জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে-কবির এ অমোঘ উক্তিটির বাস্তবতা প্রত্যেকের জীবনেই ঘটবে এবং একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এ স্বাভাবিক ঘটনাটি যখন অস্বাভাবিক হিসেবে আমাদেরকে মেনে নিতে হয় তখন সেটি সকলের জন্য পীড়াদায়ক ও সারাজীবনের কান্নার খোরাক হিসেবে আবির্ভূত হয়। অনাকাঙ্খিত মৃত্যু বলতে সাধারণভাবে সড়ক দুর্ঘটনা, ভূমিকম্পের ফলে মৃত্যু, পানিতে ডুবে মৃত্যু, লঞ্চ ডুবে মৃত্যু, আগুনে পুড়ে মৃত্যু এবং সার্বিকভাবে ব্যবস্থাগত ত্রুটির কারণে যে কোন মৃত্যুই অনাকাঙ্খিত।
বলছিলাম, চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ফলে নিহত হওয়া মানুষের কথা এবং সেই সাথে নি:স্ব হয়ে যাওয়া শতাধিক পরিবারের কথা। চকবাজারের ব্যাপক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি বাংলাদেশের সকল বিবেকবান মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে এবং একই সাথে বাংলাদেশের শহর ব্যবস্থাপনার অসংলগ্নতার বিষয়টিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মানবসৃষ্ট সমস্যাটি বাংলাদেশের পরিধি ছাড়িয়ে বিশ্বের মাঝেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে এবং বিশ্ব নেতারা শোক বার্তা প্রেরণ করেছে। কারণ, প্রতিনিয়ত সমগ্র বিশ্বে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর হার ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে এবং যা রীতিমত দুশ্চিন্তার এবং উদ্বেগের। কিছু দিন পর পরই পত্রিকার পাতা এবং টেলিভিশনের নিউজ ফিডে বিশ্বব্যাপী অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর শিরোনাম হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা এবং শহরকেন্দ্রিক নির্ভরতা মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ ও বিপন্ন করে তুলেছে।
তবে মোদ্দা কথা হচ্ছে, পূর্বেও আমরা আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনার ভয়াবহতা দেখেছি এবং ঘটনা শেষে আলোচনা হয়, বিবৃতি দেওয়া হয়, শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ও নানাবিধ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং শেষত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটে এবং তার সাপেক্ষে তদন্ত কমিটি ১৭ দফার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় এ ধরনের অনাকাঙ্খিত মৃত্যু দেখতে হতো না। কাজেই, পূর্বের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে চকবাজারের ঘটনার সামগ্রিক মূল্যায়ণ করে তথ্য ও তত্ত্বের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গৃহীত সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ সংক্রান্তে অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা থেকে জাতিকে পরিত্রাণ করা সম্ভব হবে মনে করছি। তবে তার জন্য সরকার, ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিক সহ ক্রেতা বিক্রেতা ও জনসাধারণের সচেতনতা ও সমন্বিত উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই।
আমাদের একটি সমস্যা হচ্ছে, নিজের সমস্যাকে/দায়িত্বহীনতাকে অন্যের কাঁধে চাপানোর চেষ্টা করে থাকি এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে জবাবদিহিতার বিষয়টি অমূলকই থেকে যায়। চকবাজারের ঘটনার পরেও দায়িত্বশীলদের অন্যের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা দেখা যায়। বিভিন্ন পত্রিকার খবরের মাধ্যমে জানা যায়, এক পক্ষ বলছে ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ আর গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে। আবার আরেক পক্ষ বলছে, ঘটনাস্থলে ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ আর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি। আবার অন্য একটি পক্ষ বলছে, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকেই আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে। আবার দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলেছে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রাসায়নিক পদার্থের মজুদ, ঘিঞ্জি পরিবেশ, পানির সংকট, সরু রাস্তা, যন্ত্রপাতি সরবরাহে ব্যাঘাত পাওয়া, সর্বোপরি লোভ আর অব্যবস্থাপনার কারণেই চকবাজারে ভয়াবহ আগুনের মাধ্যমে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তবে যাই হোক, ঘটনাটি তো ঘটেছে এবং এর সাপেক্ষে যাদের অবহেলা রয়েছে তদন্ত করে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
