সাপ্তাহিক ছুটির এই সুন্দর সকালে, বিষণ্ণমনা বাজার ফেরত আপনি হয়তো “বৃদ্ধি মানে উন্নতি, অতএব স্বাগতম-হে মূল্য বৃদ্ধি” এই সূত্র মানিয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে মস্তিস্কে জ্বলা অগ্নি নির্বাপণের চেষ্টা করিতেছেন, নিরাপত্তার চাদরে শতচ্ছিদ্র আতঙ্কে আইনের সেই মহান সূত্র, “কেনার সময় দেখিয়া কিনিও” অনুসরণে স্বপ্রণীত “নিজের জান নিজে বাঁচাও” মানিয়া গিন্নির জীবন অতিষ্ঠ করিয়া তুলিবার ভয় জয় করিয়া, সন্তানের করুণ মুখদর্শন বেদনা সহিয়া, অদ্যকার সমস্ত সামাজিক কর্মসূচি বাতিল করিয়াছেন।
সকালের চা সহযোগে, সারাবিশ্ব হইতে জঙ্গি দমনে অসাধারন ভুমিকা পালনের জন্য প্রশংসা অর্জনকারী ও সেই সাফল্য প্রচারে গর্বিত বাহিনী প্রধান, মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক কর্তা আজ যখন বলেন, “কিসের জঙ্গি? সব বাদ! কোথায় জঙ্গি? (হইতেও পারে জঙ্গল থাকিলে না জঙ্গি (জংলি আরকি)? জঙ্গল তো কাটিয়া ফর্সা!)” অতীতেও ছিল না, আগামীতেও আসিবে না, সর্বশক্তি——! এই ধরনের বাক্য সন্মুখের সংবাদপত্র পাতায় ছাপা দেখিয়া আপনি হয়তো হতচকিত।
তবু বাংলাদেশের জঙ্গি মুক্তি উপলক্ষে আজ জুম্মার নামাজ অন্তে ইমাম সাহেবকে বিশেষ মোনাজাত করিবার অনুরোধ করিবেন বলিয়া একটু স্বস্তি লভিয়াছেন। তখন আপনাকে আনন্দের সাথে জানাইতে পারিয়া আমিও প্রীত যে, বড় ভাই সাজিয়া খুন, নারী নির্যাতন, দ্রব্যমূল্য, জঙ্গিবাদ, আইনের শাসন নিয়া প্রশ্ন, টেণ্ডারবাজী ও বাজীকর, সা-কা’র ফাঁকা বুলি, প্রতিটি নদী হইতে অবৈধ তোলা বালি কিংবা টেমসের তীর হইতে দেয়া হাততালি, নিন্দুকের ফিসফিস ভোটহীন ১৫৪ আসন নাকি পতনের লক্ষণ- এর কোন কিছুতেই সরকার বাহাদুরও চিন্তিত নন। স্বস্তিতেই আছেন।
তবে সৃষ্টি লগ্নে ঈশ্বর ভাবেন যে, পৃথিবীতেই যদি শতভাগ স্বস্তি পায় মানুষ তবে স্বর্গের মূল্য তাহারা কি করিয়া বুঝিবে? সেই ভাবনা হইতে নিরংকুশ স্বস্তি লাভ এই জগতে স্রষ্টার ইচ্ছা বিরুদ্ধ। আকাশ যতই পরিষ্কার হোক, কোন না কোন কোনায় একটু খানি কালো মেঘ থাকেই, তেমনি বর্তমান সরকারের সামনে একটি সংকট বিরাজমান। আমি তার (সংকট) কথা বলিব বলিয়া আসিয়াছি। এর সাথে আপনি, আমি হইতে শুরু করিয়া আমাদের অনলাইন সম্পাদক কিংবা ভাটির শার্দূল মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহোদয় এর সাবালকত্ব অর্জনের প্রশ্ন জড়িত। অবাক হইবেন যদি সাথে এটিও যোগ করি যে রাষ্ট্রের আইন এই সংকট তৈরি করিয়াছে। কিভাবে?
