নিমতলী ট্রাজেডির পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির করা অগ্নিকাণ্ড রোধে ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা প্রশ্নে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
আগামি চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, শিল্প সচিব, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সচিব, বিসিআইসি’র চেয়ারম্যান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালত তার রুলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির করা পূর্বের ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়েছেন।
এবং চকবাজারের মতো এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া, এ ধরণের ঘটনা প্রতিরোধে কেমিক্যালসহ সকল দাহ্য পদার্থ মজুদ, বাজারজাত ও সরবারহে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করে তা কার্যকর করে কঠরভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না রুলে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় করা পৃথক চারটি রিটের শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। আর রিটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ইউনুছ আলী আকন্দ, ব্যারিস্টার মো. রিয়াজ উদ্দিন ও অমিত দাশগুপ্ত।
৯ বছর আগে নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর ২০১০ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের দূর্ঘটনা রোধে ১৭ দফা সুপারিশ করেন।
যে সুপারিশে বলা হয়
১. জরুরী ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়া।
২. অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।
৩. অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন ২০০৩ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা।
৪. রাসায়নিক দ্রব্যের মজুত, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির জন্য লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে তদারকি প্রক্রিয়া জোরদার করা।
৫. আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা রিস্ফোরক দ্রব্যের মজুত বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন।
৬. দ্রুত অগ্নিনির্বাপনের জন্য স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন।
৭. আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুতকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা
৮. বাড়িঘরে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগত মান নিশ্চিত করা
৯. রাস্তায় স্থপিত খোলা তারের ব্যাপারে সাবধানতা
১০. সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে মাসে অন্তত একবার ট্রান্সফরমার সরেজমিনে পরীক্ষা করা
১১. দুর্ঘটনা মোকাবেলায় জাতীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন
১২. রাসায়নিক ও রাসায়নিক জাতীয় দাহ্য বস্তুর আলাদ দপ্তরের পরিবর্তে সব দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়
১৩. সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো, জনবল, প্রশিক্ষণ ও সাজ সরঞ্জামের আধুনিকায়ন, সচেতনতা বাড়ানো
১৪. অগ্নিকাণ্ডের সময় যেন উৎসুক জনতা উদ্ধারকাজে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা লক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো
১৫. পাঠ্যসূচিতে অগ্নিকাণ্ড, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয় বাধ্যতামূলক করা
১৬. ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং
১৭. বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র রাখা।
এদিকে গত ২০ রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা যান ৬৯ জন। এরপর গত রোববার হাইকোর্টে এ অগ্নিকাণ্ডের বিষয় নিয়ে পৃথকভাবে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ, আইনজীবী নুর মোহাম্মদ আজমী ও খন্দকার মো. সায়েদুল কাউছার, আইনজীবী জেড আই খান পান্না এবং বংশালের বাসিন্দা মো. জাবেদ মিয়া।
এরপর গত সোমবার এ রিটগুলো শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হলে আদালত চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে বলেন, এটাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না। এর দায় কাউকে না কাউকে নিতেই হবে।
আদালত আরো বলেন, নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের করা উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এধরনের দুর্ঘটনারোধে যে সব সুপারিশ করেছিলেন সেগুলোর বাস্তবায়ন হলে চকবাজারে এই দুর্ঘটনা হয়ত ঘটতো না।
আর পুরান ঢাকার বাড়ির মালিকরা তাদের বাসা দুই তিনগুণ বেশিতে গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেন। নিজেরা থাকেন গুলশান-বনানীতে। সিটি কর্পোরেশন এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। পরে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনায় মারা যায় সাধারণ মানুষ। আর পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো এত সরু যে সে সব রাস্তা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ঠিকমতো যেতে পারে না।
আদালত আরো বলেন, আমারা পত্রিকায় দেখেছি নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরে প্রধানমন্ত্রী দুটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন। আবার চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরই উনি তা মনিটরিং করেছেন। উনি অনেক করছেন। কিন্তু উনি একা তো এ দেশটা চালাতে পারবেন না। সবারইতো দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি (ইমেজ) নষ্ট হয়ে যাবে।
আদালত এসব কথা বলার পর মঙ্গলবার দুপুর ২টায় অ্যাটর্নি জেনারেলের উপস্থিতিতে রিটগুলো শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করেন। সে ধারাবাহিকতায় আজ রিটগুলোর উপর শুনানি হলে পরে হাইকোর্ট রুল জারি করেন।