চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘অদম্য’ ফুরুল্লার ‘উদোম’ চিঠি

এক ছিলো ফুরুল্লা। থুক্কু, একজন আছেন ডা. ফুরুল্লা। উনি ফুরফুর করে উড়ছেন সেই অনাদি অনন্তকাল থেকে। বাঙালি জাতি তার ইতিহাসে একবার কঠিন বিপদে পড়েছিলো সেই ১৯৭১ সনে। সে সময়ে সীমান্তে ভারতীয়-ত্রিপুরার কোনো এক বিশ্রামগঞ্জ এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর নিরাপত্তা বলয়ে ডাক্তার সাহেব একটি হাসপাতাল খুলেছিলেন বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। তার জীবনপঞ্জিকায় বোধ করি সবচাইতে জ্বলজ্বল করা উজ্জ্বল কাজ হতে পারে এটিই। কেননা প্রতিকূলে এমন ভূমিকা নেওয়াইতো কাজের মতো কাজ।

সে ছিলো ফুরুল্লা সাহেবের যৌবনের রাজটিকা। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের একনম্বর ‘স্বাস্থ্যগুরু’ হিসাবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করার জন্য ‘অদম্য’ প্রকল্প তিনি হাতে নিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আকাঙ্ক্ষিত সমর্থন ছাতাটি তিনি পেলেন না। কেননা প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক সমাজ ফুরুল্লা সাহেবের স্বাস্থ্য-ভোজবাজি মেনে নিতে চাইলেন না। বঙ্গবন্ধু ঐ প্রতিষ্ঠিতদের ঘেরাটোপ ভেঙ্গে ফুরুল্লাহর জন্য বিশেষ কিছু সহায়তা দিতে সক্ষম হলেন না।

স্বাধীনতার পর থেকেই কতিপয় টাইকুনের মাধ্যমে এদেশে এনজিও-পত্তন শুরু হলো। লোকে বলে তারাই নাকি এনজিও-টাইকুন হতে পেরেছেন সহজে, যারা পাশ্চাত্যে গমন করে যৌবনে ‘ওগো বিদেশিনী’কে আমি ‘চিনি গো চিনি’ বলে মিষ্ট যৌথজীবন গড়তে পেরেছিলেন। পাশ্চাত্য তহবিল সহজে সংগ্রহ করে দিলে প্রাথমিকভাবে ওসব পাশ্চাত্য বিদেশিনীদের জীবন থেকে ফুরুৎ করে সরিয়েও দিয়েছিলেন। আজকের আলোচ্য ফুরুৎ ফুরুৎ ফুরুল্লা ডাক্তারের বেলায় কী ঘটেছিলো, তা খোঁজ নিয়ে পাঠক জেনে নিতে পারেন।

তবে একাত্তরের পর স্বাধীন বাংলাদেশে শুধু তহবিল নয়, কেউ কেউ বলেন ‘তহ-হাওর’ নিয়ে মাঠে নামেন ডা. ফুরুল্লা। প্রচলিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার তিনি ‘ খোল-নলচে’ খুলে বদলে দেবেন। কথাগুলো শুনতে ভালো। ভাবতে ভালো। জাতীয় স্মৃতিসৌধের কাছে তিনি সস্তাদরে জমি কিনে কৃষক খেদিয়ে ‘জনগণের স্বাস্থ্য’ উদ্ধারে এক ‘স্বাস্থ্য-হুজরাখানা’ খুলে বসলেন। জমি দেখেন, জমি হাতান, জমি কেনেন আর কেনেন তার গণস্বাস্থ্যের ঘনীভূত কার্যক্রমে।

জমিহারা অনেক কৃষকের ক্রন্দন তার পাথ্থর-দৃঢ় হৃদয়কে এতটুকু ভেজাতে পারলোনা। তারপর? দেশের সামগ্রিক বেকায়দা অবস্থায় কঠিন পরিস্থিতিতে পতিত বঙ্গবন্ধুকে যখন নৃশংসতমভাবে সপরিবারে নিধন করা হলো, তখন ফুরুল্লা মহলের অভ্যন্তরীন উদোম লম্ফ ঝম্ফ দেখে কে! ভাবলেন, পথের প্রধান আপদ শেষ। বঙ্গবন্ধুর মতো হিমালয় এক মহাবর্বর ভূমিকম্পে শেষ। এখন বাংলাদেশ হলো চৌধুরী ফুরুল্লার, চাষী মাহবুবের, ঠাকুর তাহেরের, মজহার ফরহাদের, মোয়াজ্জেম শাহেনশা’র, ওবায়েদ ফরিদপুরীর।