এ ঘটনার জন্য দায়ী কে? শুরু থেকেই নানা পক্ষে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শকের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয় ঘটনার পরবর্তী সময়ে। বিস্তারিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ব্যর্থতা পুরোপুরি অস্বীকার করব না। তবে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানা যায়, সমন্বিত এবং সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ও তার ফলে ক্ষয়ক্ষতির প্রাদুর্ভাব কমানো কখনোই সম্ভবপর হবে না। নিমতলী ঘটনার পরে সুপারিশকৃত নতুন রাসায়নিক দ্রব্যের স্থাপনা নির্মাণের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক দ্রব্যের স্থাপনা সরানো যায়নি এবং ঐ ঘটনার পরে নতুন করে কোন রাসায়নিক স্থাপনার ছাড়পত্র দেইনি কর্তৃপক্ষ।
পাশাপাশি পত্রিকার খবরের মাধ্যমে জানা যায়, পুরান ঢাকার বাড়ির মালিক এবং ব্যবসায়ীদের লালসার কারণে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটে। স্থানীয়রা জানায়, বেশি টাকার লোভে বাড়ির মালিকেরা বিল্ডিং এর নিচ তলায় মুদি দোকানের পরিবর্তে দাহ্য ও কেমিক্যাল পদার্থ মজুদের জন্য গুদাম বা কারখানা ভাড়া দেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, ঘটনার জন্য সরকার সহ ব্যবসায়ী ও পুরান ঢাকার বাড়ির মালিকরা দায়ী। নিমতলী ঘটনার পর গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও তা না করে সিটি কর্পোরেশন নতুন নতুন লাইসেন্স নবায়ন করেছে মর্মে অভিযোগ পাওয়া যায়। তাছাড়া, রাস্তা ঘাট এতই সরু যে, পাশাপাশি দুটি রিকশা যাওয়ার জায়গা না থাকা সত্ত্বেও বাড়ির নিচতলায় কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের গোডাউন তৈরি করে রেখেছিল মালিক পক্ষ। একটি বারের জন্যও চিন্তা হয়নি, কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে দ্রুত হাসপাতাল ও ফায়ার সার্ভিসের সাথে যোগাযোগ ও সেবা পাওয়ার জন্য যে ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রয়োজন পুরান ঢাকায় অলি গলি রাস্তা ও ঘিঞ্জি পরিবেশে তা নেই বললেই চলে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে; সরকার, ব্যবসায়ী ও বাড়ির মালিকপক্ষ কোন না কোনভাবে পুরান ঢাকার চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের দায় এড়াতে পারে না।
ভবিষ্যতে যেন বাংলাদেশে নিমতলী কিংবা চকবাজারের চুড়িহাট্টার মতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড না ঘটে তার জন্য জনগুরুত্বপূর্ণ ও যথার্থ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সত্য কথা বলতে কি-পুরান ঢাকা দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। পুরান ঢাকাকে আবাসিক এলাকা ঘোষণা করে সবগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে, যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। কারণ, এখনো অনেক বাড়ির নিচতলায় কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের গোডাউন রয়েছে শীর্ষক খবরের শিরোনাম টেলিভিশনের নিউজ ফিডে ভেসে আসছে। এ সংক্রান্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন; পুরান ঢাকায় আর কোনভাবেই কেমিক্যাল গোডাউন রাখতে দিবো না। দাহ্য পদার্থের গোডাউন উচ্ছেদে অভিযান অব্যাহত থাকবে। ব্যবসায়ীদেরকেও সচেতন ও নীতিগত উপায়ে ব্যবসা করার মানসিকতা বপন করতে হবে না। এখনো অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা পুরান ঢাকা থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্যত্র স্থানান্তরে নারাজ। তারা যে কোন মূল্যে পুরান ঢাকায় ব্যবসা চালু রাখার পক্ষে। এখন দেখা যায়, কি হয়-সময়ই সব কিছু বলে দিবে আমাদের। তবে আশা রাখবো, সব পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিরাপদ জীবন যাপনের স্বার্থে অনাকাঙ্খিত মৃত্যু নিরসনের জন্য সকল পক্ষকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা উচিত।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)