তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সংসদে বলেছেন, বিগত সাত বছরে সাত শতাধিক পত্রিকার নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। সারাদেশে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ষান্মাসিক, ত্রৈমাসিক মিলে মোট ২ হাজার ৮ শত পত্রিকা বেরোচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে নিবন্ধিত পত্রিকা ও অনিবন্ধিত পত্রিকার পার্থক্য বোঝা মুশকিল। নিবন্ধিত পত্রিকাও নিউজের লিংক বের করছে, অনিবন্ধিত পত্রিকাও লিংক বের করছে। আবার লিংকগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন মাধ্যমে শেয়ার হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে। ভুয়া আর আসল খবরের ভিড়ে পাঠক তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কোনগুলো সংবাদপত্র ও কোনগুলো সংবাদপত্র না তা ধরতেই পারছে না তারা। এভাবে যে কেউ তার নিজের ইচ্ছেমতো যদি লিংক বের করে ফেলে তাহলে কি লিংকের কোনো গুরুত্ব থাকে?
বর্তমান সময়ে অনলাইনের জয়জয়কার চলছে। মুদ্রিত পত্রিকার বিক্রি কিছুটা হলেও কমেছে। তাই তারাও বাধ্য হয়ে অনলাইন সংস্করণ বের করছে। অনলাইনে যাচ্ছে টেলিভিশনের নিউজগুলোও। বেরোচ্ছে অনলাইন টিভি ও ইউটিউব চ্যানেল। সোশ্যাল মিডিয়া ছড়িয়ে গেছে শহর, গ্রাম, সর্বত্র। একটি বিষয় লক্ষ্য করছি, অনলাইন টিভি, অনলাইন নিউজ ও ইউটিউব চ্যানেল যে কেউ চালু করে ফেলতে পারে। অনলাইনের জন্য নিবন্ধনের নিয়ম থাকলেও ইউটিউবের উপরে কারো নিয়ন্ত্রণ নেই।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো কিছু লেখা আর সংবাদ পত্রের লিংক এক নয়। এটি একটি অন্যধরণে গুরুত্ব বহন করে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়া হলো চা স্টলের আড্ডা, পথেঘাটের ঝগড়া, বাজারের হট্টগোল প্রভৃতির অনলাইন সংস্করণ মাত্র। নিউজের লিংক আর সোশ্যাল মিডিয়ার স্ট্যাটাস এক নয়। এ বিষয়গুলোর গুরুত্ব না দিয়ে চালু করা হচ্ছে একবার ৫৭ ধারা আরেকবার ৩২ ধারা!
ওয়েবসাইট খুললেই তা সংবাদপত্র হয়ে যায় না, এটা অনেকেই জানে না। অনিবন্ধিত পত্রিকার লিংক প্রকাশ নিষিদ্ধকরণে বিভিন্ন আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন কঠিন। কেউ চাইলে নিজ দায়িত্বে নিজের ওয়েবপেজ খুলে লেখালেখি করতে পারে। তবে এসবের দায়ভার সংবাদমাধ্যমের অবশ্যই না। নামে বেনামের কত কী ওয়েবসাইট, তারা জীবিত ব্যক্তিকে মৃত বানিয়েও লিংক প্রকাশ করছে। আর এগুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে ফেসবুক, টুইটার, ভাইবার, হোয়াটসআপ, লিংকডইনসহ বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায়, পরবর্তীতে এগুলো হয়ে উঠছে রেফারেন্স। তাদের মানতে হয় না কোন গণমাধ্যম নীতিমালা। তাদের বেলায় প্রযোজ্য নেই ওয়েজবোর্ডের বিধিমালা। নিজের বাড়িতে একটি ল্যাপটপ নিয়ে বসে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন লিংক। ভুয়া তত্ত্ব ও তথ্যের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়ে এসব লিংক পরে সরিয়েও দিতে পারছে তারা। সংবাদ পত্রের মর্যাদা রক্ষায় সবার আগে এসব দূর করাই দায়িত্ব নয় কি সরকারের?