বঙ্গবন্ধুর চার প্রধান সহযোগীকেও বধ করা হলো ছক অনুযায়ী। অতঃপর ফাঁকা মাঠে ফুরুল্লার ‘স্বাস্থ্য- গোল’। এলো প্রথম জেনারেল। সে আমলে সবকিছু গুছিয়ে এনেছিলেন প্রায়। কিন্তু তার মধুরেণ উপসংহার হলোনা। সংহার হলেন জেনারেল। ফুরুল্লার নিকটজন আরেক পন্ডিত জেনারেলও নিহত হলেন নকশা অনুযায়ী। এবার ক্ষমতায় এলেন একজন সহিংস কবি, একসময় ‘পল্লীবন্ধু’ হিসাবে যার পরিচিতি ছড়ানোর চেষ্টা হলো। আসলে শেষোক্ত জেনারেল হলেন চির নওজোয়ান। একটির পর একটি স্ক্যান্ডাল উৎপাদন করেন, শত সংকটেও হাসি খুশিতে হাবুডুবু থাকেন।

এজতেমার সময় ট্রেন দুর্ঘটনার আহত নিহতদের দেখে বিমর্ষ হয়ে কাঁদেন, ফেরার পথে ঢোকেন গায়িকা বন্ধুর নিভৃত ঘরে। এমন বৈশিষ্ট্যের মানুষের সঙ্গে আবার আমাদের ডা. ফুরুল্লার নানাবিধ সাদৃশ্য খুঁজে পায় বদ-খাসলত লোকেরা। তবে ফুরুল্লার স্বাস্থ্য-ঘন পাথারে পোশাকে আশাকে ঘর্মাক্ত, পরিচ্ছন্নতা দুর্লভ নারীদের ছিলো প্রাধান্য। চৌধুরী আভিজাত্যের সীমানা পেরিয়ে তিনি এসব নারীদের আদিম ভাষায় গালাগাল করে এক ধরনের প্রশান্তি খুঁজে নিতেন বলে অভিযোগ উঠতো, কখনো কখনো ধর্মঘটও হতো।

মহান উক্তিমুখর এই ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে আমাদের জেনারেলের ভাব জমে উঠলো বেশ। একদিন ডাক্তার ঐ জেনারেলকে একান্তে বলেন, আপনার জন্য আমি কিছু একটা করতে পারি, যদি আপনি বিনিময়ে কিছু করেন।

– আহ্হা বলো হে ডাক্তার, দেরি করোনা কী দেবে তুমি আমায়!

-না, না, স্যার, আপনি যা ভেবেছেন, সে লাইনে আমি কথা বলছিনা। তেমন কাজের লোকতো আপনার অঢেল। তবে আমি বলতে চাইছি আপনি কী ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষ পদক’ পছন্দ করবেন?

– কেন নয়, কেন নয় ডাক্তার। বলো কী করতে হবে আমাকে। তোমার গণস্বাস্থ্য হুজরাখানা আমি স্বর্ণ দিয়ে মুড়ে দেবো!

– না, স্যার, আমার অতি সামান্য চাওয়া, আমি একটা ‘ঔষধ নীতি’ প্রণয়ন করেছি। আপনি সেটা পাশ করে দেশে চালু করে দিলেই কেল্লা ফতে! আপনি ঐ স্বাস্থ্যপদকটি পেয়ে যাবেন এ বছরেই।

– ঠিক আছে, ঠিক আছে দেখছি!

দ্বিতীয় জেনারেলের মাথায় তখন অদ্বিতীয় হবার ভাবনা। তিনি ‘ঔষধ নীতি’ নিয়ে এর ওর সাথে কথা বলতে থাকলেন। ওদিকে ফুরুল্লা তুড়ি বাজাতে থাকলেন : এবার আর আমার ‘নোবেল পুরস্কার’ ঠেকায় কে!

দ্বিতীয় জেনারেল বেশি কিছু ভাবলেন না। তিনি চাপিয়ে দিলেন এক ‘প্রকান্ড ঔষধ নীতি’। যা মূলতঃ তেমন মন্দ নয়। কিন্তু প্রচলিত সব কিছু নিমেষে বদলে দেবার তোঘলকী কান্ড হিসাবে এটা গৃহীত হলোনা সাধারণ চিকিৎসক মহলে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাউকে সচেতন না করে, উপর থেকে এভাবে চাপিয়ে দেবার ‘ঔষধ ও চিকিৎসানীতি’ বুমেরাং হয়ে গেলো। চিকিৎসকসমাজ এই সামরিক কায়দার কারবার ফুটো করে দিলেন। একই সঙ্গে ফুটো হয়ে গেলো স্বাস্থ্যপদক আর নোবেল পদকের প্রত্যাশা-কলসি।