উপরোল্লিখিত সাপেক্ষে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী সব নরনারী ১৮ পূর্ণ হইবার পর সাবালকত্ব লাভ করিয়াছেন মর্মে গণ্য হইবেন তৎপূর্বে নহে ।
একটু দেখুনঃ আপনি সাবালক তবে এই সাবালকত্ব অর্জনের বয়সটি কত? আসুন দেখি সাবালকত্ব আইন – ১৮৭৫ (১৮৭৫ সালের ৯ নং আইন)। এই আইনের ৩ ধারায় বলা হইয়াছে, উক্ত আইনে বর্ণিত ১ ও ২ সাপেক্ষে ১৯০৮ সনের দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের প্রথম তফসিলের ৩২ আদেশের অর্থে, অন্য আইনে যাই থাকুক ২১ অতিবাহিত হইবার পর সাবালক মর্মে গণ্য হইবেন (বিষদ ব্যাখ্যা করছি না)। সুত্রঃ সাবালকত্ব আইন ১৮৭৫।
এইবার ভিন্নভাবে প্রশ্ন করা যায়, আইনত শিশু গণ্য হইবার বয়স অতিক্রান্ত হইলে সাবালকত্ব অর্জিত হইল বলিয়া বলা হয়। বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে সেই বয়সটি কত? শিশু বলিতে কি বোঝায় তা Children act 1974 sec 2(f) অনুযায়ী ১৬ বয়সের কম বয়স্ক কোন ব্যাক্তি, এছাড়া আদালত হেফাজতে প্রেরন করিলে, জেলে পূর্ণ সময়কাল আটক থাকিলেও যদি ১৬ অতিক্রান্ত হয় তবু সে শিশু ।
এইবার দুটি আইন পাশাপাশি রাখিলে সাধারণ অর্থে ১৬ পর্যন্ত শিশু আর ১৮ তে সাবালক। মাঝের দুই বছর কারো আইনি অবস্থান কি হইবে? প্রিয় পাঠক, আপনি বলিতেই পারেন, ” তাতে আমার কি?” কিছু না। কিন্তু আপনি যদি এই ১৬-১৮ এর মাঝে বয়স এমন কারো হাতে খুন হন তবে অনেক কিছু !
বিজ্ঞ আইনজীবী ১৭ বয়স ৩৬৪ দিন ঘাতকের বয়স দাবী করিয়া মহামান্য আদালতকে বলিবেন হুজুর, আমার মক্কেল নিতান্ত অবোধ, শিশু। কি দরকার এত বিচার আচার, তাহার কোমল মনে চাপ ফেলিবে! মাফ করিয়া দেন। নয়ত শিশু আইনে বিচার হোক! এই বিষয়টি যে পার্থক্য তৈরি করিবে তাহা, আপনি জান্নাতুল ফেরদৌসে বসিয়াও মানিতে পারিবেন না। অল্প কথায় বলি, বর্তমানে ১৪/১৫ বছরের বালক, বালিকাগণ পরিকল্পিত অপরাধের যে নজির স্থাপন করিতেছে তাতে শিশুর সংজ্ঞা নতুন করিয়া নির্ধারণ একান্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে লিখার ইচ্ছা রাখি অন্য সময়।
যাই হোক, এদেশে আইন হইল একমাত্র বিষয় যার অভিভাবক নাই (যেহেতু সবার উপরে আইন!)। তাই যিনিই ক্ষমতায় আসেন ইচ্ছামত প্রণয়ন করেন। বর্তমান সরকারের একমাত্র সংকট এর জায়গাটিও ইচ্ছাপ্রয়োগ ও সমন্বিত বিবেচনা ছাড়া আইন প্রণয়ন এর চেষ্টা হইতে সৃষ্ট এবং সম্ভবত সেই একই ব্যাপার আবারও ঘটিতে যাইতেছে।
২০০০ সনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে যে আইনটি প্রণীত হয় তাহাতে বলা হইয়াছে, অন্য কোন আইনে যাহাই থাকুক এই আইনের অধীনে আনীত হইলে ১৪ বছরে অনধিক কেউ শিশু বলিয়া গণ্য হইবে, মানে হইল ১৪ বছরের অধিক কাউকে শিশু বলিয়া গণ্য করা যাইবে না!! ইচ্ছাটি মহৎ ছিল নির্যাতন দমন। কিন্তু যদি বলি এই আইনের অধীনে যে গৃহভৃত্যটি মার খাইয়া অভিযোগ করিল, সে কি তবে শিশু কাল ১৪তে হারাইল? এটা ট্রিকি কোশ্চেন হয়ত কিন্তু শিশু আইনের ১৬ পর্যন্ত শিশু হইলে ১৪ থেকে ১৬ মাঝের দুই বছর কই গেল?
