছড়ানো দম যেতে যেতে বেঁচে যাওয়া শহরে সিটি কর্পোরেশনের কোদাল কিম্বা হাতুড়ির আওয়াজে ঘুম ভাঙা নগরে হাজারো ভোগান্তি পায়ে পায়ে নিয়ে চলা রাজধানীতে মড়ার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো আরেক যন্ত্রণা এইচএসসি পরীক্ষা। শহরের প্রতিটি কেন্দ্রের সামনে কমবেশি একই চিত্র। রাস্তাঘাট… ফুটপাত… আইল্যান্ড… ওভারপাস… আন্ডারপাস… বিভিন্ন অফিসের সিঁড়ি কিম্বা আশপাশের মার্কেটের করিডোর- কোনোখানে পা ফেলার জায়গা নেই। কারণ একেকজন পরীক্ষার্থীর সাথে কমপক্ষে দু’জন করে অভিভাবক চাদর কিম্বা খবরের কাগজ বিছিয়ে সন্তানদের জন্য অপেক্ষারত।
কেন্দ্রের গেটে অভিভাবকরা দোয়া-কালাম পড়ে ফুঁ দিতে দিতে বাচ্চাদের পরিপাটি চুলের ভাঁজ নষ্ট করছেন বলে অনেকে খিটমিট চোখে তাকাচ্ছে মায়েদের দিকে। অনেক মা জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন… অনেক মা জোর করে সন্তানদের মুখে প্রায় যুদ্ধ করে তুলে দিচ্ছেন যমযমের পানি; সেই দৃশ্য দেখে জমও ভয় পাবে। অনেক অভিভাবক কেন্দ্রের গেটের দারোয়ানের হাতে গোপনে তুলে দিচ্ছেন টাকা। কারণ পরীক্ষা শেষ হলে প্রথমদিকে যেন দাঁড়াবার সুযোগ পান। অন্যপাশে মানুষের ভোগান্তিতে সুবিধা লোটা চরিত্রের মানুষরূপী অনেকে ভ্রাম্যমাণ চেয়ার এবং মোড়ার ব্যবসা করছেন ঘণ্টা ১০ টাকা। এই দেশের মানুষের চেয়ারের প্রতি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লোভের কারণে ঘণ্টা প্রতি এই লাভের ব্যবসা দোষের কিছু না।
কিন্তু প্রশ্ন তো একটাই: পৃথিবীর কোনো দেশে কি এমন নিয়ম কিম্বা রীতি আছে, রাস্তাঘাট বন্ধ করে ১৮ বছরের ছেলেমেয়েদের এত যুদ্ধ করে শহরকে যন্ত্রণা দিয়ে সাথে করে নিয়ে আসতে হবে? সব সন্তানই বাবা মায়ের কাছে শিশু এবং শর্ত আর স্বার্থ ছাড়া সম্পদ। তাই বলে ১৮ কিম্বা ১৯-এর মানুষদের কেন আঙ্গুল ধরে হাঁটতে হবে? এই চিত্রের বিপরীতের চিত্রও আছে। যেমন, ছেলেদের সাথে কিন্তু তেমন কোনো অভিভাবক নেই। তারা একলা আসছে। হেলে দুলে বন্ধুবান্ধব নিয়ে খোশগল্প করতে করতে হলে ঢুকছে। অথচ মেয়েদের সাথে পাহারাদার।
তবে কি এই শহর আর এই দেশ শুধু পুরুষদের? নারীদের না? তারমানে এই শহর কি নারীদের একলা চলার কিম্বা একলা কাজের বাধা? বেড়ে ওঠার কিম্বা গড়ে ওঠার শুরুতেই কি এই শহর আমাকে সব অলিগলির হাওয়া বাতাস গায়ে মাখতে নিষেধ করছে? এই শহর কি নারীদের চলার পথে টেনে দিচ্ছে লক্ষণরেখা? এই শহর কি চাইছে না পুরুষের সাথে যুদ্ধ করে পায়ে পা মিলিয়ে জীবনকে সামলে নিতে শিখুক নারীরা? এত এত প্রশ্ন নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছি আর শত শত অভিভাবকের কাছে সেই প্রশ্ন গুলোর উত্তর চেয়েছি…।
প্রায় খুন করে ফেলা দৃষ্টি নিয়ে উত্তর গুলো ছিল: মেয়েটাকে একা ছাড়ব, নিরাপত্তা আর ভরসা কই? মেয়েটা কিসে করে যাবে? যাবার জন্য নিরাপদে যানবাহন কই? রাস্তায় যে ট্রাফিক, মেয়েটাকে কোন সিগন্যালে গিয়ে ঘণ্টা পার করতে হবে লেট হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি যাবার বিকল্প রাস্তা কই? একলা মেয়ে কী করে পাঠাও কিম্বা উবারে যাবে? পাঠাও চালক তো সব ইয়ং ছেলেপেলে… আপা রাস্তার যে অবস্থা জীবনের কোনো দাম নেই। পথে ঘাটে যদি বিপদ আপদ হয়? তাছাড়া আমাদের মেয়েরা কখনও একা একা কোনোখানে যায় না; মানে আমরাই যেতে দিতে চাই না। তাছাড়া মেয়েরা একা একা যাবে, পরিবারের চাচা-মামারা নানান কথা বলে। সমাজ কী বলবে? বুঝছেন আপা দেশের অবস্থা তো ভালো না… আপনি তো আমাদের থেকে আরও ভালো জানেন।
কেন আপা, দেশে কী হয়েছে?