নিবন্ধিত পত্রিকায় ভুয়া নিউজ প্রকাশ করলে ৫৭ ধারা কিংবা ৩২ ধারার দরকার কী? একটা নীতিমালার ভিত্তিতেই তো তাকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। নিবন্ধন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষইতো তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রয়োজনে তার নিবন্ধন বাতিলের ব্যবস্থা নিতে পারে। সমস্যার মূলে না গিয়ে কেন এই হট্টগোল?
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করলে তা গুপ্তচর বৃত্তি হয়ে যাবে! কিন্তু তা কি নিবন্ধিত পত্রিকার ক্ষেত্রে না অনিবন্ধিত পত্রিকার ক্ষেত্রে? সংবাদ কর্মীরাতো পেশাগত কারণেই তথ্যানুসন্ধান চালাতে পারে। যারা সংবাদকর্মী নয় তাদেরটা গুপ্তচর বৃত্তি হলে হতেও পারে। সরকারের উচিত এবিষয়টাকে সুষ্পষ্ট করা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তার প্রতিক্রিয়া লিখে থাকে। তাহলে কি এসব বলাও ৫৭ ধারা কিংবা ৩২ ধারায় আওতায় পড়তে পারে না? জীবন চলার পথে হোঁচট খেলে,কোন প্রিয়জন মারা গেলে তার মনের অনুভূতিও লেখে সোশ্যাল মিডিয়াতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও কল দিয়ে অনেকের সুইসাইডের খবরও শোনা যায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়তো এসব দূর করতে পারবে, তারপরেও এই আইন কেনো তা পরিষ্কার না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘অাপনারা (সাংবাদিকরা) গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাদের মান ইজ্জত থাকে না। তাদের সম্মান ক্ষুন্ন হয়। তারাতো জনপ্রতিনিধি। তাই এগুলো ঠেকাতেই এ আইন করা হয়েছে।’ এটাই যদি সরকারের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে এটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কেন ‘এমপি সুরক্ষা আইন’ বলাইতো সঙ্গত ছিল।
তোফায়েল আহমেদ এও বলেছেন আইন করা স্বত্ত্বেও আপনাদের ঠেকানো যাবেনা। যদি তা-ই হয় তাহলে শুধু শুধু কেন এই আইন করে সংবাদ কর্মীদের বিরাগভাজন হওয়া? সাংবাদিকরা সংবাদ রচনা করবে। সমাজের সর্বস্তরেই সংবাদের উপাদান খুঁজে বেড়াবে এমনটাই তাদের পেশাগত দায়িত্ব নয় কি? এমপি কেন্দ্রিক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করলে কি সংবাদকর্মী ও সংবাদপত্রের দোষ?
এ আইনে এমপিদের সুরক্ষাও হবে না, সংবাদ মাধ্যমও যেভাবে আছে সেভাবেই রবে হয়তো এর কোন পরিবর্তন হবে না। অনিবন্ধিত পত্রিকায় লিংক প্রকাশ নিষিদ্ধ হলে ও সংবাদমাধ্যমকে তার নিবন্ধনকৃত বিধিমালা অনুযায়ী চলতে বললেইতো হয়ে যায়। অযথা এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করে কেন দেশ জুড়ে হট্টগোলের সৃষ্টি? প্রয়োজন নিউজের লিংক প্রকাশের শৃঙ্খলা। সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা অনিবন্ধিত পত্রিকার লিংকের দায় কেন সংবাদ মাধ্যমে বর্তাবে? কত বড় বড় ব্যক্তিদের সম্পর্কে পথেঘাটে, হাটে, বাজারে, চায়ের দোকানে কত কথাইতো হয়? এগুলোও কি বন্ধ হচ্ছে? কারণ সোশ্যাল মিডিয়ার লেখালেখিতো এসবেরই অনলাইন সংস্করণ। সরকারের শেষ পর্যায়ে মনে হয় কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। সাংবাদিকদের রাজপথমুখী হয়ে ওঠার ক্ষেত্র সৃষ্টি খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত ও অহিতকর হবে সরকারের জন্যই। সরকারের নীতিনির্ধারকদের এবিষয়ে ভেবেচিন্তে অগ্রসর হওয়া খুবই জরুরি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)