পাঠক ব্যাস্ত হইয়েন না এই ভুল সংশোধন হইবে সামনে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধন আসে ২০০৩ এ, যা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩ নামে পরিচিত। ২০০৩ সনের ৩০ নং এই আইনে ২০০০ এ প্রণীত ৮ নং আইনের ২ এর ট তে বলা হয়, শিশু অর্থ অনধিক ১৬ বছর বয়সের কোন ব্যাক্তি।
পাঠক বিরক্ত হইবেন না, আইনের নীরস বর্ণনা ও কে শিশু এই ভাবনাতে আমি জানি আপনাদের সবার’ই ভাবনা বিহীন শিশু কালে ফেরত যাইতে ইচ্ছা করিতেছে, তবু একটু অপেক্ষা করুন বিনোদন বাকী। রজনী এখনও যথেষ্ট তরুণী! বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ সনের ১৯ নং আইন। এই আইনের ধারা ২। ক শিশু বলিতে ঐ ব্যাক্তি কে বুঝাইবে যাহার বয়স পুরুষ হইলে ২১ বছরের কম, নারী হইলে ১৮ বছরের কম। (এটি চূড়ান্ত ১৯৮৫ সনের ১৪ নং অধ্যাদেশ দ্বারা। এখানে নাবালক এর সংজ্ঞা ২ এর ঘ তে পুরুষের বেলা ২১ ও নারীর বেলা ১৮, তাই শুরুতে বলিয়াছিলাম আমি তবে কবে সাবালক হইলাম বা মহামান্যরা?
আমাদের নির্বোধ আইন প্রণেতাদের বলি, কোন পুরুষের ২১ যদি সাবালকত্ব লাভের বয়স হয় তবে ঐ পর্যন্ত সে কেন শিশু গণ্য হইবে না? অথবা ফৌজদারি অপরাধের বেলায় সে কেন শিশু গণ্য হইবে না ২১ পর্যন্ত? সে তো আইনত নাবালক! লক্ষ্য করুন ১৯৮৫, ২০০০, ২০০৩ এই ভিন্ন শাসন আমলে কৃতিত্ব নিতে কোন ভাবনা চিন্তা ছাড়াই বিশেষ আইনের নামে আইন জারী করিয়াছেন। ঐ যে শর্ত সাপেক্ষে বলিয়া দুটি শব্দ আছে! অথবা মহান সংবিধানের সুমহান প্রণেতা যখন বলেন, সংবিধান প্রণয়নে সব স্বাধীনতা নিশ্চিত করিয়াছি এবং এখনও ক্রমাগত বলিয়া যাইতেছেন! ৪০ বছর পর শুনি বন্ধনিতে লিখা যুক্তি সংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে!! যুক্তি যে কি জিনিস তা এখনও সভ্যতা শিখে নাই। তবে আমার স্ব-আবিষ্কৃত সংজ্ঞা হইল: “ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ার হয় আমার প্লেয়ার নইলে ব্যাটা চোর”।
এইবার সরকারের কি সংকট? বিশ্বস্ত কোন সুত্রে কি তাহারা জানিতে পারিয়াছেন যে, বাংলাদেশের রমণীকুল একজোট হইয়া পথে নামিবার গোপন পরিকল্পনা করিয়াছেন যে তাহারা ১৬ তে বিবাহ করিতে চান? মানে যাহাদের বয়স ৭০ তাহারা ভাবিতেছেন ১৬ তে বিবাহ না করিতে পারায় তাহারা জীবনের সব আনন্দ বঞ্ছিত হইয়াছেন? তাহাদের কন্যা’রা যেন বঞ্চিত না হন তাই এই চক্রান্ত? অথবা চক্রান্ত বাস্তবায়নে লন্ডন কমিটি “বড় বোন” নিয়োগ দিয়াছেন প্রতিটি জেলায়-জেলায়, থানায়, গ্রামে, গলিতে যেন সরকারের অক্সিজেন বন্ধ করিয়া দেয়? এই ২০১৫ সনে পেছনে কতদুর ফিরতে চান মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণলয় বা আইন মন্ত্রনালয়ের কর্তা? সরকার কি তবে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে খেলিবার লোক পাইতেছে না! তাই যে কোন মূল্যে প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করিবেন? কি অদ্ভুত উট!