আরে আপনি কী বলেন এসব! প্রতিদিন যে হারে আগুন লাগছে, এসব তো লক্ষণ ভালো না। কি যে টেনশনে থাকি আপা বুঝবেন না। আল্লাহ জানে পরীক্ষা কেন্দ্রে যদি আগুন লাগে, আমাদের বাচ্চাদের কী হবে!
আমি আস্তে করে বললাম, আগামীকাল থেকে আসবার সময় ভাইদের হাতে এক বালতি পানি দিয়ে দিবেন। ওনারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন।
শুধু মনে মনে ভাবি, ভাবী কিম্বা আপা অথবা ভাইগুলো যদি নিজেরাই নিজেদের প্রশ্নগুলোর উত্তর সাহস করে দেয়া শুরু করেন তাহলে মেয়েগুলো মানুষ হতো। সেই সাথে যানজটে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হতো না শহরকে।
খুব অপেক্ষাতে থাকার পরও কোনো একজন অভিভাবকের কাছ থেকে শুনতে পেলাম না কেউ একটিবারের মতো বলছে: প্রথমদিন এসেছিলাম মেয়েটিকে পথঘাট চেনাতে। কাল থেকে আর আসতে হবে না। কিম্বা কেউ একজন বলছে: মেয়েটার কলেজ জীবনের শেষ পরীক্ষা। প্রতিদিনের নানা ব্যস্ততায় ওকে সময় দিতে পারি নাই। পরীক্ষার শুরুর দিনটাতে পাশে বসিয়ে এনেছি, আমি তার সব ভালোমন্দে পাশে আছি জানান দিতে। কিম্বা কেউ একজন বললো না: পাস করলেই মেয়েটা দূরে যদি পড়তে চলে যায়, সে কারণে কলেজের শেষ পরীক্ষার শুরুর দিনটা কাছে থাকা।
সবকিছুকে ওলোট পালোট করে সবার একটাই কথা: আহারে আমার বাচ্চা মেয়েটা গেটের কাছে আমাকে না পেলে যদি হারিয়ে যায়? পরীক্ষা শেষ হলে ১৮ বছরের একটা মানুষ কী করে চৌহদ্দির মধ্যে থেকে হারিয়ে যাই? এত নিরাপত্তার অনিশ্চয়তার হাত থেকে অভিভাবকদের কে বাঁচাবে? আমি যখন লিখছি ঠিক তার পাশে শতশত মা তসবি জপছেন তার মেয়ে যেন সহি-সালামতে ফেরত আসে… আচ্ছা, ওরা কি যুদ্ধে গেছে?
আমিও মা…। আমার মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করছি একটা কফি শপে। তবে সেই অপেক্ষা শহর অনিরাপদ কিম্বা ওর আঙ্গুল ধরে হাঁটার জন্য নয়, আমি দূরে বসে দেখি আমার মেয়েটি যে অনেক বড় হয়ে গেছে…। একা একা সে ভিড়ে মিশে যেতে পারে…, চড়া রোদ কিংবা তুফান বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে ঠিকই বাড়ি ফিরতে পারে।
সময়ের সাথে সন্তান বেড়ে উঠুক…।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)