দীর্ঘ নয় বছর শাসনের পর দ্বিতীয় জেনারেল যখন ক্ষমতার ঠ্যাং কর্তনে বাধ্য হলেন, তখন ফুরুল্লারও দম ফুরায় ফুরায়। কোনোরকমে দম বাঁচলো তার। এরপর ধীরে ধীরে ‘স্বাস্থ্য রাজত্ব’ ফুরাতে থাকলো তার। নব্বইয়ের পর বেশ কিছুকাল নাক জাগিয়ে রইলেন, ’৯৬-’০১ হাসিনা আমলেও পেছনেই থাকলেন। ’০১-’০৬ আমলেও রয়ে সয়ে থাকলেন। গণস্বাস্থ্য থেকে সরাসরি প্রশাসনিক ঘনত্ব সরিয়ে আনলেন।

দ্বিতীয়বার ২০০৮ সনে হাসিনা সরকার এলে ফুরুল্লা সাহেব বেশ ফুরফুরা হয়ে মাঠে নামলেন বিশেষ জোশে। তখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একজোট গঠনে কতোজনে, কতো সুশীল, কুশীল, অশ্লীল কুশীলবেরা এলো, পাশ্চাত্য দূতাবাস হলো নাটের গুরু। নটেরা নাচতে থাকলো। একযোগে পরিচালিত হলো অতি পরিকল্পিত হামলা শেখ হাসিনার ওপর। শেখ হাসিনা সরকারের প্রদত্ত চ্যানেলে একদল টক-মিষ্টি-তিক্ত-অতি জ্ঞানী চক্র পারলে হাসিনা সরকারকে চ্যানেল পর্দার গোলাতেই উড়িয়ে দেয়। সেসময়ে বেদনা উঠলো ‘গণতন্ত্রে’র। নিরপেক্ষ-পামরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবী উঠলো। আসলে সাম্প্রদায়িক-যুদ্ধাপরাধীদের জোটটিকে ক্ষমতায় আনতে যতো প্রকার চক্রান্ত সম্ভব সবই করতে চাইলো আমাদের ফুরুল্লা মিয়ারা।

আমাদের রাজনীতির মহারানী ক্লিওপেট্রার সাথে ফুরুল্লার তখন সবিশেষ আঁতাত-হটাও হাসিনা।কিন্তু ২০১৪ তে হেরে গেলো ওরা। ২০১৫ তে হেরে গেলো। ২০১৬ তেও হেরে গেলো। ওদিকে যুদ্ধাপরাধী চক্র হিংস্র থেকে হিংস্রতর, হিংস্রতম হতে থাকলো। ক্লিওপেট্রা-যুদ্ধাপরাধী কড়াপাক জোট নিয়ে আর সম্মুখে চলা সম্ভব নয় বলে হতাশ হয়ে পড়লেন ফুরুল্লা-এমাজ চক্র।

সেই হতাশা থেকে ডা. ফুরুল্লা সাড়ে তিন হাজার শব্দের এক ‘উদাম’ চিঠি উদ্দাম গতিবেগে প্রেরণ করলেন ক্লিওপেট্রার কাছে।

-আপনি জামাত ছাড়ুন।

– আপনি স্বীয় দলের গঠনতন্ত্র পড়ুন।

– আপনি আলাপ করে সাংগঠনিক বিলাপের সমাধান করুন।

– দলের ভিতরে গণতন্ত্র আনুন।

– আপনার মাত্র হাতে নয়মাস আছে। যা যা বলছি তা করুন, না হলে নয়মাস পর আর কিছু করার থাকবে না আপনার।

এই চিঠিতে অনেক কিছুই ‘উদাম’ করে দিয়েছেন স্বাস্থ্য চেতনার এই গুদাম-ব্যক্তিত্ব। হায়রে! টকশোতে হাজারো টকটক বকবক করে জীবনভর রাজনীতিতে কেবল উপদেশবাণী বর্ষণ করে গেলেন। ক্লিওপেট্রার উপদেষ্টামন্ডলীর সম্ভাব্য তালিকাও দিয়ে দিলেন।

হায়রে! শেষ খবরে প্রকাশ! ক্লিওপেট্রা মহামান্য নাকি ঐ খোলা চিঠির খোলাপাতা একবার খুলেও দেখেননি। একটি শব্দও পড়েননি।

এবার কি সব উদ্যমের দম ফুরোবে ডা. ফুরুল্লা সাহেবের! ঘনস্বাস্থ্যের নামে দেশে যে হাজার হাজার বিঘা জমি কিনেছেন, সেখানে ‘জৈবসার’ প্রয়োগ করে জীবনের শেষ পর্যায়টা ফুরিয়ে দেবার ব্রত নিলে মন্দ হয় না। শেষ জীবনে ‘ডা. চাষী’ উপাধি নিয়ে পৃথিবী পেরোতে পারবেন বৈকি!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)