কয়েকবার পিছাইয়া গিয়া (১৬ মেয়েদের বিয়ের বয়স) শেষ পর্যন্ত অসাধারণ এক যুক্তি দিলেন বেশ তো বিয়ের বয়স মেয়েদের ১৮ তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে ১৬! বাহ, বাহ! এটি দিয়া শেষ করিব তাই পরে বলি।
তবে সমাধান দরকার, এই নির্বোধ আমলারা উস্কানি দিতে পারেন এই সরকার না থাকিলে তাহারা বড়জোর ও, এস, ডি হইবেন কিন্তু বেতন পাইবেন। ক্ষতি হইবে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির। কারণ ছাড়া, কোন দাবী ছাড়া, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, জনমত সব অবহেলা করিয়া এই পরিস্থিতি তৈরি করিতেছেন কোন মহল এমন ভাবনা আসে না কি? আর রাজনৈতিক নেতা ও মেধা! এই সময়ে যত কম বলা যায়, তৈল মর্দন সংক্রান্ত হইলে ভিন্ন বিষয়! সমাধান তবে কি?
— অল্প বয়সীদের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তির সাথে মানসিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, সামাজিক অস্থিরতা, নেশা, ভায়োলেন্স, পর্ণগ্রাফি, বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতি সব মিলিয়ে যে মানসিক কাঠামো তৈরি হয় তাতে বর্তমান সময়ে শিশু বলিয়া আইনগত মর্যাদা হইবে “১৫” বছর। পরবর্তীতে বিবাহ যোগ্যতা লাভের বয়স হইবে, নারী – পুরুষ উভয়ের বেলায় ২০(বিশ)।(অনেকে ভাবিতে পারেন পুরুষ বলিয়া আমি এটি করিলাম কি? না বাংলার পুরুষ যে এই বিষয়ে কত দুর্ভাগা সম্পাদক প্রকাশিলে আরেকদিন লিখিব!)। এর বাইরে আদালতের আদেশ, মানসিক অক্ষমতা ইত্যাদি আইনি বাধা থাকিলে তা সেভাবে সম্পন্ন হইবে। আর এই ২০ এর পূর্বে বিবাহ কেবল বাতিল নয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। মেয়েদের ১৬’র পক্ষে যে যুক্তি দেখান তার কিছুটা জানি, খোলা আলোচনায় আসুন, চ্যানেল আই অনলাইন চাইলে আয়োজন করিতে পারে। সংশ্লিষ্টরা ভাবুন।
বলিয়াছিলাম বিশেষ পরিস্থিতি ও ১৬ বছরে বিবাহ দিয়া শেষ করিব! আসলে এই দুর্ভাগা দেশে বিশেষ পরিস্থিতি(সুবিধা অর্থে) কাদের জন্য? প্রশ্নর মত উত্তরটাও সবাই জানি খুব সোজা উত্তর। তবে কোন কারণে কমিশন যদি ভোটার তালিকা হতে আমার নামটা ক্রস করিয়া ফেলে তাই ভয়ে লিখিলাম না। যাদের জন্য আইনের বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তেমন ক্ষমতাবানেরা কি ভাবিতেছেন যে, হায় জাতির সেবায় জীবন- যৌবন উৎসর্গ করিয়া কি পাইলালাম? (আমলারাও কিন্তু নিঃস্বার্থ জাতির সেবা করেন)!!! সেই যে কবিতায় পড়িয়াছিলাম “তাহার ষষ্ঠাদশী কোমল মুখ” তাহা’ত দেখা হয় নাই! কাজেই চক্ষু মুদিবার পূর্বে চক্ষু খুলিয়া একবার দেখিয়া লই! অতঃপর আমলাগণ সহকারে ষষ্টাদশী’র কোমল মুখ দর্শন প্রকল্প বাস্তবায়নে ও আইনি সুরক্ষায় এই উদ্যোগ? তাহা হইলে এই আইনটির নাম রাখিলাম: ল অব সুইট সিক্সটিন!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)